Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

নিরাপদ খাদ্য সুস্থ জীবনের নিশ্চয়তা

মুহাম্মদ মিজানুর রহমান

অক্টোবর ৬, ২০২১, ১২:৩০ পিএম


নিরাপদ খাদ্য সুস্থ জীবনের নিশ্চয়তা

মানুষ খাদ্য গ্রহণ করে বাঁচার জন্য। নিরাপদ থাকার জন্য। যেসব খাবার খাচ্ছি তার সবই কি নিরাপদ? আসলে ভেজালের এই সময়ে সব খাবারই কিন্তু মানব স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়। তাহলে প্রশ্ন জীবন কীভাবে নিরাপদ থাকবে? কীভাবে মানুষ রোগমুক্ত থাকবে? যদি মানুষ সুষম, ভেজালমুক্ত, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার খেতে পারে তাহলে সে নিরাপদ জীবনের কথা ভাবতে পারে। এ ধরণের খাবার একজন মানুষকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম। এ কারণে মানুষ প্রতিদিন কী খাচ্ছি, যা খাচ্ছে তা বিষমুক্ত কি না ভাবতে হয় তাকে। যদি খাবারে ভেজালের সংমিশ্রণ ঘটে তাহলে তারা নিজেদের বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।   

বর্তমানে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারপরেও মানুষ প্রতিদিন যা খাচ্ছে তার সবটাই ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর না হলেও এর মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। সবটা যে নিরাপদ তা বলা যাচ্ছে না। কারণ বেশির ভাগ খাদ্য নিম্নমানের। ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর বিশ্ব ব্যাংক কর্তৃক পরিচালিত ‘বাংলাদেশের পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন, স্বাস্থ্য ও দারিদ্র্যের বিশ্লেষণ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়, উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বিভিন্ন উপায়ে সরবরাহ করা খাবার পানির ৪১ শতাংশ এর মধ্যে ডায়রিয়ার জীবাণু রয়েছে। পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহকৃত ৮০ শতাংশ পানিতে আছে ক্ষতিকর জীবাণু। 

অন্যদিকে শহরাঞ্চলে পাইপলাইনে সরবরাহ করা ট্যাপের ৮০ শতাংশ পানিতে ক্ষতিকর জীবাণু ই-কোলাই পাওয়া গিয়েছে। ঐ প্রতিবেদন আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়,‘পানির দূষণ ও নিম্নমান’ অনেক অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। কাজেই এই দূষিত ও মানহীন পানি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত খাদ্য সামগ্রীও দূষিত। আর সেই দূষিত খাবার মানুষ প্রতিদিন গ্রহণ করছে। সরকার এই ভেজাল, অনিরাপদ খাদ্য ও দূষিত পানির পরিবর্তে বিশুদ্ধ খাদ্য ও পানীয় নিশ্চিত করতে নানামুখী পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। বিশেষ করে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ যারা আজকের এই অনুষ্ঠানের আয়োজক তারাও সরকারের এই মহতী ও সাহসী পদক্ষেপকে বাস্তবায়নের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। 

র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত, জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়মিত টহল কার্যক্রম অব্যাহত রাখছে। তবুও তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য প্রয়োজন মানুষের সচেতনতা। কারণ স্বাস্থ্য সচেতনতা ছাড়া কখনোই এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। এজন্য মাটি, পানি ও ফসলকে বিষমুক্ত রাখার প্রযুক্তি ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করে এর সঠিক প্রয়োগ দরকার। 

বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এ দেশ। এ দেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। উচ্চফলনশীল নতুন নতুন জাতের ধান আবিষ্কার হয়েছে। অধিক ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে মানুষ জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছি। যদি এই রাসায়নিক স্যারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহার করা হতো তাহলে এই বিপর্যয়ের হাত থেকে জনস্বাস্থ্য রক্ষা পেত। ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি তাদের এক গবেষণায় দেখিয়েছে কৃষি পণ্যের মধ্যে ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, সিসা ও আর্সেনিকের অস্তিত্ব মিলেছে। তারা বলছেন- ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, সিসা ও আর্সেনিক মানুষের শরীরে একবার প্রবেশ করলে তা আর বের হয় না। 

