ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
জুলাই ১৭, ২০২০, ০৭:৪৫ পিএম
ঘাম শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি। গরমে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তা স্বাভাবিক রাখতে ঘাম হয়। এ ছাড়াও ঘামের সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ বেরিয়ে যায়। গরমের দিনে ঘাম হওয়া অতি সাধারণ একটি বিষয়। তবে অনেক রোগী আছে যে তাদের সারা বছর ঘামের সমস্যা ভুগেন, আজ ঘামের সমস্যা নিয়ে কলাম লিখেছেন দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য সম্পাদক, ও বাংলাদেশের বিশিষ্ট হোমিও গবেষক, ডা. এম এ মাজেদ।
তিনি তার কলামে লিখেন— গরমে বা খাটাখাটনিতে শরীরে ঘাম হয়, এটাই স্বাভাবিক। ঘাম শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। সাধারণত ব্যায়াম, গরম আবহাওয়া, ভয় বা রাগের কারণে শরীর ঘামার প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে, আর কিডনি আমাদের শরীরে ছাঁকনির কাজ করে— এ কথা সবারই জানা।
শরীরের যাবতীয় দূষিত পদার্থ কিডনির ছাঁকনিতে ছেঁকে নিয়ে বাইরে বের করে দেয়া হয়। ভাবছেন, ঘামের সঙ্গে কিডনির সম্পর্ক কী! নিকট একটা সম্পর্ক তো আছেই। কেননা ঘামের সঙ্গে শরীরের অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিস বাইরে বেরিয়ে আসে। ঘাম কিন্তু শুধু ঘাম নয়! ডাক্তারি পরিভাষায় ঘামের প্রকার ভেদ আছে।
ঘাম দুই প্রকার। *এক্রিন ঘাম *এপোক্রিন ঘাম। কায়িক পরিশ্রম করলে বা বাইরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে শরিরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে এক্রিন গ্রন্থি ঘাম নিঃসরণ শুরু করে। আর এটাই ডাক্তারি ভাষায় এক্রিন ঘাম। একজন পূর্ণ বয়ষ্ক মানুষের শরীরে ২০ থেকে ৪০ লক্ষ এক্রিন গ্রন্থি থাকে।
আর এপোক্রিন গ্রন্থি থকেবগলে এবং যৌনাঙ্গের চারপাশে। বয়ঃসন্ধি কালের সময় থেকে এই গ্রন্থি থেকে ঘাম নিঃসরণ শুরু হয় । শরীরে ভিন্ন ভিন্ন গন্ধ সৃষ্টির পেছনে এই গ্রন্থিই দায়ী । এই গ্রন্থির ঘাম ত্বকের ওপর আসা পর্ন্ত ঠিক থাকে, যখনই জীবাণুর সাথে যুদ্ধ শুরু হয় তখনই গন্ধের উৎপত্তি হয়। তা ছাড়া মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, স্থূলতা, শরীরে পুষ্টির অভাবসহ নানান কারণে শরীর অতিরিক্ত পরিমাণে ঘামতে পারে।
পাশাপাশি ডায়াবেটিস, জ্বর, হূদযন্ত্রের সমস্যা, মেনোপজ ও লিউকোমিয়া ইত্যাদি কারণেও শরীর বেশি ঘাম হতে পারে। অতিরিক্ত ঘাম শরীরের বিভিন্ন জায়গা যেমন হাতের তালু, পায়ের নিচে, বগল, গলা, কপাল, এমনকি মাথার ত্বকেও ক্ষতিকর, অতিরিক্ত ঘাম মানুষের সঙ্গী।
