ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
অক্টোবর ১৬, ২০২০, ১০:৪১ পিএম
শুচিবায়ু বলতে সাধারণভাবে আমরা বুঝি, খুব বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বা অনেক সময় নিয়ে গোছল করা। কিন্তু শুচিবায়ুর আরো কয়েকটি লক্ষণ রয়েছে। যেমন— একটি বিষয় নিয়ে ক্রমাগত দুশ্চিন্তা হতে থাকা এবং কোনোভাবেই সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা।
এর জন্য সে অতিরিক্ত কিছু কাজ করে থাকে। বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুতে থাকে এবং খেয়াল করে দেখে যে পরিষ্কার হলো কি-না। একই জিনিস বারবার গণনা করা। এ সব কাজকে অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় বুঝতে পারলেও সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি নিজেকে বিরত রাখতে পারেন না। ছোটকালে আমরা দুষ্টামি করে পাগলের ছন্দ বলতাম এভাবে—
‘হাত-পা লম্বা , মাথা গোল পাগল’। কোনো এক সাধু বাবা বলেছিলেন— দুনিয়ার সবাই নাকি পাগল? কেউ ‘ভাবের’ পাগল , কেউ ‘অভাবের’ পাগল অথবা কেউ ‘স্বভাবের’ পাগল। কিন্তু রোগ বিশ্লেষণে সবাইকে পাগল বলা অযৌক্তিক। অনেক ক্ষেত্রে মাইনর কিছু মানসিক রোগ সবার মধ্যেই আছে এবং এটা সবাই মেনে নিতেও প্রস্তুত। কারণ এই পাগলামির জন্য পাগলা গারদে যেতে হয় না।
সেই রকম রোগ হলো শুচিবায়ু বা ‘অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার’ এই রোগে মানুষ একটা অপ্রয়োজনীয় কিছু নিয়ে শুধু চিন্তা করে এবং তার রিঅ্যাকশন দেখায় কাজের মাধ্যমে। মানসিক রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম সমস্যা হলো সুচিবাই রোগ। আমাদের দেশে লাখ লাখ মানুষ এ রোগে ভুগছেন। এ রোগে তাদের ও অন্যদের পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত জীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। শুচিবায়ু যাকে বলা হচ্ছে— অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার বা ওসিডি।
এই রোগ চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়ে আজকের কলাম লিখেছেন, বাংলাদেশর বিশিষ্ট হোমিও গবেষক ডা.এম এ মাজেদ বলেন...সারা বিশ্বে গড়ে ২ শতাংশ মানুষের এই রোগ আছে তার মানে সাড়া পৃথিবীতে ১৭ কোটি মানুষ এই রোগে ভুগছেন, বাংলাদেশের ১৮.৪ শতাংশ শিশু বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এর মধ্যে ১.৩ শতাংশ হলো শুচিবায়ু বা ওসিডি।
শুচিবায়ু একটি মানসিক সমস্যা। সাধারণত এই সমস্যা ২৫ বছর বয়সের মধ্যেই শুরু হয়। অনেকের ক্ষেত্রে শৈশব, কৈশোর কিংবা যৌবনের শুরুতেও সমস্যার সূত্রপাত হতে পারে। ওসিডি এমন এক ধরনের মানসিক সমস্যা, যার ফলে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির মাঝে কাজের পুনরাবৃত্তি, অবাঞ্ছিত চিন্তাভাবনা, ধারণা বা অনুভূতি তৈরি হয়, যা তাদের পুনরাবৃত্তিমূলক কিছু করতে চালিত করে। এ ধরনের রোগীর ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন ভীষণভাবে ব্যহত হয়।
এই রোগের দুটো কম্পোনেন্ট। যেমন ১. অবসেশন ২. কম্পালশন।
১. অবসেশন : একই চিন্তা, প্রতিচ্ছবি বা আবেগ যা নাকি অযৌক্তিক বা অবাস্তব তা বারবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মনে আসাকে অবসেশন বলে। রোগী তা মন থেকে তাড়ানোর চেষ্টা করেও তাড়াতে পারেন না। সর্বদা মনোকষ্টে ভোগেন। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে শুধু অবসেশন থাকে, কিছু রোগীর ক্ষেত্রে শুধু কম্পালশন; তবে বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে অবসেসন এবং কম্পালশন দুটোই দেখা যায়।
২. কম্পালশন : অযৌক্তিক অপ্রয়োজনীয় কাজ বারবার বাধ্যতামূলকভাবে করতে থাকাকে কম্পালশন বলে। এই কাজটা না করলে রোগীর মনে টেনশন, অ্যাংজাইটি, রেস্টলেসনেস রাগ, বিরক্তি হয়— করলে সাময়িক স্বস্তি হয়, পরক্ষণেই আবার চিন্তা ফিরে এসে টেনশন বাড়লে আবার একই কাজ করতে হয়।
আমাদের দেশে শুচিবায়ু সমস্যার আরো কিছু লক্ষণ দেখা যায়। অনেকেই অতিরিক্ত সাবান দিয়ে কাপড় কাচেন।
