Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

রোহিঙ্গাদের টার্গেট কেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া

মো. আবু সালেহ সেকেন্দার

জানুয়ারি ১, ২০২১, ০৭:১০ পিএম


 রোহিঙ্গাদের টার্গেট কেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া

রোহিঙ্গাদের দেশান্তরি হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। মিয়ানমারের সামরিক জান্তাদের নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে বাঁচতে তারা প্রতিবেশী মুসলিম দেশ বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়মিতই পাড়ি জমান। তবে সবসময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাড়ি জমানো রোহিঙ্গাদের সবাই মিয়ানমার থেকে সরাসরি ওই অঞ্চলে পাড়ি জমাননি। ওই রোহিঙ্গা মুসলিমদের অনেকেই ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময়ে দেশান্তরি হয়ে বাংলাদেশে বৈধ-অবৈধভাবে বসবাস করে আসছিলেন।

পরবর্তী সময়ে তারা বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে বলা যায়, মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নির্যাতন-নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা পেতে পালিয়ে প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশে বৈধ-অবৈধ আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা মুসলিমরা নানা কাজে যুক্ত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

ওইসব রোহিঙ্গা প্রধানত অবৈধ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন এবং কেউ কেউ অবৈধ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ও যুক্ত ছিলেন। কমমূল্যে শ্রম দেয়ায় স্থানীয় বাঙালিদের নিকট বাঙালি শ্রমিকের চেয়ে রোহিঙ্গা মুসলিম শ্রমিকদের চাহিদা অনেক বেশি। কিন্তু গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের প্রতি বিশেষ নজর দেয়ার ফলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে গোপনে কাজ করা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে তারা প্রায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।

দ্বিতীয়ত, এতদিন বাংলাদেশি পরিচয়ে ওইসব রোহিঙ্গা মুসলিমরা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিতো। কিন্তু সামপ্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে বিশেষ করে সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, সুদানে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও যুদ্ধবিগ্রহ বিরাজমান থাকায় ওই দেশগুলোয় বসবাস করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ওই দেশগুলোয় কর্মসংস্থানের সুযোগও একেবারে নেই বললেই চলে। ফলে তারা এখন আর ওই দেশগুলোয় পাড়ি দিতে আগ্রহী নয়।

অবৈধভাবে পাড়ি দেয়ার জন্য রোহিঙ্গা মুসলিমদের জন্য সৌদি আরব আর একটি বড় ক্ষেত্র ছিলো। তারা সৌদি আরবে বাংলাদেশি পরিচয়ে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে অবৈধভাবে পাড়ি দিতো। আর এ ক্ষেত্রে মানবপাচারকারী চক্র হজ ও ওমরাহকে ব্যবহার করে সৌদি আরবে রোহিঙ্গাদের পাঠাতো। ওমরাহর নামে তারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি সাজিয়ে সৌদি আরবে পাচার করতো।

কিন্তু বিভিন্ন সময়ে সৌদি আরবে বাংলাদেশ থেকে ওমরাহ করতে গিয়ে আর ফেরত না আসার বিষয়টি সৌদি সরকারের নজরে আসায় তারা সাময়িক সময়ের জন্য বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে ওমরাহর ভিসা স্থগিত করে। ফলে বাংলাদেশ সরকার এই বিষয়ে সজাগ হয়।

রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ বন্ধ করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে পাসপোর্ট সংগ্রহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের পক্ষে আর বাংলাদেশি পরিচয়ে সৌদি আরবে পাড়ি দেয়ার সুযোগটিও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

তৃতীয়ত, সমপ্রতি বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে হাতিয়া দ্বীপে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বাংলাদেশ সরকারের ওই পরিকল্পনা যদি বাস্তবায়িত হয়; তবে রোহিঙ্গাদের অবৈধ কর্মসংস্থান পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। হাতিয়ার ওই দ্বীপে সার্বক্ষণিক নজরদারি থাকায় তাদের পক্ষে অবৈধভাবে অন্যদেশে পাড়ি দেয়া কঠিন হবে।