ভিড় বাস, ট্রেন এবং মেট্রোর ভিড়ে একে অপরের ঘামের গন্ধে মানুষ নাজেহাল। অনেকের পায়ের ঘামের দুর্গন্ধে তাদের মোজা খোলা দায়। অতিরিক্ত ঘামে শিশুরাও নাজেহাল। ঘামের জন্য শিশুদের বিভিন্ন অসুখের কবলে পড়তে হয়। শরীরের অস্বাভাবিকভাবে বেরিয়ে যাওয়া ঘামকে হাইপারহাইড্রোসিস বলা হয়।
অনেকসময় শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য অতিরিক্ত ঘাম নির্গত হয়। হাইপারহাইড্রোসিস মানসিক এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনের মানকে নষ্ট করে দিতে পারে। হাইপারহাইড্রোসিস মানুষকে নীরব প্রতিবন্ধী করে তোলে।
প্রকারভেদ : * প্রাইমারি বা ফোকাল হাইপারহাইড্রোসিস হাত, পা, বগল, কুঁচকি এবং মুখে অতিরিক্ত ঘর্মগ্রন্থি থাকে। তাই এসব জায়গায় বেশি ঘাম হয়। কোনো কারণবশত এসব জায়গায় অত্যধিক ঘাম হলে একে প্রাইমারি বা ফোকাল হাইপারহাইড্রোসিস বলে। কারণ, কী কারণে হয় তা আজও অজানা।
কিন্তু অনেকে মনে করেন এটি সহানুভূতিশীল স্নায়ুতন্ত্রের অতিরিক্ত কার্যকলাপের কারণে ঘটে। কিছু কিছু রোগী ঘামের কারণে নার্ভাস হয়ে যায় এবং এই নার্ভাসনেসই তাদের ঘামের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
* সেকেন্ডারি হাইপারহাইড্রোসিস : কোনো রোগের কারণে মানুষের শরীরে অতিরিক্ত ঘাম হওয়াকে বলে সেকেন্ডারি হাইপারহাইড্রোসিস।
কারণ : সাধারণভাবে কোনো রাগ আমাদের শরীরের মধ্যে থাকলে এটি দখা যায়। যেমন— বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার, লিম্পোমা, ফ্রিওত্রোমোসাইটোমা, কারসিনয়েড টিউমার ইত্যাদি।
* এন্ডোক্রিন— ডায়বেটিস, বিশেষ করে যখন রোগীর ব্লাড সুগার কমে যায়, হাইপারপিটুইটারিজম, হাইপারথাইরয়ডিজম।
* ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যারা নিয়মিত এবং বহুদিন যাবৎ কিছু ওষুধ সেবন করেন যেমন— সেরোটনিন ইনহিবিটারস, অ্যান্টি ডিপ্রেসিভ ড্রাগস, ইনসুলিন, অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি ড্রাগস ইত্যাদি।
* অন্যান্য কারণ, স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি, পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি, পারকিনসনস, কনজেসটিভ হার্ট ফেলিওর, মেনোপজ, ওবেসিটি ইত্যাদি। অতিরিক্ত ঘামের ফলে যে সমস্যাগুলো দেখা যায়। * হাইপারহাইড্রোসিসের ফলে হাত, পা ঠান্ডা হয়ে ডিহাইড্রেশন হতে পারে।
* ত্বকে সংক্রমণ দেখা দিতে পারে।
* যাঁদের হাতের তলায় বেশি ঘাম হয় তারা হাত দিয়ে বেশি কাজকর্ম করতে পারেন না। বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের পেন ধরে লিখতে গিয়ে খুব অসুবিধা হয়। এমনকি অতিরিক্ত ঘামের কারণে তাদের উত্তরপত্র ভিজে যায়।
* অতিরিক্ত ঘামের জন্য অনেকে হ্যান্ডসেক করতে পারেন না।
* অতিরিক্ত ঘামের ফলে অনেকের শরীরে দুর্গন্ধ হতে পারে। ফলে তারা হীনম্মন্যতায় ভোগেন।
* ঘামজনিত কারণে পায়ে দুর্গন্ধ হয় বলে অনেকে সবার সামনে জুতো খুলতে পারে না।