কেউ কেউ লেখালেখির ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত খুঁতখুঁতে হন, যেমন— এক লাইন লেখার পর তার কাছে মনে হয়, লাইনটি ঠিক হয়নি। তখন তিনি ওই লাইন পুরো মুছে আবার প্রথম থেকে শুরু করেন। এমনকি কম্পিউটারে কম্পোজ করার সময়ও এটা করে থাকেন। এর ফলে নির্দিষ্ট সময়ে কাজটি শেষ হয় না।
শুচিবায়ু ব্যক্তি ধর্মকর্ম পালনের ক্ষেত্রে একজন ওসিডি আক্রান্ত ব্যক্তির সমস্যা অনেক সময় আরো প্রকট হয়। পাক পবিত্রতা ঠিকঠাক অর্জন হচ্ছে না মনে করে বারবার অজু করতে থাকেন। অনেক সময় দেখা যায়, অজু করতে গিয়ে তিনি ওই নামাজের ওয়াক্তই পার করে দিচ্ছেন। অনেকে আবার নামাজে ভুল হচ্ছে ভেবে একই নামাজ বেশ কয়েকবার পড়েন।
এরপরও তিনি মনে করেন যে, তার নামাজ ভুল হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পরিবারের লোকজন ওই ব্যক্তির সমস্যাকে শয়তানের অসওয়াসা মনে করে তা এড়িয়ে যান। শুচিবায়ুর সিম্পটমগুলো খুবই আজিব প্রকৃতির। যেমন বারবারে নিজের হাত পরিষ্কার করা (কারণ হাতে ময়লা আছে এমন অবসেশন বারবার কাজ করে), বারবারে নিজের পকেটে, নিজের ঘরে বা সিন্দুকের টাকা গণনা করা (কারণ টাকা চুরি হয়ে যাচ্ছে এমন ভাবনা কাজ করে), বিছানা পরিষ্কার করা, কাউকে অকারণে বারবার সন্দেহ করা , বারবার পকেট চেক করা ইত্যাদি ইত্যাদি। মজার বিষয় হলো— এই রোগী নিজেও বুঝতে পারে যে সে বারবার যেই কাজটা করছে সেটা ঠিক না।
তাই সে এটাকে এভয়েড করার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্রেইন ইম্পালস তো নিজে দূর করতে পারবে না। মানসিক রোগ চিনার দুটি ভাগ আছে। মেজর সাইকিয়াট্রিক ডিজেজগুলোর মধ্যে তিনটি জিনিস অবশ্যই থাকবে— ডিলুশনাল পারসেপশন, হ্যালুসিনেশন এবং ইন্টারপারসোনাল রিলেশন হ্যাম্পার থাকবেই।
যেমন— সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজওর্ডার, পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস। আর যাদের মধ্যে এই তিনটি সিম্পটম এবসেন্ট থাকে মাইনর সাইকি ডিজেজ বলে— যেমন বুলিমিয়া নার্ভসা, এন্রেক্সিয়া নার্ভোসা, পার্সোনালিটি ডিজওর্ডার, স্লিপ ডিজওর্ডার (ইন্সোমনিয়া, হাইপারসোমানিয়া)।
এই রোগের কারণ : সুনির্দিষ্ট কারণ না পাওয়া গেলেও সম্ভাব্য কারণ হিসেবে যে সমস্ত তথ্য ভাবা হচ্ছে তা হলো— জন্মের সময় ব্রেনে আঘাত, হেড ইনজুরি, এনকেফেলাইটিস এবং মৃগী রোগীদের ওসিডি বেশি হয়। অনেক সময় বংশগত কারণও থাকে।
সাইকোডায়নামিক থিওরি অনুযায়ী অবচেতন মনে উদ্বেগ কমানোর জন্য কতগুলো প্রক্রিয়ার সাহায্য নেয় যাদের বলে ডিফেন্স মেকানিজম। নিউরোটিক ও সাইকোটিক রোগের লক্ষণ হিসেবে এই ডিফেন্স মেকানিজম প্রকাশ পায়। এই রোগীর ক্ষেত্রে কিছু ডিফেন্স মেকানিজম কাজ করে।
হোমিও সমাধান : হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. হানেমান মানুষের মনস্তত্ত্বের ওপর জোর দিয়েছেন বেশি। কারণ মন খারাপ হলেই শরীরে প্রভাব পড়ে বেশি। মনস্তত্ত্বকে বাদ দিয়ে হোমিওপ্যাথিতে মানসিক রোগীকে সর্বাঙ্গীন সুস্থ করে তোলা কঠিন। শুচিবাই চিকিৎসা হোমিওপ্যাথিতে বিশেষ ফলদায়ক চিকিৎসা আছে। যা অন্য প্যাথিতে নেই।
হোমিও চিকিৎসা : রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয়, এ জন্য একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক রোগীর রোগের সঠিক লক্ষণ নির্বাচন করে প্রাথমিকভাবে যেই সব ওষুধ নির্বাচন করে থাকে— নাক্সভম, সিফিলিনাম, একোনাইট, আর্সেনিক, এন্টিম ক্রুড, অরামমেট, ক্যামোমিলা, চায়না, ইগ্নেসিয়া, এগনাস ক্যাস্টস, ল্যাকোসিস, এসিড ফস, পালসেটিলা, সিপিয়া, সালফার, থুজা, মেডোরিনাম, মার্কসল, স্ট্রামোনিয়াম, ক্যালকেরিয়া ফস, সোরিনামসহ আরো অনেক মেডিসিন লক্ষণের আসতে পারে। তাই ওষুধ নিজে নিজে ব্যবহার না করে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
লেখক : কো-চেয়ারম্যান, হোমিওবিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
আমারসংবাদ/এসটিএম