Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ

জাহাঙ্গীর আলম

নভেম্বর ২১, ২০২০, ০৭:০৫ পিএম


 দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ

অদক্ষ চালক সমস্যার কারণে সড়কে নৈরাজ্য ও দুর্ঘটনা থামানো যাচ্ছে না। তাই হালকা বা মধ্যম লাইসেন্সধারী চালকদের ভারী যানবাহন চালানোর অভিজ্ঞ চালকদের দুই থেকে চার সপ্তাহ ভারী যানবাহন চালানোর ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে বিআরটিসি। দেড় লাখেরও বেশি ভারী যানবাহন চালক তৈরি করতে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

তাদের থাকা-খাওয়াসহ পোশাকও দেয়া হবে। এ জন্য বিআরটিসি ‘ভারী যানবহন চালক তৈরির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ প্রদান’ নামে একটি প্রকল্প তৈরি করে অনুমোদনের জন্য গত বছর পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। তা যাচাই-বাছাই করতে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় কিছু ব্যাপারে আপত্তি করে সংশোধন করতে বলা হয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়কে।

বিআরটিসি, বাংলাদেশ পুলিশ, সশস্ত্রবাহিনীসহ ৯৪টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তাদের এই প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। দেশের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রশিক্ষকদের মাধ্যমে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে।

এতে শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে। রাজধানীসহ সারা দেশের সড়ক-মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহনগুলোর চালকদের অধিকাংশরই বৈধ লাইসেন্স নেই। এদের অনেকে নকল লাইসেন্স বা ভুয়া কাগজপত্র নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। হাল্কা যানবাহনের লাইসেন্স নিয়ে ভারী পরিবহন চালাচ্ছেন। তাদের লাইসেন্স সমস্যা আরও গুরুতর। অবৈধ ও অদক্ষ চালক সমস্যার কারণে সড়কে নৈরাজ্য ও দুর্ঘটনা থামানো যাচ্ছে না। সড়ক-মহাসড়কগুলো এখন বেপরোয়া যান ও অদক্ষ চালকদের দখলে।

অপরদিকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি গোল) অর্জনে এই মৃত্যুর হার কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। এ জন্য হালকা বা মধ্যম লাইসেন্সধারী চালকদের মধ্যে যাদের ভারী যানবাহন চালানোর অভিজ্ঞতা আছে তাদের দুই সপ্তাহ ভারী যানবাহন চালানোর ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

একই সাথে হালকা ও মধ্যম লাইসেন্সধারী চালকদের মধ্যে যাদের হালকা যানবাহন চালানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের চার সপ্তাহ ভারী যানবাহন চালানোর ওপরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। এসএসসি পাস ও যানবাহন চালানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচন করা হবে এ প্রশিক্ষণের জন্য।

যাতে সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। একই সাথে দেশে-বিদেশে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যায়। নিরাপদ ও আরামদায়ক রাষ্ট্রীয় গণপরিবহন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৬১ সালে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন (বিআরটিসি) গঠন করা হয়। এ লক্ষ্য অর্জনে নিরাপদ সড়ক পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য বিআরটিসির তত্ত্বাবধানে ভারী যানবাহন চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে সঠিক লাইসেন্সিংয়ের আওতায় আনা একান্ত প্রয়োজন।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে দেরিতে হলেও তিন লাখ ভারী যানবাহন চালক তৈরির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের জন্য সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সম্পূর্ণ সরকারি অর্থে প্রকল্পটি তৈরি করে অনুমোদনের জন্য গত বছরে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে।  প্রকল্পের প্রস্তাবনায় হালকা বা মধ্যম লাইসেন্সধারী চালকদের মধ্যে দুই লাখ চালককে প্রশিক্ষণের লক্ষ্য ধরা হয়।

তাদের ১২ দিনের প্রশিক্ষণ দিতে খোরাকি বা ভাতায় ব্যয় ধরা হয় এক কোটি ৯২ লাখ টাকা। পোশাক ভাতায় ব্যয় ১০ কোটি টাকা। যারা প্রশিক্ষণ দেবেন তাদের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬২ কোটি টাকা। আর ২৪ দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে এক লাখ চালককে। এ জন্য খাবারের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে এক কোটি ৯২ লাখ টাকা।

পোশাকের জন্য পাঁচ কোটি টাকা। তাদের থাকার জন্য ২৫টি ছাত্রাবাস তৈরি করা হবে। এতে ৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। যে সব প্রশিক্ষক তাদের প্রশিক্ষণ দেবেন তাদের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩ কোটি টাকা।

তাদের এই প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সভার আয়োজনে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে প্রকল্প পরিচালকসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যাতায়াতে যানবাহন কেনা হবে ১৭০টি।

এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। তাদের বেতন-ভাতাদিও ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩ কোটি ১২ লাখ টাকা। অভিজ্ঞতা অর্জনে বিদেশে প্রশিক্ষণে ব্যয় ধরা হয়েছে এক কোটি টাকা। এভাবে বিভিন্ন খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৭৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। যা সরকারি অর্থে ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের জুনে বাস্তবায়ন করার কথা বিআরটিসির। তা যাচাই-বাছাই করতে গত জানুয়ারিতে পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বলা হয়, পাঁচ বছর আট মাসে বাস্তবায়ন দীর্ঘমেয়াদি পথ।