তাই তারা দ্বীপের রোহিঙ্গা আবাসন প্রকল্পে যাওয়ার আগেই অবৈধভাবে অন্য দেশে পাড়ি দেয়াকে এখনই উপযুক্ত সময় মনে করছে। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রথম পছন্দ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। কারণ মিয়ানমার ও বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে পাসপোর্ট-ভিসার জটিলতা ছাড়া খুব সহজে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোয় পাড়ি দেয়ার অবারিত সুযোগই তাদের ওই অঞ্চলে পাড়ি দেয়ার প্রধান কারণ বলে চিহ্নিত করা যায়। বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নৌবাহিনীর তৎপর থাকলেও এই সমুদ্রপথের অনেকাংশই রয়েছে যেখানে কোনো দেশের নৌবাহিনী নিয়মিত টহল দেয় না।

ফলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের নৌবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে একবার গভীর সমুদ্রে পাড়ি দিতে পারলে থাইল্যান্ডের উপকূলে পৌঁছানো যায়। পরে থাইল্যান্ড থেকে অন্যদেশে পাড়ি দেয়ার ব্যবস্থা করা যাবে বলে দালালদের এমন আশ্বাসও তাদেরকে এ ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করছে। আর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সমুদ্রপথে যাওয়া যায় বলে খরচও পড়ে কম। মাছ ধরার ট্রলারে এক সঙ্গে বহু মানুষকে গদাগাদি করে সমুদ্র পাড়ি দেয়ার ব্যবস্থা করা হয় বলে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা হলেই এই সমুদ্র যাত্রায় শামিল হওয়া যায়।

অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র হওয়ায় রোহিঙ্গারা অন্য যেকোনো রাষ্ট্রের চেয়ে তারা মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে বলে মনে করেছেন। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী হওয়ায় ওই দুটি দেশে বিদেশি শ্রমিকের প্রচুর চাহিদা থাকায় কর্মসংস্থানেরও নিশ্চয়তা রয়েছে, যা রোহিঙ্গাদের ওই অঞ্চলের প্রতি আগ্রহী করেছে।

আর একটি কারণ এ ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ যা গণমাধ্যমে একেবারেই অনালোচিত রয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের ধারাবাহিকভাবে সাগর পাড়ি দেয়ার অন্যতম লক্ষ্য হতে পারে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কারণ রোহিঙ্গাদের ওপর কয়েক দশক যাবত মিয়ানমারের সামরিক জান্তা নির্যাতন-নিপীড়ন করলেও আন্তর্জাতিক মহল রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

তাই থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার মতো উন্নত দেশে পাড়ি দিয়ে খুব সহজে তারা আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে। তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে অর্থ সংগ্রহ করতে পারবে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রিত জীবনে তাদের পক্ষে মুক্তভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না।

তবে যে কারণেই রোহিঙ্গারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোয় পাড়ি দিক না কেন, বাংলাদেশ সরকারকে এখনই রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দেয়া বন্ধ করতে হবে। কারণ অনেক রোহিঙ্গা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোয় গিয়ে অনেক সময় বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে নানা অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে, যার দায়ভার বহন করতে হচ্ছে বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের।

তাই এমনটি চলতে থাকলে ওই দেশগুলোর বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে। ফলে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ওপর প্রভাব ফেলবে। করোনার কারণে বৈশ্বিক শ্রমবাজার এমনিতে সংকুচিত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

তার ওপর রোহিঙ্গাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের দায়ভার যদি বাংলাদেশিদের ওপর বর্তায় তাহলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শ্রমবাজার থেকে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত রেমিট্যান্স পাওয়ায় সমস্যায় পড়বে তা বলা যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা এই বিষয়টি ভাববেন বলে আশা করি।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আমারসংবাদ/এআই