স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়াই তাদের নেশা

সিরাজদীখান (মুন্সীগঞ্জ) প্রতিনিধি প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৩, ০৭:০৫ পিএম
স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়াই তাদের নেশা

এসো মিলি রক্তের বাঁধনে এ স্লোগানকে ধারণ করে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানে বিক্রমপুর রক্তদান সংস্থার হাজারো তরুণ-তরুণী স্বেচ্ছায় করে যাচ্ছেন রক্তদান। অনেকে ছোটখাটো অপারেশন এবং বিশেষ করে মুমূর্ষু প্রসূতি মায়ের সিজারসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে হয় রক্তের। সময় মতো রক্তের ব্যবস্থা করতে না পারলে অনেক মায়েদেরসহ বিভিন্ন রোগীর ভাগ্যে ঘটে অপ্রত্যাশিত মৃত্যু। অথচ রক্ত পাওয়া গেলে বাঁচানো যায় অনেক জীবন। এর ফলে অপারেশন এবং বিশেষ করে মুমূর্ষু প্রসূতি মায়ের সিজারসহ বিভিন্ন প্রয়োজনের রোগীকে রক্ত দেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন তারা। এতে করে বাঁচানো যাচ্ছে অনেক জীবন।

জানা যায়, ২০১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বিক্রমপুর রক্তদান সংস্থা নামে সংগঠনটি কার্যক্রম শুরু করে। এতে এখন পযর্ন্ত ১হাজার ৯০০ বেশি ব্যাগ রক্ত স্বেচ্ছায় দান করেছেন। এছাড়া করোনাকালীন সময় থেকে এ পর্যন্ত তিনটি অক্সিজেন সিলিন্ডার দ্বারা বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা প্রদান, জেলার বিভিন্ন স্থানে ৩২ টি মেডিকেল ক্যাম্প বসিয়ে উল্লেখযোগ্য রক্তের গ্রুপ নির্ণয়, ডায়াবেটিস, ওজন, প্রেসার ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দিয়ে বিভিন্ন সেবা প্রদান, স্বেচ্ছাসেবীদের দক্ষ ও স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে তিনটি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা, সুনামগঞ্জের বন্যায় প্রায় লক্ষাধিকক টাকার ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে বানবাসীদের পাশে থাকা, প্রতিবছর হাসি ফুটুক সবার মুখে এই স্লোগানে ঈদ উপহার (সেমাই, চিনি, নুডুলস, দুধ ও পোলার চাল) বিতরণ, প্রতিবছর শীতার্তদের পাশে দাঁড়ানো, দারিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ (কলম ও খাতা) বিতরণ, বিভিন্ন দারিদ্র পরিবারের মেয়ের বিয়ে এবং অনেক দারিদ্র ব্যক্তিদের অসুস্থতায় পাশে থেকে সহযোগীতা করা, সচেতনতার বার্তা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে বিভিন্ন সময় মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ করা সহ ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানুষজনকে মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে সংগঠনটি।

গোবরদী গ্রামের বাসিন্দা সাদিয়া আক্তার বলেন, আমার সিজার হওয়ার সময় প্রচুর রক্তের প্রয়োজন হয়েছিল, তখন বিক্রমপুর রক্তদান সংস্থা থেকে রক্তের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, তাদের স্বেচ্ছাসেবীরা আমাকে রক্ত দিয়েছে। আমি অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই তাদের, তারা সব সময় মানুষের সুখে দুঃখে পাশে থাকতে পারে তাদের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।

আরেকজন হাজেরা বেগম বলেন, আমার শরীর আগুনে পুড়ে গেছিল,তখন অনেক রক্তের প্রয়োজন ছিল, সে সময় বিক্রমপুর রক্তদান সংস্থার স্বেচ্ছাসেবীরা কয়েক ব্যাগ রক্ত জোগাড় করে দিয়েছিল, এজন্য আমি সুস্থ হতে পেরেছি, তাই ওদের জন্য অনেক অনেক দোয়া ও ভালবাসা।

বিক্রমপুর রক্তদান সংস্থার সাধারণ সম্পাদক কেএম সবুজ আহমেদ বলেন, আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম মানুষের পাশে থেকে সেবা করবো এবং রক্তের অভাবে একটি প্রাণও যাতে ঝরে, সেই লক্ষে কাজ করবো। এই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে এসেছিল বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জ জেলার এক ঝাঁক মানবিক তরুণ-তরুণী। 

