আধুনিক বিজ্ঞান ও পবিত্র মাহে রমজান

আমার সংবাদ ধর্ম ডেস্ক প্রকাশিত: মার্চ ৯, ২০২৪, ০৫:৩১ পিএম
আধুনিক বিজ্ঞান ও পবিত্র মাহে রমজান

মুসলমানদের ফরজ ইবাদতের মধ্যে অন্যতম হলো পবিত্র রমাদান। এই মাসটি প্রতিটি মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই মাসে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। এর ফজিলত সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসে বিশেষভাবে বলা হয়েছে।

মহান আল্লাহর কাছে রোজা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা হাদিসে কুদসিতে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রোজা আমার জন্য এবং আমি স্বয়ং এর প্রতিদান দেব।’ অন্য এক হাদিসে রাসুল (সা.) আরও এরশাদ করেছেন, যখন রমজান মাস আসে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়, আর শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়।’ এর থেকে আমরা বুঝতে পারি রোজা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। 

রোজা শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতেও রোজার উপকারিতা অপরিসীম। জীববিজ্ঞানের গবেষণার ফলে আমরা জানি, প্রতিটি প্রাণীর শরীর একটি উচ্চতর এবং সূক্ষ্ম জৈব রাসায়নিক কারখানা এবং এটিকে সচল রাখতে প্রয়োজন হয় শক্তি। রোজা নিয়ে বিস্ময়কর তথ্য দিয়ে নোবেল পেয়েছেন জাপানি গবেষক ও বিজ্ঞানী ওশিনরি ওসুমি।

তিনি ‘অটোফেজি’ নিয়ে গবেষণা করে ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কার জয় করেছেন। এক সাক্ষাৎকারে মুসলমানদের পবিত্র রোজা সম্পর্কে বিস্ময়কর তথ্য জানিয়েছেন তিনি বলেন, মুসলমানরা যাকে রোজা বলে, আমি তাকে বলি ‘অটোফেজি’। রোজার মাসে খাবার দাবারের ঝামেলা, তাই এই মাসটা আমি অটোফেজি করি।

অটোফেজি মানে নিজে নিজেকে খাওয়া। চিকিৎসা বিদ্যায় নিজের গোস্ত নিজেকে খেতে বলে না। শরীরের কোষগুলো বাহির থেকে কোনো খাবার না পেয়ে নিজেই যখন নিজের অসুস্থ কোষগুলো খেতে শুরু করে, তখন চিকিৎসা বিদ্যার ভাষায় তাকে অটোফেজি বলা হয়। আমাদের ঘরে যেমন বর্জ্য রাখার স্থান বা ডাস্টবিন থাকে তেমনি আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষের মাঝেও একটি করে ডাস্টবিন আছে। শরীরের কোষগুলো যদি নিয়মিত তাদের ডাস্টবিন পরিষ্কার করতে না পারে, তাহলে কোষগুলো একসময় নিষ্ক্রিদ্ধয় হয়ে শরীরে বিভিন্ন প্রকারের রোগের উৎপন্ন করে। ক্যানসার বা ডায়াবেটিসের মতো অনেক বড় বড় রোগের শুরু হয় মূলত এখান থেকেই।

দীর্ঘদিন ধরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করলে শরীরে তা অতিরিক্ত মেদ হিসেবে জমা হয় এবং প্রয়োজনের চেয়ে কম খাদ্য গ্রহণ করলে শরীরের স্বাভাবিক গঠন ভেঙে যেতে থাকে। যেহেতু মুসলিমদের দীর্ঘ একটি মাস রোজা রাখতে হয়, স্বাভাবিকভাবেই এতে ওজন কিছুটা হ্রাস হয়। তবে সাহরি ও ইফতার নামক সুন্দর ব্যবস্থার কারণে এই ওজন কমে যাওয়ার হার আশঙ্কাজনক পর্যায়ে হয় না। 

এছাড়া রোজা থাকা অবস্থায় কমপক্ষে ১৫ ঘণ্টা যাবতীয় খানাপিনা বন্ধ থাকে। এ সময় পাকস্থলী, অন্ত্র-নালি, যকৃৎ,  ‍হৃদপিণ্ডসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশ্রাম পায়। তখন এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিজেদের পুনর্গঠনে নিয়োজিত হতে পারে। অন্যদিকে দেহে যেসব চর্বি জমে শরীরের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় সেগুলো রোজার সময় দেহের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর জন্য ছুটে যায়। স্বাস্থ্য-বিজ্ঞানী তার ‘সুপিরিয়র নিউট্রিশন’ গ্রন্থে ডা. শেলটন বলেছেন, উপবাসকালে শরীরের মধ্যকার প্রোটিন, চর্বি, শর্করা জাতীয় পদার্থগুলো স্বয়ং পাচিত হয়। ফলে গুরুত্বপূর্ণ কোষগুলোর পুষ্টি বিধান হয়।

নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ঔষধ ও শল্য চিকিৎসার প্রখ্যাত ডা. অ্যালেকসিস বলেছেন, উপবাসের মাধ্যমে লিভার রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হয়। ফলে ত্বকের নিচে সঞ্চিত চর্বি, পেশির প্রোটিন, গ্রন্থিসমূহ এবং লিভারে কোষসমূহ আন্দোলিত হয়। অভ্যন্তরীণ দেহ যন্ত্রগুলোর সংরক্ষণ এবং  ‍হৃদপিণ্ডের নিরাপত্তার জন্য অন্য দেহাংশগুলোর বিক্রিয়া বন্ধ রাখে। খাদ্যাভাব কিংবা আরাম-আয়েশের জন্য মানুষের শরীরের যে ক্ষতি হয়, রোজা তা পূরণ করে দেয়। ডা. আইজাক জেনিংস বলেছেন, যারা আলস্য ও গোঁড়ামির কারণে এবং অতিভোজনের কারণে নিজেদের সংরক্ষিত জীবনী শক্তিকে ভারাক্রান্ত করে ধীরে ধীরে আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যায়, রোজা তাদের এ বিপদ থেকে রক্ষা করে।

