Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ : বাড়াতে হবে সচেতনতা

গোপাল অধিকারী

নভেম্বর ২৯, ২০২০, ০৬:৩৫ পিএম


করোনার দ্বিতীয় ঢেউ : বাড়াতে হবে সচেতনতা

শীতকালে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। দীর্ঘদিনের করোনা জনজীবনে একটি অভিশাপে পরিণত হয়েছে। এ ভাইরাসটি  সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনীতি ও শিক্ষা— সকলকিছুর উপরই প্রভাব বিস্তার করেছে।

 গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের মধ্যাঞ্চলীয় হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত।

আর বাংলাদেশে প্রথম করোনা সনাক্ত হয় ৮ মার্চ। করোনা বাংলাদেশে জোরালো প্রভাব না ফেললেও পূর্ব সতর্কতা বর্তমান পরিসংখ্যানও লোপ করে দিতে পারতো বলে মনে করেন অনেকে।

তাপমাত্রা ওঠানামার সাথে ভাইরাসের সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও নানা কারণে বাড়তে পারে সংক্রমণ, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাপমাত্রা কমলে বারবার স্নান করা বা ঘনঘন কাপড় ধোয়ার প্রবণতা কমবে। ফলে সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়তে পারে।

এছাড়া শীতে রোদ কম থাকলে শরীরে ভিটামিন ‘ডি’-এর জোগান কমে যায়। ফলে কমে যায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। করোনার ভ্যাকসিন এখনো বাজারে আসেনি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে বিশ্বজুড়ে। ফলে সাবধানতা অবলম্বন করা ছাড়া সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় নেই। এ পরিস্থিতিতে শীতকাল কতটা উদ্বেগের হয়ে উঠতে পারে?

সমীকরণে দেখা যায় গত কদিনের ব্যবধানে করোনা সংক্রমণের ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান বাড়ছে। গত ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪৫১৯৯০ জন, মৃত্যু ৬,৪৪৮ জন, মোট সুস্থ ৩,৬৬,৮৭৭ জন এবং মোট পরীক্ষা হয়েছে ২৬,৮০,১৪৯ জনের।

গত ২৩ নভেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২,৪১৯ জন আর মৃত্যু হয়েছে ২৮ জন, ২২ নভেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২০৬০ জন আর মৃত্যু হয়েছে ৩৮ জন, ২১ নভেম্বর মঙ্গলবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১’৮৪৭ জন আর মৃত্যু হয়েছে ২৮ জন, ২০ নভেম্বর সোমবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২,২৭৫ জন আর মৃত্যু হয়েছে ১৮ জন, ১৯ নভেম্বর রোববার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২,৩৬৪ জন আর মৃত্যু হয়েছে ৩০ জন। তাতে বাড়ছে সংক্রমণের ঝুঁকি কিন্তু সরকারি তৎপরতা ও শুদ্ধি অভিযান নেই প্রথমকার মতো। এখন জনসাধারণের অবাধ চলাফেরায় মনে হয় করোনা নেই দেশে।

করোনা ভাইরাসের আরেকটি ধাক্কা আসছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, প্রথমবারের অভিজ্ঞতা দিয়ে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সবাইকে সতর্ক থাকতেও বলেন তিনি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে দ্বিতীয় ধাক্কা সামলানো সম্ভব বলে আশা প্রকাশ করেছেন সরকারপ্রধান।

গত রোববার সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মাগুরা, যশোর ও নারায়ণগঞ্জে তিনটি সেতু উদ্বোধনকালে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী আরও জানান, মহামারির এই প্রকোপের মধ্যে মানুষকে সুরক্ষা দেয়াই সরকারের লক্ষ্য।

ইতোমধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি মোকাবিলার প্রস্তুতি শুরু করেছে সরকার। মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করার কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য সরকার ইতোমধ্যে মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশও দিয়েছে। ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’, অর্থাৎ মাস্ক না পরলে সেবা নেই— এ প্রতিপাদ্য নিয়ে সরকার করোনাবিরোধী প্রচারণা চালাতে যাচ্ছে। বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের জন্য কোয়ারেন্টাইনের আয়োজন করতে সারা দেশের সিভিল সার্জনদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

জনসচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা জোরদার করার কাজও শুরু করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কারণ, বিশ্বের বেশ কিছু দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার পর দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ দেখা দিয়েছে, এ পরিস্থিতি বিশেষভাবে সৃষ্টি হয়েছে ইউরোপে। সেখানে কোনো কোনো শহর বা অঞ্চলকে নতুন করে লকডাউন বা অবরুদ্ধ করা হচ্ছে।

কথায় বলে, ন্যাড়া বেল তলায় একবারই যায়। তাই আমার মতে পূর্বের ভুল আবার করলে সঠিক হবে না বরং পূর্বের অভিজ্ঞাকে কাজে লাগাতে হবে। করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলেই সকল ফ্লাইট বন্ধ করে দিতে হবে। পুরো ঢাকাকে আগে নিরাপদ করা প্রয়োজন বলে মনে করি। সাথে যেসব জেলায় সংক্রমণ বাড়বে সেসব জেলাকে লকডাউনের আওতায় আনা জরুরি বলে মনে করছি।  

যেকোনো বিষয়ে সচেতনতার বিকল্প নেই। সচেতনতা কখনো ক্ষতি করে না। সংকটের  সময় আতঙ্কিত না হয়ে বরং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে নিজেকে ও আশপাশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখার পরামর্শ দিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকতে সাবান ও পানি দিয়ে ঘনঘন হাত ধুতে বলা হয়েছে ডব্লিউএইচওর নির্দেশনায়। এছাড়া মাংস ও ডিম অবশ্যই যথাযথ তাপে ও ভালোমত রান্না করে খেতে বলা হয়েছে।