এই চিন্তাভাবনা থেকে এক ঝাঁক স্বপ্নবাজ তারুণ্য স্বপ্ন জয়ের নেশায় ২০১৯ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর আমরা প্রতিষ্ঠা করেছিলাম একটি অরাজনৈতিক, অলাভজনক ও শতভাগ সেবামূলক সংগঠন, যার নামকরণ করা হয়েছে বিক্রমপুর রক্তদান সংস্থা নামে একটি সংগঠন। যার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল (সেবা, ঐক্য ও শৃঙ্খলা) কে প্রাধান্য দিয়ে এ দেশ ও দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানো।

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে একটি মানবিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে আত্ম মানবতার সেবায় ব্রত নিয়ে কাজ করার মূল লক্ষ। সবার সহযোগীতায় কঠোর পরিশ্রম, আন্তরিকতা, মেধা ও স্বেচ্ছায় শ্রমের মাধ্যমেই আলহামদুলিল্লাহ ৪ বছর পেরিয়ে আমরা পঞ্চম বছরে পদার্পণ করেছি। আমাদের এই ৪ বছরের পথ চলায় হয় তো খুব বেশি ভূমিকা আমরা রাখতে পারিনি। তবে আমরা সব সময় চেষ্টা করেছি এ দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে পাশে থাকার। আমাদের এই পথ চলাকে সহজ ও মসৃণ করে তুলেছেন রক্তদাতা, স্বেচ্ছাসেবক, শুভাকাঙ্ক্ষী, প্রবাসী ভাইয়েরা। সবার অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে আমাদের এই পরিবার অনন্য এক মাত্রায় সক্ষম হয়েছি। আমাদের জন্য সবাই দোয়া এবং পাশে থাকবেন এই আশা রাখছি।

বিক্রমপুর রক্তদান সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি সয়ন শেখ বলেন, বিক্রমপুর রক্তদান সংস্থা প্রতিষ্ঠার মূল উদ্যোক্তা হলো রক্ত দিয়ে মানুষের প্রাণ বাঁচানো। আমাদের প্রাণের প্রিয় সংগঠন বিক্রমপুর রক্তদান সংস্থা আজ ৪ বছর পেরিয়ে ৫ বছরে পর্দাপণ করেছে। মানবতার শুধু ৪ নয়, ৪ যুগ নয়, যুগে যুগে কাজ করে যাবে আর্ত মানবতার সেবায়। আজকের এই দিনে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, যারা স্বেচ্ছায় রক্তদান করেছেন, যারা মোটিভেশনের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করে রক্তদাতা তৈরি করেছেন, স্বেচ্ছায় শ্রম, পরামর্শ, আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন এবং যাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা সেই দায়িত্ব সুন্দর, সুস্থভাবে পরিচালনা করেছেন তাদের সকলের প্রতি।  আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যারা মহৎ কাজে সময় দিচ্ছেন তাদের এই সময় গুলো বৃথা যাবে না। কারণ আল্লাহ পাক এই মহৎ কাজের জন্য অবশ্যই উত্তম প্রতিদান দিবেন।

তিনি আরো বলেন, বিক্রমপুর রক্তদান সংস্থা শুধু রক্তদানের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ নয়, দেশের ক্রান্তিলগ্নে ও কাজ করে যাচ্ছে, সামর্থ্য অনুযায়ী অসহায় মানুষগুলো পাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে প্রশিক্ষিত হয়ে দেশের হয়ে কাজ করার জন্য। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি প্রাণের সংগঠনের সেবা একদিন পুরো বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে ইনশাআল্লাহ। সবাই দোয়া করবেন, সবসময় পাশে থাকবেন সঠিক পরামর্শ দিয়ে আমরা আপনাদের দোয়া ভালোবাসা, সুপরামর্শ নিয়েই এগিয়ে যেতে চাই বহুদূর। আমরা ছিলাম, আমরা আছি, আমরা ভবিষ্যৎ ও থাকবো অসহায় মানুষগুলোর মুখে হাসি ফুটানোর জন্য ইনশাআল্লাহ।

