Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

১০ মাসেও মেলেনি অনুমোদন বন্ধ সেটেলমেন্ট আদালত

নভেম্বর ২৬, ২০২০, ০৬:০০ পিএম


১০ মাসেও মেলেনি অনুমোদন বন্ধ সেটেলমেন্ট আদালত

আদালত আছে। পুরনো জীর্ণশীর্ণ টিনশেড ভবনও আছে। তবে নেই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও জনবল। এমনকি বিচারকদের বসার প্রয়োজনীয় জায়গাও নেই। যেনো সমস্যার অন্ত নেই। নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়েই একপ্রকার খুঁড়িয়ে চলছে ঢাকার প্রথম ও দ্বিতীয় সেটেলমেন্ট আদালত।

অথচ দেশের পরিত্যক্ত বাড়ি-সংক্রান্ত মামলার বিচারের জন্য ঢাকার এই দুটি আদালতের ওপরই নির্ভর করতে হয় সারা দেশের মানুষকে। সেটেলমেন্ট আদালতে বিচার সহায়ক ১৪ জন জনবল থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে আছে মাত্র ৯ জন। নেই প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পেশকার, প্রসেস সার্ভার, স্টেনোগ্রাফার, কম্পিউটার অপারেটর, চালক ও পিয়ন।

এত সমস্যার পরও বছরের পর বছর কিভাবে বিচারকাজ চলছে এ নিয়েও জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এখানে সরকারি আইনজীবীদের পৃথক দুটি প্যানেল থাকার কথা থাকলেও তাও নেই। চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিব ছাড়া অন্য কক্ষগুলোতে ঝুলছে তালা। বৃষ্টিতে টিনশেড ছিদ্র হয়ে পানি পড়ায় অনেক আইনজীবীও নিয়মিত আদালতে আসেন না। তবুও বিচারকাজ চলে, বিচারপ্রার্থীরাও প্রতিনিয়ত আসা-যাওয়া করেন।

তবে করোনার প্রভাবে দীর্ঘদিন বিচারকাজ বন্ধ থাকায় নেই আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের আনাগোনা। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন পুরনো বাড়ি ও সম্পত্তি ফিরে পেতে আসা সাধারণ জনগণ। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি এক বছরের জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় সেটেলমেন্ট আদালতের অনুমোদন দিয়ে থাকেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

তবে চলতি বছরের জুন মাসে ওই আদালতের মেয়াদকাল শেষ হওয়ার  দীর্ঘ ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও নতুন করে অনুমোদন দিতে কালক্ষেপণ করছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। কবে নাগাদ অনুমোদন দেবেন সেটাও বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। ফলে সাধারণ বিচারপ্রক্রিয়া বিঘ্নিত হচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে মামলাজট। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এই আদালতে আসা ৭১ পরবর্তী ফেলে যাওয়া বাড়ি ফিরে পেতে বিচার চাইতে আসা বিচারপ্রার্থীরা।

 এদিকে যুগ যুগ ধরে সেটেলমেন্ট আদালত হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রের ও জনগণের সম্পত্তি ন্যূনতম দালিলিক ও মৌখিক সাক্ষ্যপ্রমাণ ব্যতিরেকে জালিয়াত, ঠক, বাটপাড় এবং পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসরদের হাতে তুলে দিয়েছেন বলে অভিযোগ করে হাইকোর্ট সম্প্রতি একটা রায়ে উল্লেখ করেছেন।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, করোনার মধ্যে সব আদালত চললেও সেটেলমেন্ট আদালত বন্ধ রয়েছে। কারণ এখানে ভার্চুয়াল আদালত চালানোর সুযোগ নেই। আর অনুমোদন না থাকলে এই আদালত চালানোও সম্ভব নয়।

তবে ৩৪ বছরের পুরনো আধাপাকা জরাজীর্ণ বাড়িটি দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়ছে। বৃষ্টি হলেই বসে কাজ করা দায়। এমন অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিতে কোনো কর্মকর্তা এখানে বদলি হলেও কাজে যোগ দিতে চান না। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উচিত শুধু অনুমোদন নয়, দ্রুত অনুষাঙ্গিক সমস্যাগুলো মিটিয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু করা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একজন চেয়ারম্যান ও দুজন সদস্য নিয়ে গঠিত প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত। একইভাবে গঠিত দুই নম্বর আদালত। তিনজনের মধ্যে যেকোনো একজন অনুপস্থিত থাকলে আদালত বসার সুযোগ নেই। ফলে বিচারপ্রার্থীদের অবস্থা গুরুচরণ। বিচারের জন্য টিনশেড ভবন কোনোভাবেই মানানসই নয়।

তাছাড়া অনেক দিনের পুরনো ভবন। বৃষ্টি হলেই পানি চুইয়ে পড়ে। বৃষ্টির পানিতে মামলার নথি-ফাইলপত্র ও রেকর্ড সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই আদালত প্রতি এক বছরের জন্য অনুমোদন দেয় সরকার। গত বছরের শেষ দিকে আদালতের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর থেকে অনুমোদন না পাওয়ায় আদালত দুটির বিচারকাজে স্থবিরতা চলছে। এতে বিচারপ্রার্থীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রথম আদালতে ২৬৮টি এবং দ্বিতীয় আদালতে ১৬১টি মামলা বিচারাধীন। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকে বাড়িঘর ফেলে পাকিস্তান চলে যায়। তখন সরকার তাদের বাড়িকে পরিত্যক্ত হিসেবে চিহ্নিত করে। ১৯৮৬ সালে এসব বাড়ির বিষয়ে গেজেট জারি করে সরকার।