তাই প্রকল্পটি দুই পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা যায় কি-না তা বিবেচনা করতে বলা হয়। এছাড়া জনবল নিয়োগে অর্থমন্ত্রণালয়ের জনবল কমিটির সুপারিশ, যৌক্তিক পর্যায়ে ব্যয় নির্ধারণসহ আরও কিছু ব্যাপারে আপত্তি করে সংশোধন করতে বলা হয়েছে। ফিজিবিলিটি স্টাডি না করায় তা সংশোধিত ডিপিপিতে যুক্ত করতে বলা হয়েছে।

সূত্র জানায়, এটি একটি সম্পূর্ণ প্রশিক্ষণমূলক প্রকল্প। বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিআরটিসি পরিকল্পনা কমিশনের বার্তা আমলে নিয়ে প্রকল্পটি দুই পর্যায়ে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। যাতে মাঝপথে থেমে না যায়। প্রথম পর্যায়ে প্রশিক্ষণার্থীদের সংখ্যা কমিয়ে এক লাখ ৫৭ হাজার ৯২০ জন নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ব্যয় কমিয়ে ধরা হয়েছে ৫৭৮ কোটি টাকা।

আর বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। যারা হালকা লাইসেন্স নিয়ে ভারী গাড়ি চালায় তাদের দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভারী লাইসেন্সের ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া যারা হালকা লাইসেন্স দিয়ে হালকা গাড়ি চালান তাদের চার সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভারী লাইসেন্সের ব্যবস্থা করা হবে।

বিআরটিসির ২৪টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী বিভাগের ২৪টি, বাংলাদেশ পুলিশের একটি, আঞ্চলিক ট্রেনিং সেন্টার ২৬টি এবং বেসরকারি খাতের (নিরাপদ সড়ক চাই, ব্র্যাক, নিটল টাটা ড্রাভিং ট্রেনিং স্কুল) ভারী  যানবহন চালকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার সক্ষমতা আছে এমন ১৯টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।

পিপিএ ও পিপিআরের বিধি মেনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সমঝোতা সই করতে হবে। প্রশিক্ষণ চলা অবস্থায় চালকদের চাকরি যাতে বহাল থাকে মালিককে তা নিশ্চিত করতে হবে। পিইসি সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লোকবল নিয়োগের বিবরণী অনুমোদন পেতে অর্থমন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

বিআরটিসির ২৫টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ২৫টি ছাত্রাবাস করা হবে। কর্মরত চালকদের এই প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। তাই তাদের প্রতিজনের জন্য খোরাকি ও যাতায়াত ভাতা দেয়া হবে এক হাজার ৩০০ টাকা। দুই সপ্তাহ বা ১২ দিনে খোরাকি খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৭ কোটি টাকা। আর চার সপ্তাহ বা ২৪ দিনে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৬ কোটি টাকা।

একই সাথে তাদের দুটি করে টি-শার্টও দেয়া হবে। এ খাতে ব্যয় হবে ৩৬ কোটি টাকা। করোনার কারণে বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। দেশেই এসইআইপি (সেফ) প্রকল্পের মাধ্যমে যে এক হাজার ৪১০ জন দক্ষ প্রশিক্ষক তেরি হবে তারাই চালকদের প্রশিক্ষণ দেবেন।

প্রশিক্ষণ শেষে চালকদের ভারী লাইসেন্স দেয়ার জন্য বিআরটিএতে সুপারিশ করা হবে। বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে চালকদের সক্ষমতা যাচাই করতে ড্রাইভিং সিমুলেটরেরও (অটোমেটিক মেশিনে কমান্ড দিয়ে গাড়ি চালানো) ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

কারণ বিদেশেও চালকদের প্রথমে কেউ গাড়ি দেয় না। ড্রাইভিং সিমুলেটরে সন্তুষ্ট হলে পরে গাড়ি দেয়া হয়। তাই এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫০টি ড্রাইভিং সিমুলেটর কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এভাবে পিইসি সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংশোধিত ডিপিপি খুব শিগগিরই পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে।

আর পরিকল্পনা কমিশন সূত্র বলছে, এখানে প্রকল্পটি আসার পরই বাকি কাজ শেষ করে একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। সড়কের দুর্ঘটনা কমাতে প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

তাই পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রকল্পটি তৈরি করতে নির্দেশ দিয়েছেন। একই সাথে যারা প্রশিক্ষণে অংশ নেবে তাদের থাকা-খাওয়ারও ব্যবস্থা করতে বলেছেন। তা আমলে নিয়ে প্রকল্পটি তৈরি করা হয়েছে। প্রথম ধাপে প্রকল্পটি ভালো করলে বা সফল হলে দ্বিতীয় ধাপে অগ্রসর হবে বিআরটিসি বলে সূত্র জানায়।

উল্লেখ্য, বিআরটিএর বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং পরীক্ষার পর চালককে প্রথমে হালকা মোটরযানের (আড়াই হাজার কেজির কম ওজন) পেশাদার লাইসেন্স দেয়া হয়।

তিন বছর হালকা মোটরযান চালানোর পর একজন চালক মধ্যম শ্রেণির মোটরযান (আড়াই থেকে সাড়ে ছয় হাজার কেজি) চালানোর লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্য হয়ে ওঠেন।

একইভাবে তিন বছর মধ্যম মোটরযান চালানোর পর চালককে ভারী মোটরযান (সাড়ে ছয় হাজার কেজির বেশি) চালানোর জন্য পেশাদার লাইসেন্স দেয়া হয়। বাস-ট্রাক চালাতে প্রয়োজন পড়ে ভারী শ্রেণির মোটরযান চালানোর লাইসেন্স।

আমারসংবাদ/এআই