ইয়াসমিন নাহার
ডিসেম্বর ১৬, ২০২০, ০৯:১৫ এএম
ডিসেম্বর মাস আসলেই আমাদের মন বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত হয়, নিজেদের রাঙিয়ে ফেলি লাল সবুজ রঙে। কি ফেসবুকের ওয়াল কিংবা ব্যক্তিগত গাড়ি সব জায়গায় বিজয়ের রঙে রাঙানো। বিজয়ের গর্বে গর্বিত সবাই। এই যে আনন্দ, এই যে গর্ব, এই যে উল্লাস আয়োজন সবকিছুর উৎস অবশ্যই দেশপ্রেম, দেশের প্রতি ভালোবাসা।
কিন্তু দেশপ্রেম কি শুধুই লাল সবুজ বর্ণের মাঝে সীমাবদ্ধ? বিজয়ের মাসে লাল সবুজ বর্ণের নানা রকম পোষাকের সমাহার দেখা যায় বিভিন্ন নামীদামী ব্রান্ডে, তখন মনে হয় এই ভালোবাসা সে কি শুধুই পোষাকী?
যখন আমাদের ভাষা আন্দোলন হয়, ভাষার জন্য রাস্তায় নামাই ছিল দেশপ্রেম ঠিক তেমনি একইভাবে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়াই ছিল প্রকৃত দেশপ্রেম। কিন্তু এখন? এখন দেশপ্রেম কি? সক্রেটিস এর ভাষায় বলতে চাই এখন যে যেখানেই আছি, নিজের দায়িত্বটুকু ভালোভাবে সম্পাদন করাই দেশপ্রেম।
উদাহরণ দিয়ে বলবো, আপনি পথ চলছেন কোন খাবারের উচ্ছিষ্ট ফেলতে চান, আপনি যদি সেটা রাস্তায় রাখা ডাস্টবিনে ফেলেন তবে সেটাই হবে ঐ মুহূর্তে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হওয়া কাজ কারণ আপনি জনগণের চলাচলের পথ পরিচ্ছন্ন রাখতে সহায়তা করছেন। ঠিক তেমনি আপনি চলার পথে যদি ট্রাফিক আইন মেনে চলেন তবে সেটাও দেশপ্রেমের উদাহরণ কারণ আপনি দেশের আইন মেনে অন্যের চলাফেরায় সহায়তা করছেন।
মনে হতে পারে, এতো আপাত দৃষ্টিতে খুবই ক্ষুদ্র কাজ কিভাবে দেশপ্রেম হতে পারে? মনে রাখবেন হাসি মুখে কথা বলাও সদাকা আর আমাদের রাসূল (সঃ) বলেছেন, পথের পাথর, কাঁটা, হাড় অর্থাৎ কষ্টদায়ক জিনিস পথ থেকে সরানোও সদাকা (তিরমিযী)।
সুতরাং দেশপ্রেম প্রকাশ করতে হলে যে মাঠে ময়দানে শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকম্পিত করতে হবে সেটা সঠিক নয় বরং যখন যেখানেই আছি সে অবস্থাতেই দেশের জন্য কাজ করাই যথোপযুক্ত। একজন কৃষক যদি নিজের কাজটুকু ভালোভাবে করে, তবে দেশের ফলন ভালো হবে, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন হবে।
অন্যদিকে একজন গৃহিণী যদি নিজের কাজটুকু ভালোভাবে করে তবে তাঁর সন্তানই মানুষের মতো মানুষ হবে, দেশের ভাবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। একজন ছাত্র যদি নিজের প্রতি যত্নশীল হয়, ছাত্র হিসেবে তার দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করে তবে সে নিজে ভালো জায়গায় যেতে পারবে তেমনি দেশ পাবে একজন সুনাগরিক।
একজন গৃহিণী বা ছাত্র বা কৃষকের জন্য যেমন এই দায়িত্ব পালনের বিষয়টি দ্রুব সত্য ঠিক তেমনি সত্য দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য। বিশেষ করে যারা দেশের জন্য কোন দায়িত্বপূর্ণ পদে আছেন, তাদের জন্য এটা আরো বেশি প্রযোজ্য।
যেমন একজন বিচারক হিসেবে আমি মনে করি আমার নিজের দায়িত্বটুকু ভালোভাবে পালন করাই আমার প্রকৃত দেশপ্রেম। কিন্তু সেটা না করে ফেসবুকে যতো দেশপ্রেমের পোস্টই করি না কেন বা আমার বাসা-অফিস, গাড়িতে লাল সবুজের পতাকায় আচ্ছাদিত করি না কেন তাতে সামান্যতম দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে না বরং এটা হবে বাগাড়ম্বর ও দেশের প্রতি প্রতারণা।
দেশকে ভালোবাসতে হলে দেশকে ভালোভাবে জানতে হবে, বুঝতে হবে। দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যকে হূদয়ে ধারণ করতে হবে, লালন করতে হবে। ঠিক তেমনিভাবে দেশের মাটির উপর টান থাকতে হবে। অনেকেই একটু টাকা পয়সা হলে স্বপ্ন দেখে বিদেশের মাটিতে একটু সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের।
বিদেশের মাটিতে আমাদের দেশের অনেক পাড়াও গড়ে উঠেছে। অনেকেই আবার দুই এক দেশ থেকে ঘুরে এসে নিজের দেশকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন, এই ধুলো কাদা মাটিমাখা দেশকে খুব নোংরা অপরিচ্ছন্ন মনে করেন, ভুলে যান এই কাদা মাটিতেই তার বেড়ে উঠা।
অপর কিছু উচ্চ শিক্ষিত আছেন, উচ্চ শিক্ষা নিতে বিদেশে পাড়ি জমান কিন্তু দেশের কথা ভুলে সেখানেই নিশ্চিত আর উন্নত জীবনের আশায় স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। তারা ভাবেন তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিন্তু দেশের সন্তান হিসেবে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটুও কি ভাবেন? এদের ভেতরে বিদেশপ্রেম আছে কিন্তু স্বদেশপ্রেম নেই।
বিজয়ের মাসে আসুন প্রকৃত দেশপ্রেমের রঙে রঙিন হই, দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করি নিজের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে।
জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সাতক্ষীরা
আমারসংবাদ/এআই