ঢাকার জলাভূমি ৩ শতাংশের নিচে

আব্দুল কাইয়ুম প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩, ০৪:৫৪ পিএম
ঢাকার জলাভূমি ৩ শতাংশের নিচে
  • ২৮ বছরে কমেছে ৭৩ দশমিক ৭১ শতাংশ
  • বর্তমানে রয়েছে ২ দশমিক ৯১ শতাংশ 
  • হিসাবে ব্যবহূত এলাকা ২০.৫৭ শতাংশ

জলাধার ভরাটের ক্ষেত্রে বেসরকারি কোম্পানির পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানেরও দায় রয়েছে 
—ড. আদিল মুহাম্মদ খান, সভাপতি, বিআইপি

রাজধানী ঢাকার অপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থার কারণে প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে জলাধারা। এতে করে যেমন তৈরি হচ্ছে পানির সংকট তেমনি হুমকির মধ্যে পড়ছে পরিবেশ। গাবতলিতে একটি জলাশয় ভরাট করে সেখানে অবকাঠামো তৈরি করছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)। সেখানে কল্যাণপুর ইকোপার্ক নির্মাণ করার পরিকল্পনা করেছে, যা বিএডিসির সাথে সরাসরি সংঘর্ষিক হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বর্তমান ভবনটিও জলাশয় ভরাট করে গড়ে তোলা। কুড়িলে রেলওয়ের মালিকানাধীন জলাধার ভরাট করে অবকাঠামো তৈরির সুযোগ দেয়া হয়েছে মিলেনিয়াম হোল্ডিং নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ হাতিরঝিলের কিছু অংশ ভরাট করেছে। যা ড্যাপ (২০২২-৩৫) অনুযায়ী হাতিরঝিল সংরক্ষিত জলাভূমি ও এর ভরাটকরণ আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ আশকোনায় জলাধার ভরাট করে আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এগুলো ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জলাভূমি ভরাটের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। 

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল?্যানার্সের (বিআইপি) এক গবেষণার যায়, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের এলাকায় ১৯৯৫ সালে জলাধার ও জলাভূমি ছিল ২০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। তবে ২০০৫ সালে সেটি অনেকটাই কমে দাঁড়িছে ৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশে। ২০১৫ সালে এটি আরো কমে হয়ে যায় ৩ দশমিক ২১ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে ২ দশমিক ৯১ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। গবেষণায় রাজধানীর সবুজ এলাকার তথ্যে দেখা যায়, ১৯৯৫ সালে ঢাবাতে সবুজ এলাকা ছিল ২০ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। যা ২০০৫ সালে কমে ১৫ দশমিক ৮৭ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০১৫ সালে সেটি দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ১৮ শতাংশ। তবে ২০২৩ সালে এটি আরও কমে ৯ দশমিক ১২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯৫ সালে ফাঁকা জায়গা ছিল ১৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আর ২০২৩ সালে হয়েছে ১০ দশমিক ৯৯ শতাংশ। তাদের অন্য এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০০১ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ঢাকার জনসংখ্যা ৭৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ৪০০ বছরের আগের ঢাকা শহরটি অধিক সবুজ পার্ক, গাছ, খোলা জায়গা, ফসলের ক্ষেত এবং জলাধার, পুকুর, খাল ও নদীসমৃদ্ধ একটি শহর ছিল। দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং ভূমি অধিগ্রহণের ফলে সবুজ অঞ্চল এবং নীল স্থানের পরিমাণ মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এই জলাধারের কমতি ঢাকার বন্যা ও জলাবদ্ধতার সংকটের প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। একই সাথে এই মহানগরের প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রতিনিয়ত কমিয়ে দিয়ে এর বিপদাপন্নতা বাড়িয়ে তুলছে।

কেন্দ্রীয় নগর এলাকা তথা মূল ঢাকা মহানগরের কেন্দ্রীয় এলাকায় নীল এবং সবুজ অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি সাধিত হয়েছে। ১৯৯৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে নির্মিত এলাকাগুলোর দ্রুততম বিকাশ ঘটেছে। সর্বাধিক পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে, জলাধার হিসেবে ব্যবহূত এলাকাগুলো। ১৯৯৫ সালে জলাধার হিসেবে ব্যবহূত হতো ৩০ দশমিক ২৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা, যা ছিল মোট এলাকার ২০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এটি ২০২৩ সালে ৪ দশমিক ২৮ বর্গকিলোমিটারে পৌঁছেছে, যা মোট এলাকার মাত্র ২ দশমিক ৯১ শতাংশে। ১৯৯৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ঢাকার ভূমি ব্যবহারের মৌলিক পরিবর্তন করা হয়েছে। জলাধার থেকে নির্মিত এলাকায় পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে তা কেন্দ্রীয় ঢাকা এলাকার প্রায় ২৮ দশমিক ৫৯ বর্গকিলোমিটার এবং কেন্দ্রীয় নগর অঞ্চলের প্রায় ১৭ দশমিক ২১ বর্গকিলোমিটার পরিবর্তন করা হয়েছে। এরূপ পরিবর্তন ঢাকাকে বসবাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে। জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ এ বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক জলাধার অর্থ নদী, খাল, বিল, দীঘি, ঝর্ণা বা জলাশয় হিসেবে মাস্টার প্লানে চিহ্নিত বা সরকার, স্থানীয় সরকার বা কোনো সংস্থা কর্তৃক, সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা বন্যা প্রবাহ এলাকা হিসেবে ঘোষিত কোনো জায়গা এবং পানি এবং বৃষ্টির পানি ধারণ করে এমন কোনো ভূমিও অন্তর্ভুক্ত হবে। জলাধার, জলাভূমি, ও সবুজ অঞ্চলের অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে নানাবিধ আইনগত বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে এর বাস্তবায়ন বা রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথ না হওয়ায় প্রতিনিয়ত এ সব এলাকা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবির) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিএডিসি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। আদালতের নির্দেশ অমান্য করে সংস্থাটি ড্যাপের চিহ্নিত জলাধার ভরাট করছে। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার আছে রাজউকের। একই সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে পারে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। এই দুই সংস্থা এখনো বিএডিসিকে আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। সেটি না করলে আমরা বুঝব রাজউক ও ডিএনসিসি অনিয়মের অংশীদার হয়েছে। 

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ও নগরবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, প্রতিনিয়ত যে জলাধার ভরাট হচ্ছে। এসব কিছুর জন্য আমরা সবসময় বেসরকারি আবাসিক কোম্পানিগুলোকে দায়ী করি। এর পেছনে যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোরও দায় আছে, সেটি অনেকটা উপেক্ষিত। সরকার জলাধার সংরক্ষণে আইন করেছে, কিন্তু সেটি বাস্তবায়নে দৃশ্যমান ভূমিকা রাখছে না। রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত, উজাড় হওয়া জলাধারগুলোকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নেয়া। ঢাকা বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। এখানে মানুষের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তারা সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার হারাচ্ছে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডগুলোর কারণে। পরামর্শ দিলে সরকার যে শুনবে, সে বিশ্বাস এখন আর নেই। এখন আমাদের প্রতিবাদ জানানো উচিত, এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।