Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

জলবায়ু পরিবর্তন লবণাক্ততা ও উপকূলীয় নারী স্বাস্থ্য

সানজিদা শারমিন মাধু

জানুয়ারি ১৩, ২০২১, ০৫:২০ এএম


জলবায়ু পরিবর্তন লবণাক্ততা ও উপকূলীয় নারী স্বাস্থ্য

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিবেচনায় বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ও জীবন-জীবিকা এবং পরিবেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। উপকূলীয় এলাকায় প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাসের আঘাত নিয়মিত ঘটনা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে নিম্নাঞ্চল নিমজ্জিত ও লবণাক্ত পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

জার্মান ওয়াচ গ্লোবাল-এর জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিআরআই-২০২০) অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ শীর্ষ দশ দেশের একটি। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আন্তঃসরকারি প্যানেল (আইপিসিসি) ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, বাংলাদেশ ২০৫০ সালের মধ্যে এর ১৭ শতাংশ জমি এবং খাদ্য উৎপাদনের ৩০ শতাংশ হারাতে চলেছে। 

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ওই এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠী পরিবেশগত, অর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্যগত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে এবং বিশেষ করে নারীর স্বাস্থ্য ও জীবন-জীবিকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে। গত কয়েক দশকের হিসাবে উপকূলীয় এলাকায় পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। এ অঞ্চলে বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় গ্রীষ্মকালে পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ে। 

নারীরা দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজে পানি ব্যবহার করে গোসল করা, কৃষি কাজ, গবাদিপশু পালন, চিংড়ির পোনা ধরাসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজে লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে লিউকোরিয়াসহ সাধারণ পানিবাহিত রোগ এবং চর্মরোগের সংক্রমণে বেশি আক্রান্ত হয় নারীরা।

উপকূলীয় অঞ্চলে নারীরা যেসব অর্থনৈতিক কাজের সাথে জড়িত তার মধ্যে চিংড়ি মাছের পোনা ধরা ও  মাছের ঘেরে কাজ অন্যতম। এ এলাকার কয়েক লাখ নারী ও শিশু এ কাজে নিয়োজিত। লবণাক্ত পানিতে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি অনেক বেশি। লবণাক্ত পানির কারণে নারীরা এখন জরায়ু ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে ভুগছে। 

এক পরিসংখানে দেখা গেছে, দেশে প্রতিবছর যে কয়েক লাখ নারী জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ উপকূলীয় অঞ্চলের নারী।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততার ফলে জরায়ুসংক্রান্ত বিভিন্ন রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এসব এলাকার নারীরা। সে জন্য অল্প বয়সেই এ এলাকার নারীরা জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে জরায়ুসংক্রান্ত রোগে ভুগছেন এমন নারীর সন্ধান পাওয়া যাবে। 

দেখা গেছে, নারীদের জরায়ুসংক্রান্ত অসুখের তীব্রতা লবণাক্ততাপ্রবণ গ্রামগুলোতে বেশি। বিশেষ করে শ্যামনগর উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামেই জরায়ুসংক্রান্ত রোগে নারীরা আক্রান্ত, ডাক্তাররা রোগীদের জরায়ু কেটে ফেলার পরামর্শ দিচ্ছেন। নারীদের পুরো জরায়ু কেটে ফেলার পর অনেকের স্বামী তাদের ফেলে অন্যত্র বিয়ে করছেন।

২০১৮ সালে ‘সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবে লবণাক্ততা প্রভাব’ শীর্ষক একটি গবেষণায় বলা হয়, উপকূলীয় অঞ্চলে নারী ও কিশোরীরা মাসিকের সময় ব্যবহূত কাপড় ধুয়ে আবারো সেটি ব্যবহার করে এবং লবণাক্ত পানিতে গোসলসহ দৈনন্দিন কাজের কারণে তাদের জরায়ুসংক্রান্ত রোগের উপস্থিতি অনেক বেশি।

 জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উপকূলীয় এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি এবং গোসলসহ দৈনন্দিন কাজে অপরিচ্ছন্ন ও মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ত পানির ব্যবহারের ফলে শিশু থেকে কিশোরী এবং নারীরা লিউকোরিয়ায় ভুগছে।

বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে নারীদের গর্ভপাতের হার বেড়ছে। লবণাক্ত পানিতে চিংড়ির পোনা ধরা, মাছের ঘেরে কাজ করা, লবণাক্ত পানি পানসহ দৈনন্দিন কাজে নারীকে সবচেয়ে বেশি সময় থাকতে হয়। 