এগুলো দীর্ঘমেয়াদে লিভার, কিডনি ও মস্তিষ্ককে ক্ষতি করে। ক্যান্সারসহ নানাধরনের রোগের উৎস এসব রাসায়নিক দ্রব্য। এগুলো মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। যদিও মানবদেহের জন্য ক্রোমিয়ামের সহনীয় মাত্রা ১ পিপিএম। কিন্তু জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের গবেষণায় চালে যে ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে তার মাত্রা ৩.৪১৪ পিপিএম পর্যন্ত। ক্যাডমিয়ামের সহনীয় মাত্রা ০.১ পিপিএম হলেও গবেষণায় তা মাত্রা মিলেছে ৩.২৩৯৫ পিপিএম পর্যন্ত। সিসার সহনীয় মাত্রা ০.২ পিপিএম। কিন্তু পাওয়া গেছে ১.৮৭ পিপিএম পর্যন্ত।  

চালে ক্যাডমিয়ামের এই বিপদজনক মাত্রার যোগ হয়েছে জমিতে নিম্নমানের টিএসপি সার প্রয়োগ, গার্মেন্টস শিল্প, ওষুধ কারখানা, টেক্সটাইল ও ট্যানারির অপরিশোধিত বর্জ্য থেকে। পরিবেশ দূষণ ও কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ক্ষতিকর পরিণতি কমবেশি সবাইকেই ভোগ করতে হচ্ছে। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিতে শিশুরা। এসব রাসায়নিক সার প্রয়োগের সময় সঠিক মান ও প্রয়োগবিধি বজায় না রেখে ব্যবহারের ফলে উৎপাদিত ফসল, মাছ, পানি ও জমি বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। আর এই বিষ মানুষের শরীরে সহজেই প্রবেশ করছে। মাটি ও পানিতে এমনভাবে রাসায়নিক দূষণ হচ্ছে যা খাদ্যচক্র হয়ে মানবদেহে প্রবেশ করে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করছে। মানুষ নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। 

যে খাদ্য আমরা জীবন বাঁচানোর জন্য খেয়ে থাকি তা যদি রোগাক্রান্ত হওয়ার কারণ হয়, তাহলে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা কোথায়। তাই সময় এসেছে এই নীরব ঘাতকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। নিজেদের স্বাস্থ্য সচেতন হবার। বিষাক্ত কীটনাশক ও অতিরিক্ত সারের ব্যবহার বন্ধ করার পাশাপাশি কারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। মানুষকে সচেতন করতে হবে। যারা এই বিষযুক্ত খাদ্য উৎপাদনের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠিন আইনি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যেসব কৃষক অতিরিক্ত রাসায়নিক সার প্রয়োগের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত নয়, তাদের জন্য প্রয়োজনে কৃষি প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে। 

এছাড়া অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যারা মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী উৎপাদন করে থাকে তারা খাদ্যে কোনো ধরণের ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করলে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে হবে। কারণ অনিরাপদ খাদ্য মানব হত্যার শামিল। তাই খাদ্যে ভেজাল, অনিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও বিন্ধি বন্ধে প্রশাসন, উৎপাদনকারী, বিক্রেতা ও মজুদকারীকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তা না হলে ভেজাল, অনিরাপদ খাদ্য খেয়ে মানুষ নানারকম প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হবে। যার শেষ পরিণতি মৃত্যু। 

যদিও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, র‌্যাব, বিএসটিআই সহ সরকারে অন্যান্য তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ভেজাল ও বিষযুক্ত খাদ্য উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে জেল জরিমানা করছে। এই কার্যক্রমে আরো গতিশীলতা আনার জন্য জনবল বাড়িয়ে বৃহৎ পরিসরে কাজ করতে হবে। তাহলে মানুষও স্বাস্থ্যসচেতন হয়ে উঠবে। এই গোপন শত্রু হাজারো সুস্থ মানুষের জীবনকে অসুস্থ করে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিতে পারবে না। 

তাই সম্ভাব্য সব বিষযুক্ত খাবারকে এড়িয়ে চলতে হবে। এতে এর উৎপাদকারীরা নিরুৎসাহিত হবে। খাবার মেন্যূতে এমন সব খাবার নির্বাচন করতে হবে যা বিষমুক্ত হবার ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিত। তাই নিজ বাসা বাড়ির আঙ্গিনায় বা ছাদে ফলফলাদি ও শবজির চাষ করতে হবে। বাজারে যেসব সিজিনোল বিষমুক্ত ফল যেমন বাতাবি, কলা, আমড়া, পেঁপে, লেবু, মাল্টা, আমলকি, গাজর, লাউ, মিষ্টি কুমড়া সহ নানা ফলমূল ও শাকসবজি পাওয়া যায় তা বেশি বেশি খেতে হবে।  যথাসম্ভব ফাস্টফুড ও প্রক্রিয়াজাত সব ধরণের খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।   

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক