Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪,

মুমিন জীবনে সত্যবাদিতার গুরুত্ব

মুফতী মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল

জানুয়ারি ৭, ২০২১, ০৭:০০ পিএম


মুমিন জীবনে সত্যবাদিতার গুরুত্ব

পৃথিবীতে একমাত্র সত্যের নাম মহান আল্লাহ এবং তার মনোনিত ধর্ম ইসলাম। কারণ ইসলামের বিধানগুলো সন্দেহাতিতভাবে সত্য হিসেবে প্রমাণিত এবং প্রতিষ্ঠিত। হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল(সা.) বলেছেন, ‘যে কাজের ব্যাপারে মনে সন্দেহ হয়, সে কাজ ছেড়ে দিয়ে সন্দেহমুক্ত কাজ করো। কেননা সত্য প্রশান্তিকর এবং মিথ্যা দ্বিধাযুক্ত’ (তিরমিজি, ২৫১৮)। হাদিসটি দ্বীনের অন্যতম মূলনীতি। ইসলাম মানুষকে সংশয় ও সন্দেহের অন্ধকার পথ পরিহার করে বিশ্বাসের আলোয় আলোকিত হওয়ার আহবান জানিয়েছে। তাকওয়া বা খোদাভীতিরও দাবি এটাই। সন্দেহজনক বিষয় মানুষকে হারামের পথে পরিচালিত করে।

অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট। এই দুয়ের মধ্যে রয়েছে সন্দেহজনক বিষয়। বেশিরভাগ মানুষ যা জানে না। অতঃপর যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয় থেকে বেঁচে থাকে, সে নিজের দ্বিন ও সম্মানকে ত্রুটিমুক্ত রাখে। আর যে ব্যক্তি সন্দেহজনক কাজে লিপ্ত হয়, সে হারামে লিপ্ত হয়’ (বুখারি, ৫২)।

ইমাম গাজ্জালী (র.)তার ‘ইয়াহিয়াউল উলুম’ গ্রন্থে সত্যবাদিতাকে ছয় ভাগে বিভক্ত করেছেন- (১) কথায় সত্যবাদিতা, (২) উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্যে সত্যবাদিতা, (৩) সংকল্পে সত্যবাদিতা, (৪) সংকল্প পূরণ করার ব্যাপারে সত্যবাদিতা, (৫) আমল বা কর্মে সত্যবাদিতা, (৬) দ্বীনদারীর ক্ষেত্রে সত্যবাদিতা।

অন্তরে পোষণ করা, মুখে উচ্চারণ করা এবং কর্মে বাস্তবায়িত করা- এই তিনটি সত্যবাদিতাই উপরোক্ত শ্রেণিসমূহের অন্তর্ভুক্ত। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারাই মুসলমান যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং কোনো প্রকার সন্দেহ পোষণ করেনি। আর আল্লাহর পথে নিজেদের জানমাল দ্বারা জেহাদ করেছে, এরাই সত্যবাদী লোক’ (সূরা হুজুরাত, ১৫)। 

এ থেকে বুঝা যায়, মানুষ সত্য কথা বলে মনে প্রশান্তি লাভ করে, যদিও তা নিজেদের বিরুদ্ধে যায়। অন্যদিকে মানুষ মিথ্যা বলে মানসিকভাবে চিন্তিত থাকে। ভয় করে লোকসমাজে আমার মিথ্যা ধরা পড়ে যায় কি না।

সত্যবাদিতার অনুসরণ ও মিথ্যাবাদিতা পরিহার একদিকে যেমন আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতি সাধন করে, অপরদিকে সামাজিক জীবনেও এর সুফল পাওয়া যায়। এর ওপরই সমূহ কল্যাণের ভিত্তি স্থাপিত। আল্লাহ তায়ালা কেবল সত্যবাদী হওয়ার নির্দেশই দান করেননি, বরং সর্বদা সত্যবাদীদের সহযোগিতা, তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং তাদের সাহচর্য লাভ করার প্রতিও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মোমেনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো’ (সূরা তওবা, ১১৯ )।

ইসলামের দৃষ্টিতে যেকোনো পরিস্থিতিতে সততা ও সত্যবাদিতায় সমূহ কল্যাণ ও মঙ্গল রয়েছে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘যদি আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা তারা সত্যে পরিণত করত, তবে তা তাদের জন্য কল্যাণকর হতো’ (সুরা মুহাম্মাদ, ২১)।

সত্যবাদিতার পুরস্কার জান্নাত, মিথ্যার শাস্তি জাহান্নাম। আর মানব প্রকৃতি সত্য দ্বারা পরিতৃপ্ত হয় এবং মিথ্যা মানুষের প্রকৃতিতে অস্থিরতা তৈরি করে। তার হূদয়কে বিক্ষুব্ধ করে। সত্য সাক্ষ্যদানের মাধ্যমেই মুমিনের ঈমানের সূচনা হয়; তাই মুমিনকে আমৃত্যু এই সত্য আঁকড়ে ধরে রাখতে হয়। বিশ্বাসের সঙ্গে প্রতারণা বা বিশ্বাসঘাতকতা আত্মপ্রবঞ্চনার শামিল। সত্য ছাড়া মানুষ মুমিন হয় না; মুসলমান কখনো অসত্যের অনুগামী হয় না। ইসলামে সব সময় সত্য বলা ও সত্য সাক্ষ্য দেওয়া ফরজ ইবাদত এবং জরুরি কর্তব্য বলে পরিগণিত। এই সততা চিন্তাচেতনায়, কল্পনায় ও পরিকল্পনায়। এই সততা মুখের ভাষায়। এই সততা যাবতীয় কর্মকাণ্ডে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গে, প্রতিটি পদক্ষেপে।

সত্যের বিপরীত বস্তু হলো মিথ্যা। মিথ্যা শয়তানের অন্যতম ধারালো অস্ত্র। মিথ্যা বলা কবিরা গুনাহ। মিথ্যাবাদী মানবসমাজের বড় শত্রু। মিথ্যাবাদীদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয় তারাই মিথ্যা আরোপ করে যারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহে বিশ্বাস করে না। প্রকৃতপক্ষে তারাই হলো মিথ্যাবাদী’ (সূরা নাহল, ১০৫)।

রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘এটি একটি বড় বিশ্বাসঘাতকতা যে তুমি তোমার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছ এবং সে তোমাকে বিশ্বাস করে, অথচ তুমি তাকে মিথ্যা বলছ’ (আততারগিব, ৩/৫৯৬)।

মিথ্যা বলার কারণে সমাজে কপটতার প্রসার হয়। কেননা সব ধরনের কপটতার উৎস হলো মিথ্যাবাদিতা। বহু অপরাধের সঙ্গে মিথ্যাবাদিতা জড়িত। যেমন-খেয়ানত, গুজব ছড়ানো, মাপে কম দেওয়া, চুক্তি ভঙ্গ করা ইত্যাদি। একটি মিথ্যা অনেক মিথ্যার জন্ম দেয়। একটি মিথ্যা প্রতিষ্ঠা করতে আরো অনেক মিথ্যা কথা বলতে হয়। যারা মিথ্যা কথা বলে তারা অন্যদেরও মিথ্যাবাদী মনে করে। ফলে সমাজে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়। এমনকি মিথ্যাবাদীরা নিজেদের ওপর থেকেও আস্থা হারিয়ে ফেলে। মিথ্যাবাদীরা সত্যকে গ্রহণ করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলে। মিথ্যাবাদীদের দায়িত্বজ্ঞান লোপ পায়। মিথ্যাবাদীদের সমাজে কোনো সম্মান থাকে না। তাই তারা নির্লজ্জের মতো যেকোনো ধরনের কাজে লিপ্ত হয়। এতে সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। সর্বোপরি মিথ্যাবাদীরা আল্লাহর রহমত ও হেদায়েত থেকে বঞ্চিত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মিথ্যাবাদী, অবিশ্বাসীকে সৎপথে পরিচালিত করেন না’ (সুরা যুমার, ৩)।

ইসলাম সত্যবাদিতার জন্য সকল প্রকারের ভয়-ভীতি ও নিন্দাকে উপেক্ষা করার আদেশ দিয়ে একে মুসলমানদের উন্নত নৈতিকতা বলে ঘোষণা করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এরা (সত্যবাদিরা) কোনো নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করে না’ (সূরা মায়েদা, ৫৪)।

রাসূলে করিম (সা:) বলেন,  কারো যদি সত্য কথা জানা থাকে, তাহলে বলা উচিত এবং এতে মানুষের ভয়-ভীতি প্রতিবন্ধক হওয়া ঠিক নয়। হজরত ইবনু মসউদ (রা:) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা:) বলেছেন, ‘সত্যবাদী হও, সত্যবাদিতা সৎ পথের সন্ধান দেয় এবং সৎপথ বেহেশতে নিয়ে যায়। যে ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বলে, আল্লাহর দরবারে তাকে সিদ্দিক বলে লেখা হয়’ (বুখারী, ৫৬২৯)।  অন্য হাদীসে এসেছে, ‘সত্যবাদিতা অন্তরের শান্তি স্বরূপ’ (তিরমিযি, ২৪৪২) । সত্য কথা বলার ইচ্ছা করতে থাকবে, চাই এতে কোনো বিপদ আসুক না কেন। স্মরণ রেখো, সত্য কথা বলাতেই নাজাত নিহিত রয়েছে।

প্রত্যেক মুসলমানের উচিত সত্যবাদিতার অনুসরণ এবং মিথ্যাবাদিতার পরিহার করা। সত্য মানুষকে রক্ষা করে এবং মিথ্যাচার ধ্বংস করে। এই নীতি অনুসরণ করা জান্নাত লাভের পথ। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সত্যবাদী এবং সত্য পথের যাত্রী হিসেবে কবুল করুন, আমীন।

লেখক : প্রভাষক (আরবী), চাটখিল কামিল মাদরাসা, নোয়াখালী।

ibrahim010187@gmail.com

আমারসংবাদ/জেআই