শিক্ষক মমিনুলের নিয়োগ-বদলির সব তথ্যই ভুয়া

নেত্রকোনা প্রতিনিধি প্রকাশিত: নভেম্বর ৯, ২০২২, ০৭:৩৪ পিএম
শিক্ষক মমিনুলের নিয়োগ-বদলির সব তথ্যই ভুয়া

নিজের জেলা নেত্রকোনার ঠিকানা গোপন করে সুনামগঞ্জ জেলা কোটায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ‘সহকারী শিক্ষক’ পদে ২০০৯ সালে চাকুরি নেন মো. মমিনুল ইসলাম। পরে ২০১৫ সালে স্ত্রীর কর্মস্থলের ভুয়া প্রত্যয়ন দেখিয়ে নেত্রকোনায় বদলি হন তিনি।

এমন অভিযোগ উঠেছে নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার সাহতা সাহতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. মমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে। এছাড়া চাকরি জীবনের ১১ বছরে তিনি কোন পুলিশ ভেরিফিকেশন জমা দেননি।

মমিনুল ইসলাম নেত্রকোনা সদর উপজেলার মেদনি ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর গ্রামের মৃত মো. সামছু উদ্দিন খানের ছেলে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত কাগজপত্রাদি পর্যালোচনায় জানা গেছে, মমিনুল ইসলাম সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর পৌরসভার নাগরিগত্ব ও জন্মসনদে ২০০৯ সালের মে মাসের ৪ তারিখ জগন্নাথপুরের কাতিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে চাকুরিতে যোগদান করেন। পরে তার স্ত্রী মোছা. নাজমা আক্তার ‘পারি মাল্টিপারপাস’ নেত্রকোনা কেন্দ্রের ‘কমিউনিটি অর্গানাইজার’ পদে কর্মরত এমর্মে প্রত্যয়নপত্রের বিপরীতে সেখান থেকে ২০১৫ সালের মার্চের ২৯ তারিখ নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার মল্লিকপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন। সেখান থেকে ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল ‘অধিক্ষেত্রে’ বদলি হয়ে বারহাট্টার সাহতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যান। এখনো অবধি সাহতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন মমিনুল। তবে ২০১৮ সালের ভোটার তালিকায় নেত্রকোনার নিজ উপজেলার ভোটার মমিনুল।

এদিকে প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরির শর্তাবলী অনুযায়ী- নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক/শিক্ষিকা কর্তৃক যে কোন সময়ে সরবরাহকৃত যে কোন তথ্য ও সনদপত্র মিথ্যা/ভুয়া/ত্রুটিপূর্ণ প্রমাণিত হলে নিয়োগ বাতিল করা যাবে এবং প্রচলিত আইনের বিধান অনুযায়ী তার/ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে বলে উল্লেখ আছে। নিজ জেলার বাইরে অন্য কোন জেলার ঠিকানায় চাকুরি নেয়ার নিয়ম নেই। তথ্য গোপন করে অন্য জেলা থেকে কেউ চাকুরি তার বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন নেত্রকোনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা তাহমিনা খাতুন।

সরেজমিন নেত্রকোনা সদরের মেদনি ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর গ্রামে গিয়ে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মমিনুল ইসলামের পিতা মৃত মো. সামছু উদ্দিন খান নিশ্চিন্তপুর গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা। এমনকি তার পূর্ব পুরুষদের জন্মভিটাও এই গ্রামেই। মমিনুলের স্ত্রীর ভাই আব্দুল কুদ্দুছ সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলা শিক্ষা অফিসে অফিস সহকারী পদে কর্মরত। তারই ঠিকানা ব্যবহার করে মমিনুল জন্ম সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে সুনামগঞ্জ জেলা কোটায় সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি নেন। পরে স্ত্রীর ভুয়া চাকরির প্রত্যয়ন দেখিয়ে নিজ জেলায় বদলি হয়েছেন। তার স্ত্রী নাজমা একজন গৃহিনী। তিনি কোন চাকরি করেন না। এমনকি নেত্রকোনায় স্ত্রীর কর্মস্থল ‘পারি মাল্টিপারপাস’ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে নেত্রকোনাতে এমন কোন প্রতিষ্ঠানের অস্থিত্ব পাওয়া যায়নি। এছাড়া বদলি জন্য স্ত্রীর কর্মস্থল উল্লেখ করে যে প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়েছে তাতে নেই প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা এবং স্বাক্ষরদাতার নামও।

এদিকে মমিনুলের সুনামগঞ্জের ঠিকানায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ২ নম্বর হোল্ডিংস এর ঠিকানা ব্যবহার করে জন্ম নিবন্ধন ও নাগরিকত্ব সনদ নিয়ে চাকরি নিয়েছেন মমিনুল। ওই ওয়ার্ডের ২ নম্বর হোল্ডিংসের মালিক  হান্নান কোরেশি। পাশের ৩ নম্বর হোল্ডিংস এর মালিক  ফজর আলী। তারা কেউই মমিনুল নামের কাউকে চিনেন না।

বিষয়টি অবগত করলে কারা বলেন, আমাদের ঠিকানা দিয়ে প্রতারণা করে জাল জন্ম নিবন্ধন ও নাগরিকত্ব সনদ নিয়ে চাকরি নিয়েছেন মমিনুল নামের ওই ব্যক্তি।

নেত্রকোনা সদর উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানান, আমার জানা মতে নেত্রকোনায় ‘পারি মাল্টিপারপাস’ নামে কোন প্রতিষ্ঠান নেই।

শিক্ষক মুমিনুলের মামা নিশ্চিন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা ষাঠোর্ধ তারা মিয়া বলেন, মুমিনুল ও তার পূর্বপুরুষের জন্মভিটা এই গ্রামেই। গ্রামের তাদের বিশাল বাড়ি। তার ভাইয়েরাও এখানেই থাকে। পাশের গ্রাম কান্দাপাড়া গ্রামে খালাতো বোন নাজমাকে বিয়ে করেছেন মমিনুল। তার স্ত্রী গৃহিনী।

শিক্ষক মমিনুলের চাচাতো ভাই আলমগীর বলেন, সুনমাগঞ্জের জগন্নাথপুরে মুমিনুলের স্ত্রীর ভাই চাকরি করে। সেই সুবাধে সেখানের একটি স্কুলে তিনি চাকরি নিয়েছিলেন। পরে বদলি হয়ে এখন নিজের জেলায় চলে এসেছেন। স্ত্রীসহ মমিনুল এখন নেত্রকোনা শহরের চকপাড়াতে বসবাস করেন।

নেত্রকানা সদর উপজেলার মেদনি ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আব্দুল বারেক জানান, শিক্ষক মমিনুল ইসলামের বাপ-দাদার জন্মভিটা এই নিশ্চিন্তপুর গ্রামে।

অভিযুক্ত শিক্ষক মমিনুল ইসলাম বলেন, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে আমি দীর্ঘ বিশ বছর থেকে সেখানকার নাগরিক হয়েছি। তাই নিয়ম অনুযায়ীই সেখান থেকে চাকরি নিয়েছি। এতে কোন সমস্যা নেই।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা তাহমিনা খাতুন বলেন, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের নিয়ম হলো নিজ জেলা থেকে চাকরি নিতে হবে। অন্য জেলা থেকে চাকরি নেওয়ার নিয়ম নেই। সহকারী শিক্ষক মমিনুল ইসলাম যদি যদি ভুল তথ্য দিয়ে অন্য জেলা থেকে চাকরি নিয়ে থাকেন, তবে বিধি দেখে সেই অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কেএস