এর মধ্যে সরকারের দখলে থাকা বাড়িগুলো ‘ক’ তফসিলভুক্ত এবং ব্যক্তির দখলে চলে যাওয়া বাড়িগুলো ‘খ’ তফসিলভুক্ত। এ নিয়ে অনেক মামলা আছে। এসব মামলা বিচারের জন্য ১৯৮৬ সালে দুটি আদালত গঠন করে সরকার।

এর মধ্যে ‘প্রথম কোর্ট অব সেটেলমেন্ট’ শুধু ঢাকার পরিত্যক্ত বাড়ি এবং ‘দ্বিতীয় কোর্ট অব সেটেলমেন্ট’ ঢাকা ছাড়া সারা দেশের পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর মামলার বিচার করে। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ৫নং টিনশেডে (১২ তলা ভবনের পাশে) আদালত দুটির অবস্থান।

পরিত্যক্ত বাড়ির মামলা বিচারের জন্য দেশের একমাত্র সেটেলমেন্ট আদালতের বেহাল দশার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, সেটেলমেন্ট আদালতের সমস্যার অন্ত নেই। তবে এই সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কখনো কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিকানা নিয়ে বিচার হয় অথচ সেখানে বিচারকদের বসতে হয় টিনশেড একটা ঘরে এটা দুঃখজনক। সংশ্লিষ্টদের এই আদালতের প্রতি নজর দিয়ে সমস্যাগুলো সমাধান করা উচিত।

এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব শহীদুল্লাহ খন্দকারের বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি আমার সংবাদকে বলেন, গণপূর্ত থেকে ইতোমধ্যে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বাকি কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। দ্রুতই আদালত দুটো চালু হবে। তবে মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বন্ধ থাকা আদালত দুটি চালু করতে অনুমোদনের চেষ্টা চলছে। শিগগিরই এই অনুমোদন হয়ে যাবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তারা।

সেগুনবাগিচায় অবস্থিত আধাপাকা টিনের ঘরে চলে আসছে আদালত দুটির বিচার কার্যক্রম। এক নম্বর সেটেলমেন্ট আদালতের চেয়ারম্যান জেলা ও দায়রা জজ রাশেদুজ্জামান রাজা। দুই নম্বর আদালতের চেয়ারম্যান জেলা ও দায়রা জজ মো. জুয়েল রানা।

সেটেলমেন্ট আদালতের বিচার নিয়ে হাইকোর্টের ক্ষোভ : নিজেদের কেনা সম্পত্তি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকায় উঠে গেছে দাবি করে চার ব্যক্তি ঢাকার প্রথম সেটেলমেন্ট আদালতে মামলা করেন। তাদের আবেদনের ভিত্তিতে ঢাকার কাকরাইলের সাড়ে ১৬ কাঠা জমি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ১৯৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত রায় দেন। এর বৈধতা নিয়ে সরকারপক্ষ ২৪ বছর পর ২০১৯ সালে হাইকোর্টে পৃথক দুটি রিট করে।

চূড়ান্ত শুনানি শেষে সেটেলমেন্ট আদালতের ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করে হাইকোর্ট রায় দেন। উচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়, প্রথম সেটেলমেন্ট আদালতের রায় ও আদেশ অযৌক্তিক, অসৎ অভিপ্রায়, অসৎ উদ্দেশ্যে ও স্বেচ্ছাচারী। সর্বোপরি রায় ও আদেশ ন্যায়বিচার বা প্রাকৃতিক বিচারের নিয়মবিরোধী বা পরিপন্থি।

পরিত্যক্ত সম্পত্তি নিয়ে প্রথম সেটেলমেন্ট আদালতের দেয়া সিদ্ধান্তের বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, ঢাকার তৎকালীন প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি করেন এবং জালিয়াত চক্রকে বিনা দালিলিক এবং সাক্ষ্য ব্যতিরেকে হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় এবং জনগণের সম্পত্তি জালিয়াত চক্রের হাতে তুলে দেন।

আরও বলা হয়, হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রের সম্পত্তি, হাজার কোটি টাকার জনগণের সম্পত্তি প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত ন্যূনতম দালিলিক ও মৌখিক সাক্ষ্যপ্রমাণ ব্যতিরেকে জালিয়াত, ঠক, বাটপার এবং পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসরদের হাতে তুলে দিয়েছেন।

গত বছরের ১১ ডিসেম্বর বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রায় দেন। ১৪৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে সমপ্রতি প্রকাশ করা হয়।

ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, বিচার বিভাগ যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে জনগণ বিকল্প উপায় খুঁজতে বাধ্য হবে, যেটি কল্পনাও করা যায় না।

আদালত বলেছেন, আমূল সংস্কার করে, দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে বিচার বিভাগকে নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য ও আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার সময় এসেছে।

আইনের শাসন ও বিচার বিভাগীয় দুর্নীতি পাশাপাশি চলতে পারে না। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন, তাহলে আইনের শাসন বই-পুস্তকে সীমাবদ্ধ থাকবে, এটি বাস্তব রূপ লাভ কখনোই করবে না।

আমারসংবাদ/এআই