* অতিরিক্ত ঘামের কারণে অনেকের জামাকাপড়ে ঘামের দাগ হয়ে যায়।* বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ঘাম বসে গিয়ে ঘন ঘন সর্দি, কাশি জ্বর হতে পারে।
ঘরোয়া পরামর্শ : * ভিটামিন বি-১২র অভাবে এই রোগ হয়। তাই ভিটামিন বি-১২ যেসব খাদ্যে বেশি
পরিমাণে পাওয়া যায় সেসব খাদ্য গ্রহণ করুন। যেমন— কলা, ডিম, দুধ, গাজর, টমেটো, সবুজ শাক, মাছ, কাঠ বাদাম ইত্যাদি।
* ভিটামিন বি পরিবার যেমন, বি-১, বি-২, বি-৩, বি-৫যুক্ত খাদ্য। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শে ভিটামিন বি ট্যাবলেট গ্রহণ করুন।
*বেশি করে পাকা ফলমূল ও শাকসবজি খাবেন। পাকা পেঁপে, তরমুজ, আম, কামরাঙ্গা, ফুলকপি, গাজর, বরবটি খুব উপকারী।
* শারীরিক দুর্বলতা থেকে এটি হয়ে থাকে। তাই পুষ্টিকর খাবার, শাকসবজি, ফলমূল বেশি পরিমাণে খান।
*আয়োডিনযুক্ত খাবার যেমন— এসপারাগাস, ব্রকোলি, টারকি, গরুর মাংস, যকৃত, সাদা পেঁয়াজ, খাবার লবণ প্রভৃতি থেকে এটি হয়ে থাকে। তাই এগুলো খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
* চায়ের মধ্যকার টনিক এসিড প্রাকৃতিক ঘামবিরোধী ওষুধ হিসেবে কাজ করে। তাই দেড় লিটার পানির মধ্যে পাঁচটি চায়ের ব্যাগ মিশিয়ে সেটার মধ্যে ১০-১৫ মিনিট হাত-পা ভিজিয়ে রাখুন। তা ছাড়া সবুজ চা পান করুন, এতেও উপকার পাবেন।
* হাতে-পায়ে কোনো ধরনের পাউডার ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। কারণ এটি ঘাম দূর করার পরিবর্তে আরো বাড়িয়ে দেবে।
* পান, ক্যাফেইনযুক্ত কফি, ধূমপান প্রভৃতি থেকে বিরত থাকুন কারণ এগুলো অতিরিক্ত ঘাম উৎপন্ন করে।
* বেশি বেশি পানি পান করুন। পানি দিয়ে মুখ, হাত, পা বারবার ধুয়ে ফেলুন। * শশা লবণ না মেখে খাবেন এতে আপনার শরীরে পর্যাপ্ত পানি থাকবে এবং ঘাম কমে যাবে।
ব্যায়াম : ঘামের কারণে অনেকেই ব্যায়াম করতে ভয় পান। নিয়মিত ব্যায়াম করলে শরীর ঝরঝরে থাকে। সামান্য হাঁটাচলা করে বা বাসার কাজ করার মধ্য দিয়েও ব্যায়াম করা যায়। তাই বসে না থেকে ছোট ছোট কাজ নিজেই করে ফেলুন। প্রচুর পানি খান। সম্ভব হলে পাতলা সুতির জামা পরার চেষ্টা করুন।
হাতের তালুর ঘাম নিয়ে কিছু কথা ও পরামর্শ : হাতের তালু ঘাম নিয়ে কারো সঙ্গে হাত মেলাতে গেলে, টাইপ করার সময় বা বিভিন্ন কাজে অনেকেরই হাত ঘামার সমস্যা আছে। বারবার হাতের তালু ঘেমে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে কাজ করতেও সমস্যা হয়।
বেকিং সোডা ও বেবি পাউডার : হাতের তালুতে ঘাম হওয়া কমাতে বেকিং সোডা ও বেবি পাউডার বেশ কার্যকর। এ ক্ষেত্রে কুসুম গরম পানিতে বেকিং সোডা মিশিয়ে ১০ মিনিট হাত ভিজিয়ে রাখতে হবে। বেকিং সোডার ক্ষারীয় উপাদান তালুর ঘাম নিয়ন্ত্রণ করে হাত শুষ্ক রাখতে সাহায্য করে। পাশাপাশি বেবি পাউডার দুর্গন্ধ দূর করতে কাজ করে।