সয়ন শেখ আরও বলেন, সংক্ষিপ্ত আয়ুর জীবনে তেমন কোনো সাফল্য নেই, তবে একটা সাফল্য আছে সেটা হলো বিক্রমপুর রক্তদান সংস্থাকে প্রতিষ্ঠা করা, এই সংগঠন থেকে দিন শেষে যদি একজন মানুষ ও উপকৃত হয়ে থাকে সেটাই বড় সাফল্য বলে মনে করছি। ইতিমধ্যে আমরা ১ হাজার ৯০০ বেশি ব্যাগ রক্ত অসহায় রেগীকে দিতে সক্ষম হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ।  ৩২ টি  মেডিক্যাল ক্যাম্পেইন করতে সক্ষম হয়েছি, দেশের বিভিন্ন বড় বড় দুর্যোগে আমরা কাজ করেছি, এটা ধারাবাহিকতা ভাবে অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ। 

সন্তোষপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ডা. দেবব্রত ঘোষ সমীর বলেন, বিক্রমপুর রক্তদান সংস্থা একটি মানবিক সংস্থা ও সংগঠন। বিগত ৪ বছর পেরিয়ে তারা পঞ্চম বছরে পদার্পণ করেছে। এর পঞ্চম বছর পূর্তি উপলক্ষে আমি তাদের সার্বিক উন্নয়ন কামনা করছি এবং এই সংগঠন যেন আরও ভালোভাবে সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারে সবার দিক থেকে মানবিক সহায়তা চাচ্ছি। এর কারণ হচ্ছে রক্তদান এরকম একটা জিনিস যে শুধু নিজেরাই না নিজেদের প্রয়োজনে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের প্রয়োজনে যখন রক্ত পেতে চায় তখন অনেকেই বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এটা মূলত একটা সচেতনতার অভাবের জন্য হয় এবং এই সচেতনতা তৈরি করার জন্য এই বিক্রমপুর রক্তদান সংস্থা মুন্সীগঞ্জের ৬টি উপজেলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এই দিক থেকে আমি বলব সবাইকেই সচেতনভাবে এ রক্তদান সংস্থার যে আন্দোলন বিনা রক্তে যেন কেউ মৃত্যু না হয়। এই আন্দোলনে সবাইকে আমি অংশীদার হতে বলবো এবং এই অংশীদারিত্বের মাধ্যমে রক্তদান সংস্থার জন্য আরও সামনের দিকে তাদের পরিধিটা বড় করতে পারে সে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সুমন মধু বলেন, বিক্রমপুর রক্তদান সংস্থার একটি অলাভজনক, অরাজনৈতিক এবং সামাজিক সংস্থা। পুরো পৃথিবীতে যখন করোনা মহামারীর প্রকট আকার ধারণ করে তার ক্রান্তিলগ্নে এই সংস্থাটির সূচনা শুরু হয়। এই সংস্থাটির সূচনার শুরু থেকে অসংখ্য ভালো কাজ, বিশেষ করে রক্তদান এবং বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এই সংস্থাটির এই সমস্ত স্বেচ্ছাসেবী ব্যক্তিবর্গ কে উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের পক্ষ থেকে শুভকামনা জানাই এবং আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। সংস্থাটি চতুর্থ বছর সাফল্যের সাথে অতিক্রম করে পঞ্চম বছরে পদার্পণ করেছে তার জন্য সকল স্বেচ্ছাসেবী কে আমার আন্তরিক অভিনন্দন রইল।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা.আঞ্জুমান আরা বলেন, এ উপজেলার কিছু তরুণ যারা আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসার জন্য বিক্রমপুর রক্তদান সংস্থা নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী মূলক সংগঠনকে দাঁড় করিয়েছিন এবং সেই ২০১৯ সাল থেকে তারা সিরাজদীখানসহ পাশাপাশি অনেক জেলায় রক্তদান কর্মসূচিসহ আরো অনেক জনসচেতন মূলক কর্মকান্ড, সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাথে তারা মানুষের আস্তার সাথে কাজ করে আসছেন। ভবিষ্যতে আর্তমানবতার সেবায় যেন তারা এভাবেই মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান, সেই প্রত্যয় ব্যক্ত করে আমি তাদের উত্তরোত্তর সফলতা কামনা করছি।

এআেএস