বিশ্বখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী নাস্টবারনার বলেন, ‘ফুসফুসের কাশি, কঠিন কাশি, সর্দি এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা কয়েকদিনের রোজার কারণেই নিরাময় হয়।’

স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী ডা. আব্রাহাম জে হেনরি রোজা সম্পর্কে বলেছেন, ‘রোজা হলো পরমহিতৈষী ওষুধ বিশেষ। কারণ রোজা পালনের ফলে বাতরোগ, বহুমূত্র, অজীর্ণ, হৃদ্‌রোগ ও রক্তচাপজনিত ব্যাধিতে মানুষ কম আক্রান্ত হয়।’ অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, রোজাদার পেপটিক আলসারের রোগীরা রোজা রাখলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। হৃদ্‌রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও হাঁপানি রোগীদের জন্যও রোজা উপকারী। চিকিৎসকদের মতে, রোজার ফলে মস্তিষ্কের সেরিবেলাম ও লিমরিক সিস্টেমের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ার কারণে মনের অশান্তি ও দুশ্চিন্তা দূর হয়; যা উচ্চ রক্তচাপের জন্য মঙ্গলজনক। বহুমূত্র রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে রোজা খুব উপকারী। ডাক্তারি পরীক্ষায় দেখা গেছে, একাধারে ১৫ দিন রোজা রাখলে বহুমূত্র রোগের অত্যন্ত উপকার হয়।

জিফ্রস্ট ও এস পিরানি ১৯৮৭ সালে ১৫ জন সৌদি যুবকের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখেন, রমজান মাসে যদিও তাদের খাবার গ্রহণের বারের সংখ্যা কমে গেছে; অন্যদিকে শর্করা, প্রোটিন এবং চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। রোজার সময় যেহেতু পানি পান থেকেও বিরত থাকতে হয়, সেহেতু দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় পরে ঘাম, মল ও মূত্রের মাধ্যমে পানির পরিমাণ কমে যায়। এ অবস্থায় বিভিন্ন হরমোনের মাধ্যমে কিডনি রক্তে পানি ধরে রাখার চেষ্টা করে।

ক্যালরি রেস্ট্রিকশনের ওপর গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, দিনের গৃহীত ক্যালরির পরিমাণ কমিয়ে আনলে তা শারীরিক স্থায়িত্ব বাড়ায় এবং বেশকিছু জটিল অসুখের ফলে সৃষ্ট জটিলতা কমিয়ে আনে; যেমন রক্তনালিতে চর্বি জমে সৃষ্ট অ্যাথেরোসেক্লারোসিস, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ, কিডনি রোগ এবং নিউরোডিজেনারেটিভ রোগ। ২০১২ সালে ট্রাবেলসি এবং তার সহযোগীরা দুই ধরনের রোজাদারদের ওপর গবেষণা চালান। যাদের একদল ইফতারের ঠিক আগ মুহূর্তে অ্যারোবিক এক্সারসাইজ; যেমন সাইকেল চালানো ও সাঁতার কাটা অনুশীলন করেছেন এবং আরেক দল ইফতারের পর একই অনুশীলনগুলো করেছেন। তারা দেখেন, রোজা শেষে প্রথমোক্ত দলের শরীরের চর্বি কমলেও পরবর্তী দলে তা অপরিবর্তিত রয়েছে।

২০১৩ সালে ওই একই বিজ্ঞানীদের গ্রুপ তিউনিশিয়ান বডি-বিল্ডারদের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা যায়, রোজা শেষে তাদের বডি ফ্যাট ও লিন বডি ম্যাসে (চর্বিহীন শরীরের মূল ওজন) কোনো পরিবর্তন আসেনি। এর কারণ হিসেবে ধারণা করা হয়, বডি-বিল্ডিংয়ে শক্তির খরচ তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় এরকম হয়েছে। গবেষণাগুলো থেকে ধারণা করা হয়, রমজান মাসে ইফতার ও সাহরির সময় খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ওজন কমবে। যাদের বডি ম্যাস ইনডেক্স আদর্শ সীমা অতিক্রম করে গেছে, যা ২৪ ও তার বেশি, তারা রমজান মাসকে ওজন কমানোর জন্য একটি উত্তম সময় হিসেবে নিতে পারেন।

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, রোজা রাখলে কিডনিতে সঞ্চিত পাথর কণা ও চুন দূরীভূত হয়। এ ছাড়া স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মতে, সারা বছর অতিভোজ, অখাদ্য, কুখাদ্য, ভেজাল খাদ্য খাওয়ার ফলে আমাদের শরীরে যে জৈব বিষ জমা হয় তা দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এক মাস রোজা পালনের ফলে তা সহজেই দূরীভূত হয়ে যায়।

রমজান শুধু আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জনের জন্য উপকারী তা নয়, বরং বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। আসুন আমরা সব মুসলিম রোজা পালন করি এবং ইহজাগতিক ও পারলৌকিক মুক্তির পথ সহজ করি।

বিআরইউ