হাঁচি-কাশির সময় অবশ্যই হাত বা টিস্যু দিয়ে মুখ ও নাক ঢেকে রাখতে হবে। এরপর টিস্যু ফেলে দিতে হবে এবং অবশ্যই হাত ধুয়ে নিতে হবে। যেকোনো অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করার পর হাত ধুতে হবে। কোনো প্রাণির যত্ন নিলে বা স্পর্শ করলে ও প্রাণিবর্জ্য ধরার পরও হাতে ধুতে হবে। শরীরে যেকোনো সংক্রমণ এড়াতে রান্না ও খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধুয়ে নিতে হবে।

নিজের পাশাপাশি অন্যকে সুরক্ষিত রাখতে করণীয় সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দিয়েছে ডব্লিউএইচও। ব্যবহার করা টিস্যু খোলা ঝুড়ি বা ডাস্টবিনে না ফেলে ঢাকনা রয়েছে এমন ঝুড়িতে ফেলতে হবে। হাতে গ্লাভস না পরে বা নিজে সুরক্ষিত না থেকে কোনো অসুস্থ ব্যক্তির মুখ ও দেহ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। একইভাবে গবাদিপশু ও বন্যপশুকে ধরার আগেও নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। রান্নাঘরের কাজেও বিশেষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলছে ।

কাঁচা মাংস, সবজি, রান্না করা খাবার কাটার জন্য ভিন্ন চপিং বোর্ড ও ছুরি ব্যবহার করতে হবে। কাঁচা মাংস, সবজি ও রান্না করা খাবার হাতে ধরার আগে অবশ্যই প্রত্যেকবার হাত ধুয়ে নিতে হবে। রোগে ভুগে মারা যাওয়া বা অসুস্থ প্রাণীর মাংস একেবারেই খাওয়া চলবে না।

 তবে রোগের প্রাদুর্ভাব রয়েছে— এমন এলাকাতেও উপযুক্ত তাপে ও ভালোভাবে সিদ্ধ করা মাংস খেলে ঝুঁকি নেই। কাঁচাবাজারে গিয়ে কোনো প্রাণী ও প্রাণীর মাংস হাতে ধরলে দ্রুত হাত ধুয়ে ফেলতে হবে।

কাঁচাবাজারে অবস্থানের সময় অযথা মুখ-চোখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কাজের জায়গাটি দিনে অন্তত একবার হলেও পরিষ্কার বা জীবাণুমুক্ত করতে হবে। পরিধেয়টি অবশ্যই প্রতিদিন বদল করতে হবে এবং ধুতে হবে। সংক্রমণ এড়াতে হাতে গ্লাভস ব্যবহার করা ভালো। করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্কের মধ্যে ভ্রমণ বিষয়েও সচেতন থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। যদি জ্বর-সর্দি অনুভূত হয়, তাহলে যেকোনো ভ্রমণ বাতিল করাই ভালো।

পাশাপাশি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও ওষুধ খেতে হবে। জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন— এমন কারো সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। যদি মাস্ক ব্যবহার করা হয়, তবে নাক ও মুখ ভালোভাবে ঢেকে রাখতে হবে। একবার মাস্ক পরলে তা বারবার স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। একবার মাস্ক ব্যবহারের পর ফেলে দিতে হবে। মাস্ক ধরার পর হাতে ধুয়ে নিতে হবে।

যদি ভ্রমণের সময় অসুস্থ বোধ হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। এর আগে রোগের ইতিহাস থাকলে সেটাও চিকিৎসককে জানাতে হবে। যেখানে সেখানে বা জনসমাগমের স্থানে থুতু ফেলা যাবে না। অসুস্থ প্রাণী ধরা থেকে সতর্ক থাকতে হবে— এই যে সতর্কতাগুলো আছে সেগুলোকে আবারো মেনে চলতে হবে। এ সচেতনতাগুলো মানতে জনগণকে বাধ্য করতে হবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর। এককথায় অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে কঠোরভাবে।

পৃথিবীটা মানুষের জীবনের অনুরূপ। সুখ-দুঃখ আর আনন্দ-বেদনা নিয়েই জীবন। সুখও দীর্ঘস্থায়ী নয় আবার দুঃখও দীর্ঘস্থায়ী নয়। সেই ধারাবাহিকতায় করোনাও দীর্ঘস্থায়ী নয়। প্রকৃতির এই ভয়াল ভাইরাসে কারো উপর দোষ না চাপিয়ে করোনা আক্রান্তকে ঘৃণা না করে সকলে মিলে আইন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। আইন না মানা এক প্রকার গুরুতর অপরাধ। আর আইনতো আমাদের জন্যই।

বর্তমানে করোনার কারণে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় ক্ষতি হচ্ছে। এ নিয়েও রয়েছে বিভিন্ন মত ও পথ। তবে শুধু একটি সেক্টরকে নিয়ে না ভেবে সকল ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।

সরকারের একার পক্ষে করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তবে স্বাস্থ্যবিধি ও করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কঠোর হতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক দূরত্ব বজায়, মাস্ক ব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।

আর আমাদের হতে হবে আরও সচেতন ও দায়িত্বশীল। জনসচেতনতা আমাদের তৈরি করতে হবে নিজেদের প্রয়োজনে। অবশ্যই করোনার তীব্রতা কমাতে সচেতনতা ও শুদ্ধি অভিযান হবে বাড়াতে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আমারসংবাদ/এআই