Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪,

অষ্টগ্রামে জমে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী চৌদ্দমাদল মেলা

অষ্টগ্রাম (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি  

জানুয়ারি ২০, ২০২১, ০১:৫৫ পিএম


অষ্টগ্রামে জমে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী চৌদ্দমাদল মেলা

কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামে চৌদ্দমাদল মেলাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা গেছে। 

অষ্টগ্রামের বাঙ্গালপাড়া ইউনিয়নের বাঙ্গালপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠে সোমবার (১৮ জানুয়ারি) থেকে শুরু হওয়া ৯১তম চৌদ্দমাদল মেলা চলবে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত।

চৌদ্দমাদল মোলা ভাটি এলাকার সবচেয়ে বড় হিন্দুধর্মীয় উৎসব। প্রতি বছর মাঘ মাসের ৪ তারিখ এই উৎসবের শুরু হয় এবং ৫ দিন যাবৎ এই উৎসব চলে। উৎসবের সঙ্গে বর্ণাঢ্য গ্রাম্য মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি মেলার অনুষ্ঠানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষ সমাগম হয়।

[media type="image" fid="106659" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]

হাওর জনপদ অষ্টগ্রামের ‍নিজস্ব ঐহিত্য হয়ে ওঠা চৌদ্দমাদল মেলার শুরুর ইতিহাসও বেশ চমকপ্রদ।

আয়োজক সূত্র জানায়, বাংলা ১৩৩৭ সালের (ইংরেজি ১৯৩১) মাঝামাঝি সময়ে বাঙ্গালপাড়ার বাসিন্দা রাধাকান্ত দেবনাথ, নদীয়ার চাঁদ রায়, রাইচরণ সাহা ও প্রকাশ চন্দ্র সাহা  ভারতে তীর্থ করবার মানসে যাত্রা করেন এবং তীর্থ ভ্রমণের কোন এক পর্যায়ে এরা চারজন একত্রিত হন পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপে। সেখানেও চৌদ্দমাদল নামক একটি ধর্মীয় উৎসব হয়, উৎসব শেষে এরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঠিক করেন যে এরাও বাড়িতে গিয়ে চৌদ্দমাদল করবেন। সেই থেকে এই চৌদ্দমাদল শুরু।

[media type="image" fid="106660" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]

স্থানীয় সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চৌদ্দমাদল পূজায় কীর্তনের জন্য ১৪টি খোল ও বাদ্যযন্ত্র এবং ১৪ জোড়া করতাল প্রয়োজন। ফলে এটা চৌদ্দমাদল নাম ধারণ করেছে বলে মত তাদের।

প্রথম অবস্থায় জয় হরি দেবনাথ চৌদ্দমাদল করার জন্য কিছু জায়গা দান করেন। দানকৃত জায়গাটির উপর একটি টিনের চালা তৈরি করে চৌদ্দমাদলের সূচনা হয়। পরে নাথ মন্দিরটি পাকা করা হয়। বর্তমানে পাকা ঘরে গৌর নিতাই সাহা পাথরের আসনের উপর পাথরের মূর্তি আছে। মন্দিরটি স্থানীয় জনসাধারণের দানে নির্মিত। নাথ মন্দিরের গৌরনিতাই মূর্তি ছাড়াও রাধা গোবিন্দের মূর্তি আছে। পূর্বে ৪ঠা মাঘ চৌদ্দমাদলের  দিন পূর্বঅষ্টগ্রাম, বাংগালপাড়া, কাস্তল, চাতলপাড়, গোয়ালনগর, নোয়াগাঁও প্রকৃতি এলাকার ভক্তগণ তাদের নিজ নিজ দল নিয়ে কীর্তন করতে আসত এবং ভোর রাত্রি হতে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত কীর্তন চলতো। এরমধ্যে ভক্তগণ প্রসাদ খিচুড়ি, লাবরা, মিষ্টান্ন, ফলমূল ইত্যাদি বিতরণ করত।

বর্তমানকালে আনুষ্ঠানিকতা ঠিক থাকলেও ৪ঠা মাঘ স্থানীয় কীর্তনী দল খুব একটা বেশি আসে না। ফলে চৌদ্দমাদল কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকতা শ্রীবৃদ্ধির জন্য দেশের অন্যান্য কীর্তনী দলকে আহ্বান জানায়। 

ফলে ফরিদপুর, বরিশাল, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, সিলেট প্রভৃতি অঞ্চল হতে দল আসে এবং অষ্টপ্রহর কীর্তন হয়। চৌদ্দমাদলকে কেন্দ্র করে এখানে সাত দিন যাবত একটি গ্রামীণ মেলার আয়োজন করা হয়। চৌদ্দমাদল মূলত একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও মেলায় যাত্রাগান সহ বিভিন্ন বিষয়যুক্ত হয়ে এটি একটি সামাজিক উৎসবের রূপলাভ করেছে। এখন এই উৎসবে আসার জন্য লোকজন সারাবছরই উন্মুখ হয়ে থাকে।

মেলার আয়োজক সূত্র জানায়, এবার খোলা মাঠে আয়োজিত এ মেলায় ছোট বড় ২০০ টির মতো অস্থায়ী দোকান বসেছে। এসব দোকানে প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র থেকে শুরু করে নানা ধরণের পণ্যের পসরা বসেছে। মেলায় আসা শিশুদের প্রধান আকর্ষণ মাটির পুতুল, পালকি, ঘোড়া, গাড়ি, বল, বেলুন, বাঁশি, ইলেকট্রিক গাড়ি, খেলনা পিস্তল, হেলিকপ্টার, ট্রেন, টেলিফোন ও খেলনা মোবাইল প্রভৃতি।

মেলায় দলবেঁধে আসা গায়ের বধু ও কিশোরীরা কিনে নিচ্ছেন সারা বছর ব্যবহারের মতো প্রসাধনী ও পছন্দের জিনিসটি। তাদের আগ্রহের চূড়ায় রয়েছে আলতা, পাউডার, কাঁচের চুড়ি, ক্রিম, মুখের ক্রিম, ফেইস ওয়াস, লিপিস্টিক, খোঁপা, ক্লিপ, কানের দুল, সাবান, বডি স্প্রে প্রভৃতি।

মেলায় পাওয়া যাচ্ছে হরেক রকম গৃহস্থালি পণ্যও। ফলে কৃষকরা কিনে নিচ্ছেন দাঁ, বটি, কাস্তে, কুড়ালসহ নানা জিনিস।

মেলায় আরো রয়েছে কাঠের তৈরি খাট, চৌকি, আলনা, চেয়ার, টেবিল, সোফাসেট, ড্রেসিং টেবিল, ডাইনিং টেবিলসহ নানা আসবাবপত্র। এর মূল্যও অনেকটা সহনীয়।

হাওরের চিত্ত-বিনোদনের প্রধান এ মেলা উপলক্ষে বাদ পড়েনি  মণ্ডা-মিঠাই। পসরা বসেছে রসগোল্লা, দই, নিমকি, চমচম, জিলাপিসহ হরেক পদের মিষ্টান্নের।

সেইসঙ্গে বাহ্যিক বিনোদনের জন্য রয়েছে নাগরদোলা, পুতুল নাচ, বায়োস্কোপের ব্যবস্থা।

বাঙ্গালপাড়ার ইউ'পি চেয়ারম্যান মো. এনামুল হক ভূইয়া বলেন, চৌদ্দমাদল মেলা ঐতিহ্যের অংশ, আমাদের শৈশব থেকে দেখে আসছি আবহমানকাল থেকে অষ্টগ্রামের প্রধান গ্রামীণ মেলা হিসেবে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের নিকট তাৎপর্যপূর্ণ। এই মেলায় হাওরের ঘরে ঘরে একটা আমেজের সৃষ্টি হয়।

বাঙ্গালপাড়ার বাসিন্দা সমাজকর্মী পিপুল ভূঁইয়া প্রেম জানান, এই উৎসবে আসার জন্য লোকজন সারাবছরই উন্মুখ হয়ে থাকে, ছোট বাচ্ছারা মাটির ব্যাংক এই মেলা থেকে ক্রয় করে সারা বছর মাটির ব্যাংকে টাকা জমিয়ে মেলার সময় ব্যাংক ভেঙ্গে মেলায় খরছ করে আনন্দ উপভোগ করে, এই মেলা ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ।

এ মেলা উপলক্ষ্যে ভৈরব, কুলিয়ারচর, বাজিতপুর, নাসিরনগর, ইটনা, মিঠামইন হবিগঞ্জ থেকে বিপুল পরিমান মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকে।

আমারসংবাদ/কেএস