Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

মামলার মহাজটে ঢাকার আদালত

ডিসেম্বর ২, ২০২০, ০৬:০০ পিএম


মামলার মহাজটে ঢাকার আদালত

বিচারক সহায়ক জনবল কম। আছে বিচারকেরও সংকট। নতুন নতুন ট্রাইব্যুনাল সৃষ্টি হলেও হয়নি অবকাঠামোগত উন্নয়ন। আদালত ও থানাগুলোতে প্রতিনিয়তই মামলা হচ্ছে। তবে সাক্ষীর অভাব, মামলার চার্জশিট দাখিলে ধীরগতি ও তদন্তে গাফিলতিতে মামলা নিষ্পত্তির হার কমছে।

ফলে বাড়ছে মামলাজট। ভোগান্তিতে পড়ছেন বিচারপ্রার্থীরা। বছরের পর বছর বিচারের অপেক্ষায় থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন অনেকে। এদিকে বিচারক স্বল্পতার কারণে গত এক যুগে শুধু ঢাকার ৪০টি আদালতে মামলা বেড়েছে চারগুণেরও বেশি। সেখানে এখন মোট মামলার সংখ্যা চার লাখ ৫২ হাজার ৪৭১টি।

এর মধ্যে শুধু ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলার সংখ্যা ৭২ হাজার ৮৯২টি। বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বছরের পর বছর পার হয় কিন্তু তাদের মামলা শেষ হয় না। বিচার শেষ হওয়ার আগে অনেক আসামি মারাও যান। ফলে বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় হতাশ হয়ে রায়ের আশা ছেড়ে দেন।

এদিকে আদালতের বাইরে বিরোধ মীমাংসা, দরিদ্রদের আইনি সহায়তা এবং অনধিক দুই বছর মেয়াদে প্রথম দণ্ডিতদের জেলের পরিবর্তে তাদের বাইরে রাখার মতো পদক্ষেপগুলোর পরও বিচারে গতি আসছে না। আবার আদালতে সাক্ষী হাজির না হওয়ায় যাবতীয় সুবিধা পাচ্ছে আসামিপক্ষ।

এর ফলে বছরের পর বছর বিচারাধীন থাকা মামলায় আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা দুরূহ হয়ে পড়ছে রাষ্ট্রপক্ষের জন্য। দালানকোঠা কম। নেই বিচারকদের বসার পর্যাপ্ত জায়গা। মামলা ভারে ফাইল রাখার জায়গাও সংকুলান। আছে বিচারকেরও সংকট। যারা আছে তাদেরও কর্মদিবস চলে এজলাস ভাগাভাগি করে।

মূলত এসব আনুষঙ্গিক সমস্যার কারণেই ঢাকার ৪০টি আদালতে মামলাজট বেড়েছে। আর মামলা দায়েরের চেয়ে মামলা নিষ্পত্তির হার কমেই চলছে। এতেই সৃষ্টি হচ্ছে মামলার মহাজট। আবার অনেক মামলায় নির্ধারিত তারিখে সাক্ষীদের হাজির করতে ব্যর্থ হচ্ছে পুলিশ।

 কারণ হিসেবে পুলিশ বলছে, সাক্ষীদের অধিকাংশ ভাড়াটিয়া হওয়ায় তাদের বাসা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রেই আসামিপক্ষ সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে সাক্ষীদের আদালতে হাজির না করার ব্যবস্থা করে।

এমন অবস্থায় বিশ্লেষকরা বলছেন, মামলাজটের কারণ অনুসন্ধান ও তদারকি দরকার। এটা সুখের বিষয় যে, সরকার দীর্ঘদিন পর আট সদস্যের একটি সুপ্রিম কোর্ট সেল গঠনে লোকবল অনুমোদন করেছে। তবে সেটার সুফল মিলছে না বলে মনে করেন তারা।

তারা বলেছেন, বিচারক সংখ্যা বাড়াতেই হবে। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে গত সেপ্টেম্বরে, শুধু এক মাসেই শান্ত ও সহিংসতামুক্ত রাজধানী ঢাকায় পুলিশ বাদি হয়ে ৫৭৮টি নাশকতার মামলা করেছিল।

গত মাসে উপনিবার্চনকে কেন্দ্র করে নাশকতার দায়ে ১২০ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। লক্ষণীয় যে, ১ অক্টোবর, ২০১৮ পরবর্তী ৯০ দিনে সারা দেশে নতুন মামলার সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লাখে উন্নীত হয়। ৩০ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের আগে প্রতিদিন গড়ে মামলার সংখ্যা ছিলো প্রায় পাঁচ হাজার।

প্রতি ঘণ্টায় ২০৭টি মামলা হয়েছে। তবে এই সময়ে প্রতি ঘণ্টায় মামলা নিষ্পত্তির হার ছিলো ১৩২টি। ঢাকার আদালতগুলোতে মামলাজট সৃষ্টির প্রধান কারণ হিসেবে রাজনৈতিক মামলাকেই বেশি দায়ী করেছেন তারা।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আইনি পদ্ধতিতে মামলা নিষ্পত্তিতে বছরের পর বছর লেগে যায়। রায় যখন পাওয়া যায়, তখন আর প্রাসঙ্গিকতা থাকে না।

