Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

‘অর্থপাচারকারীরা জাতীয় বেঈমান’

নভেম্বর ২২, ২০২০, ০৬:১০ পিএম


‘অর্থপাচারকারীরা জাতীয় বেঈমান’

বিদেশে অর্থপাচারকারীদের দেশ ও জাতির শত্রু বলে অভিহিত করেছেন হাইকোর্ট। এ জাতীয় বেঈমানদের নাম প্রকাশ না হলে অপরাধ কমবে না বলেও মনে করেন উচ্চ আদালত। কানাডার ‘বেগম পাড়া’ গড়ে তোলাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিছু বাংলাদেশির অর্থপাচারের ঘটনায় পত্রিকার প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখে ও বিদেশে অর্থপাচারকারীদের নাম-ঠিকানাসহ যাবতীয় তথ্য চেয়ে গতকাল রোববার স্বপ্রণোদিত আদেশ দেয়ার আগে বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এসব কথা বলেন।

শুনানির একপর্যায়ে বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘হিউজ (বিপুল) পরিমাণ বাংলাদেশি টাকা কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছে এবং অধিকাংশ (পাচারকারী) সরকারি কর্মকর্তা। ‘তাদের (অর্থপাচারকারী) নাম-ঠিকানা, কিভাবে অর্থপাচার করলো, কিভাবে বিদেশে বাড়ি তৈরি করলো, এটা জানা দরকার।’

এরপরেই হাইকোর্ট আগামী ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে দুদক চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্রসচিব, পররাষ্ট্রসচিব, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে তথ্য চেয়ে আদেশ দিয়েছেন। দুর্বৃত্তদের নাম-ঠিকানার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি-না, তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।

একই সাথে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে ‘নিষ্ক্রিয়তা’ কেন অবৈধ হবে না তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করা হয়েছে। প্রচলিত আইন লঙ্ঘন করে অর্থপাচারকারী সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, ব্যাংক কর্মকর্তা ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্টদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।

শুনানিকালে হাইকোর্ট বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এই যে টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে, তাদের নাম-ঠিকানা কী, সেটা তো তো জানা দরকার। এরা দেশ ও জাতির সঙ্গে বেইমানি করছে বলে আমি মনে করি।

কারণ দেশে পড়াশোনা করে, দেশের মাটিতে থেকে, দেশের বাইরে টাকা পাচার করবে, এটা কি বেইমানি নয়?’

জবাবে ওই সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান আইনজীবী খুরশীদ আলম খান আদালতকে বলেন, ‘মাই লর্ড, আমাদের দেশ এটা কালচার (সংস্কৃতি) হয়ে গেছে।’ তাই সবাই এটা করছেন। কেউই কিছু মনে করছেন না।

দুদক আইনজীবীর কথার জবাবে বিচারপতি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের মাটিতে থাকবে, পড়াশোনা করবে, কিন্তু সবশেষে দেশকে ঠকিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করবে, এটা তো হতে পারে না। দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকলে, এটা কখনো করতে পারে না।

এভাবে তো আমরা দুর্বৃত্তদের গ্রহণ করতে পারি না। দেশের টাকা অবৈধভাবে বাইরে চলে যাবে, আমাদের এতগুলো আইনগত সংস্থা, কোর্ট রয়েছে। আমাদের অবশ্যই এগুলো বন্ধ করতে হবে।’

‘যদি আমরা মনোযোগ না দেই, সবাই যদি কাজ না করি, দেশকে উন্নত করার জন্য, কীভাবে উন্নত হবে? আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করতে চাই দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। সে লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। অর্থপাচার, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।’

আদালত এ সময় আদেশ দিয়ে বলেন, ‘যারা দুর্বৃত্ত, বিদেশে টাকা পাচার করছে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলো— অবৈধভাবে কোনো টাকা পাচার করা যাবে না।’ এসময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান ও রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক।

যেটা আমলে নিয়ে আদালতের স্বপ্রণোদিত এ আদেশ : এদিকে সমপ্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, কানাডায় অর্থপাচারের প্রমাণ পেয়েছে সরকার। পাচারকারীদের বেশির ভাগ সরকারি কর্মকর্তা।

তবে এই কর্মকর্তা কারা, তাদের নাম প্রকাশ করেনি সরকার। কারো বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে কানাডাসহ দেশের বাইরে অর্থপাচারকারীদের নাম-ঠিকানাসহ সব তথ্য চেয়েছেন হাইকোর্ট।

বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দিয়েছেন। আগামী ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে আদালত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গত ১৮ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে বিদেশে অর্থপাচার নিয়ে বক্তব্য দেন।

তিনি বলেন, রাজনীতিবিদরা নন, বিদেশে বেশি অর্থ পাচার করেন সরকারি চাকরিজীবীরা। অর্থপাচারের ২৮টি ঘটনার তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, এর মধ্যে রাজনীতিবিদ হলেন চারজন। কানাডার টরন্টোতে বাংলাদেশিদের বিষয়ে খোঁজ নেয়া হয়েছে বলেও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

হঠাৎ উচ্চ আদালতের এমন আদেশ কেন? সংশ্লিষ্টদের প্রতিক্রিয়া কী?
এ বিষয়ে জানেত চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার আমার সংবাদকে বলেন, ‘উচ্চ আদালত যে আদেশ দিয়েছেন সেটাকে সম্মান জানাই, তবে শুধু সরকারি কর্মকর্তারাই নয় বিদেশে অর্থপাচারের সাথে অনেক রুই-কাতলও জড়িত রয়েছে। আর এদের কিছুই হবে না।  তাদের বিষয়ে কেউ বলার সাহস পায় না। শুধু বিদেশে অর্থপাচারই নয়, ভূমিদস্যুদেরও ধরতে হবে।’

সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান আমার সংবাদকে বলেন, ‘আদালত যে আদেশটা দিয়েছে সেটা ইতিবাচক। পাচারকৃত অর্থ দেশের সাধারণ মানুষের অর্থ এবং নিশ্চিভাবেই এটা অন্যয়ভাবে অর্জিত অর্থ যেটা বিদেশে পাঠানো হয়েছে। তাই মানুষ ও দেশের উন্নয়নের স্বার্থে অনতিবিলম্বে এই টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া উচিত এবং যারা এই পাচারের সাথে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত।

আর আশাবাদ থাকবে, মহামান্য হাইকোর্ট এই বিষয়টার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি এবং পাচার হওয়া এই অর্থ আদায় করা পর্যন্ত সজাগ থেকে তদারকি করবেন এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি। বিদেশে টাকা পাঠানোর যে পদ্ধতিগত ত্রুটিগুলো রয়েছে এগুলোর ক্ষেত্রে অনতিবিলম্বে সরকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করা উচিত।

আদালতের রুলসহ আদেশের বিষয়ে দুদক আইনজীবী হিসেবে প্রতিক্রিয়া কী, জানতে চাওয়া হলে দুদকের প্রধান আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, ‘আমরা সবসময়ই আদালতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকি। আমাদের সময়ের দাবি ছিলো যে, আদালত এমন একটা আদেশ দিক যার মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের মুখোশ মানুষের সামনে উন্মোচন হোক।’

সময়মতো রুলের জবাব পবেন কি-না এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন,  ‘আশা করি দুর্নীবাজদের তথ্য জানতে চেয়ে যাদের বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছে তারা আদালতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে যথাসময়ে রুলের জবাব দেবেন। গত ১৯, ২০ ও ২১ নভেম্বর দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্যের ওপর খবর প্রকাশিত হয়েছে।

সেখানে তিনি বলেছেন, ‘রাজনীতিবিদরা নন, বিদেশে বেশি অর্থপাচার করেন সরকারি কর্মচারীরা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সেসব খবর আমলে নিয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে রুল জারি করেছেন।

অর্থপাচার নিয়ে আদালতে রুলসহ আদেশের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ওই কোর্টের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমি মনে করি, মহামান্য হাইকোর্ট যে আদেশ দিয়েছেন সেটা সঠিক দিয়েছেন।

কারণ সরকারি কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত আয়ের উৎস দেশের সবার জানা উচিত। তারা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার নামে বিদেশে বিপুল অর্থ পাচার করে বাড়ি-গাড়ি করতে পারেন না। তাদের বিদেশে পাঠানো টাকা দেশের আয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। যদি অবৈধভাবে বিদেশে টাকা পাঠিয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, তাতে সে যত শক্তিশালীই হোক না কেন।’

হঠাৎ উচ্চ আদালতের এমন আদেশ কেন? সরকারের পক্ষ থেকে কোন দির্দেশনা ছিলো কি-না এ বিষয়ে জানেত চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার নির্দেশনা ছিলো না। মূলত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গণমাধ্যমে দেয়া বক্তব্যকে আমলে নিয়েই আদালত সুয়োমটো আদেশ দিয়েছেন। তবে এটা প্রয়োজন ছিলো।’

আমারসংবাদ/এসটিএম