টমেটোর রস : টমেটোর রস ত্বকের জন্য বেশ উপকারী। এটি ঘাম নিয়ন্ত্রণ করে আর ত্বক পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। প্রতিদিন একবার টমেটোর রস পান করুন। এক সপ্তাহ পর খেয়াল করবেন তালুতে ঘাম হওয়া কমে গেছে।
সাধারণত খনিজ বা ভিটামিনের ঘাটতি থাকলে ঘাম বেশি হয়। আর টমেটোতে আছে পটাশিয়াম ও ম্যাগনিসিয়ামের মতো খনিজ উপাদান। তাই নিয়মিত টমেটোর রস পান করলে হাতের তালু থাকবে সতেজ ও শুষ্ক।
জিঙ্ক : জিঙ্ক গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ যা স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। তাছাড়া ঘাম এবং দুর্গন্ধ রোধ করতে জিঙ্ক বেশ কার্যকার। এক্ষেত্রে সহায়ক খাবার হিসেবে ডাক্তারের পরামর্শে দিনে ৩০ থেকে ৫০ মিলিগ্রাম জিঙ্ক ট্যাবলেট খেতে পারেন।
অথবা প্রতিদিন সকালে জিঙ্ক অক্সাইড পাউডার হাতের তালু ঘষলেও উপকার পাওয়া যাবে। পাশাপাশি কপার সমৃদ্ধ খাবার খেতে ভুললে চলবে না কারণ জিঙ্ক শরীরে কপারের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
রাজমেরি : রোজমেরি একটি ভেষজ উপাদান। যা স্নায়ুতন্ত্রের উপর কার্যকর?ভাবে প্রভাব ফেলে। আর স্নায়ুতন্ত্র নিয়ন্ত্রণে থাকলে ঘামের পরিমাণও কম হয়।
তাছাড়া রোজমেরি হালকা সেডাটিভ হিসেবেও পরিচিত। সাধারণত উত্তেজিত হলেই ঘাম বেশি হয়। তাই ঘামের সমস্যা কমাতে শান্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে।
সাধারণত অ্যারোমাথেরাপির তেল, মোমবাতি, শ্যাম্পু ইত্যাদি পণ্যে রোজমেরি ব্যবহার করা হয়। রোজমেরি ইসেনশল অয়েল সঙ্গে রাখতে পারেন, হাত ঘামা শুরু হলেই এই তেলের গন্ধ নিন, কাজে দেবে।
হোমিও প্রতিবিধান : রোগ নয়, রোগীকে চিকিৎসা করা হয়, তাই একজন দক্ষ হোমিওপ্যাথ ঘামের প্রকৃতি, সময়, পরিমাণ, স্থান, গন্ধ প্রভৃতি বিবেচনা করে সঠিক লক্ষণ নির্বাচন করতে পারলে তাহলে হোমিওপ্যাথিতে ঘামের চিকিৎসা দেয়া আল্লাহর রহমতে সম্ভব, তাই অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা প্রাথমিকভাবে যেসব ওষুধ নির্বাচন করে থাকে, সালফার, সাইলেসিয়া, এসিড নাইট, ক্যালকেরিয়া কার্ব, এসিড ল্যাকটিক, ভেরেট্রাম এলব, স্যানিকুলা, বোভিস্টা, সোরিনাম, কোনিয়াম, থুজা, স্যাম্বুকাস, মেডোরিনামসহ আরো অনেক মেডিসিন লক্ষণের উপর আসতে পারে, তাই অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ নিজে নিজে ব্যবহার করলে সমস্যা আরো জটিল আকারে পৌঁছতে পারে।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য, স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা, হিউম্যান রাইটস রিভিউ সোসাইটি কেন্দ্রীয় কমিটি পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সম্পাদক, সবুজ আন্দোলন কার্যনির্বাহী পরিষদ।
আমারসংবাদ/এআই