ফলে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি জোরদার করা দরকার। সর্বোচ্চ এক বা দুদিন মুলতবি করে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। বিচারাধীন মামলাগুলোর মধ্যে যেসব মামলা অনেক পুরাতন, কয়েকটা শুনানি করা গেলে নিষ্পত্তি করা সম্ভব, প্রথমে এসব মামলার তালিকা করতে হবে। এরপর দ্রুততম সময়ে শুনানি করে নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নিলে মামলাজট অনেকাংশে কমে যাবে। আদালতের প্রতি আস্থা জন্মাবে বিচারপ্রার্থীদের।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলার সংখ্যা ৭২ হাজার ৮৯২টি। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (সিএমএম) গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুই লাখ ৬৩ হাজার ২৭২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ বছরের অধিক পুরাতন মামলার সংখ্যা ১৫ হাজার ৫২১টি। বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে দুই লাখ ৪৭ হাজার ৩৮০টি। সিএমএম আদালতের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এপ্রিল, মে ও জুন এই তিন মাসে সিএমএম কোর্টে নতুন মামলা হিসেবে যোগ হয়েছে ১০ হাজার ৮৩২টি মামলা। পাঁচ বছরের অধিক পুরাতন মামলা রয়েছে ১৬ হাজার ৫৮টি। এছাড়া, জুলাই মাসে সাত হাজার ২১৭, আগস্টে ৯ হাজার ১৪৯ এবং সেপ্টেম্বরে ১২ হাজার ৩৪টি মামলা বিচারের জন্য যোগ হয়েছে।

এছাড়া, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা জেলায় (মহানগরসহ) ৯৯,৯৭৩টি দেওয়ানি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এদিকে কমছে মামলাজট, বাড়ছে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭২ হাজার ৩৯২-এ।  

জানা গেছে, ঢাকা মহানগর আদালতে মাদকদ্রব্য আইনে করা একটি মামলা ২৩ বছর ধরে বিচারাধীন রয়েছে। ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় এ মামলাটি করা হয়। যার নম্বর কোতোয়ালি থানা ৩০(০৪)৯৪। এ মামলার আসামি মেহেদী হাসান জামিনে আছেন।

২০০২ সালের ১৯ আগস্ট এ মামলায় অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এখনো সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়নি। মোট ১১ সাক্ষীর মধ্যে তিনজনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। অবশিষ্ট সাক্ষীদের মধ্যে আছেন তৎকালীন ডিএমপির সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক শেখ আলী হায়দার, সিআইডির আরেক পুলিশ পরিদর্শক পরিতোষ বণিক এবং জনৈক মো. শাহজাহান ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইউনুস চৌধুরী। বাকি চার সাক্ষীর নাম-ঠিকানা চার্জশিটে অস্পষ্ট।

এছাড়া সাক্ষী না আসায় ২৬ বছর ধরে ঝুলছে আরেকটি মামলা। এ মামলাটিও ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। অপর একটি মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পুরান ঢাকার বেগমবাজারের বাসিন্দা মো. মুকিম ওরফে জাফর। ২০০১ সালের আগস্টে রাজধানীর রমনা এলাকায় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন তিনি। এ ঘটনায় পুলিশ তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে রমনা থানায় মামলা করে। তদন্ত শেষে ২০০২ সালে চার্জশিট দাখিল করা হয়।

একই বছরের ১৪ নভেম্বর মামলার একমাত্র আসামি জাফরের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এখনো আট সাক্ষীর মধ্যে চারজনের সাক্ষ্যগ্রহণ বাকি রয়েছে। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর জাফর জামিন পান। এ মামলাটিও ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন।

ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতির সম্পাদক হোসেন আলী খান হাসান বলেন, দেশের আদালতগুলোতে মামলাজট নতুন কিছু নয়। তবে ঢাকার আদালতে মামলাজট অন্যজেলার চেয়ে অত্যধিক। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পর্যাপ্ত বিচারক দরকার কিন্তু এখানে সেটা নেই। আমরা বারের পক্ষ থেকে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে মামলাজট কমাতে প্রয়োজনীয় সংখ্যাক বিচারক নিয়োগের জন্য একাধিকবার চিঠি দিয়েছি কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সাড়া মেলেনি।  

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেছেন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি একান্ত প্রয়োজন। এতে তাড়াতাড়ি মামলা নিষ্পত্তি হবে। সমাজে শান্তি ফিরে আসবে। মামলা ফাইল হলে এটা মীমাংসা করা যায়। পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে। ক্রিমিনাল মামলাও এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়। এ ব্যবস্থা না হলে বিচার ব্যবস্থায় ধস নামবে। জনগণ দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচার পাচ্ছে না। এডিআরের ফলে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে মামলা করার প্রবণতা দূর হবে।

তিনি বলেন, বিচারাধীন মামলাগুলোর মধ্যে যেসব মামলা অনেক পুরাতন, কয়েকটা শুনানি করা গেলে নিষ্পত্তি করা সম্ভব, প্রথমে এসব মামলার তালিকা করতে হবে। এরপর দ্রুততম সময়ে শুনানি করে নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নিলে মামলাজট অনেকাংশে কমে যাবে। আদালতের প্রতি আস্থা জন্মাবে বিচারপ্রার্থীদের।

অতিরিক্ত মামলাজটের কারণ কি এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, মানুষকে ন্যায়বিচার দিতে হবে। মূল সমস্যা হলো সারা দেশে অহেতুক মামলা করার চলমান প্রবণতা বন্ধ না হওয়া। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, নিম্ন আদালত যদি যথাদায়িত্ব পালন করেন তাহলে হাইকোর্টের ওপর এত চাপ পড়ে না।

আমারসংবাদ/এআই