আইসিডিডিআরবির গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, খাবার পানির সঙ্গে যে পরিমাণ লবণ নারীদের দেহে প্রবেশ করছে, তার প্রভাবে দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের গর্ভপাত বেশি হয়। 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার নারীদের গর্ভপাতের প্রধান কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ত পানি বৃদ্ধিই দায়ী। ইউএনডিপির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী— গর্ভবতী নারী এবং কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ক্রমেই প্রকট হচ্ছে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির দৈনিক ৫ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া উচিত নয়। কিন্তু উপকূলীয় এলাকাতে জনগোষ্ঠীকে দৈনিক ১৬ গ্রামের অধিক লবণ খেতে হচ্ছে, যা দেশের অন্য এলাকার জনগোষ্ঠীর তুলনায় অনেক গুণ বেশি। 

খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন উপজেলার গর্ভবতী নারীদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণা অনুযায়ী, অতিরিক্তি লবণাক্ত পানি গ্রহণের ফলে নারীদের জরায়ু রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভকালীন খিঁচুনি, গর্ভপাত, এমনকি অপরিণত শিশু জন্ম দেয়ার হার বেড়েছে।

পুরুষেরা অর্থনীতির অন্যান্য আকর্ষণীয় খাতে যুক্ত হওয়ায় কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। গত ১৫ বছরে আমাদের দেশে কোনো খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়নি। খাদ্য উৎপাদনের গ্রাফ উচ্চমুখীই রয়েছে। শ্রমশক্তিতে জড়িত নারীদের প্রায় ৬৬ শতাংশ গ্রামীণ নারী। কৃষিতেও তাদের সংখ্যা বাড়ছে। 

২০১৭ সালের কৃষি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বিগত দুই দশকে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ১০৮ শতাংশ। অন্যদিকে পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে ২ শতাংশ। এ থেকে বোঝা যায়, নারীরা অভিযোজন বা সহনশীলতার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। 

উপকূলীয় অঞ্চলে নারীরা কৃষিসহ বিভিন্ন ধরনের পেশায় জড়িত রয়েছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় লবণাক্ত পানি প্রবেশের ফলে কৃষি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নারীরা অর্থনৈতিকভাবে অনেক ঝুঁকিতে রয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলায় উপকূলীয় এলাকায় বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট (বিসিসিটি) উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে। বিশেষ করে, লবণাক্ত পানি প্রবেশের ফলে কৃষিসহ জীবন-জীবিকা ও স্বাস্থ্যের বিরূপ ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় এসব প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন, লবণাক্ত  জলাবদ্ধতা ও পরিবেশ উন্নয়ন, প্রতিকূলতা সহিষ্ণু দানাশস্য, বীজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিতরণ, পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো উন্নয়ন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত কার্যক্রম, ঘূর্ণঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো নির্মাণের মতো কয়েকশ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। 

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার জনগোষ্ঠীর খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, জীবন-জীবিকার মানোন্নয়ন ও দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি মোকাবিলায় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কার্যক্রম গ্রহণ এবং মানুষ, জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় অভিযোজন, প্রশমন, প্রযুক্তি উন্নয়ন ও হস্তান্তর, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যেগ গ্রহণ করাই বিসিসিটির মূল লক্ষ্য।

সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় নারীদের স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক সমস্যার কথা বিবেচনা করে সুপেয় পানি এবং টেকসই জীবন-জীবিকার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা মোকাবিলা ও নারীদের জন্য জলবায়ু সহিষ্ণু জীবিকা সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছে। 

উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর বিশেষত নারীদের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত লবণাক্ততা মোকাবিলায় অভিযোজন বা সহনশীলতার সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ছয় বছর মেয়াদি (জানুয়ারি-২০১৯ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪) একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার ৫টি উপজেলার (কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, আশাশুনি ও শ্যামনগর) ৩৯টি ইউনিয়নের সাত লাখ মানুষ এ সুবিধা পাবে। 

প্রকল্পের আওতায় পরিবারের নারী সদস্যদের জলবায়ু সহিষ্ণু জীবিকার সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও বিপণনব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে অভিযোজন সক্ষমতা গড়ে তোলা ও দুই লাখ ৪৫ হাজার মানুষের জন্য লবণাক্ততামুক্ত, দুর্যোগ সহনশীল পানি সরবরাহের ব্যবস্থা ও সুপেয় পানি নিশ্চিত করা হবে। এছাড়া, এলাকায় ১০১টি নারী স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন, প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সহায়তার মাধ্যমে নারী সংবেদনশীল সতর্কীকরণ ও দুর্যোগ প্রস্তুতি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের সঠিক সময় এখনই। এর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সরকার সচেতনতা ও অভিযোজনবিষয়ক বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। 

সরকার সরাসরি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও দেশি-বিদেশি স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সরকারের এ কার্যক্রমের কার্যকরি বাস্তবায়নে উপকূলীয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। 

যেকোনো কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট/স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং তাদের সচেতনতার ওপর। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ এবং তাদের সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য, বিশেষ করে বর্তমান সময়ের নতুন গণমাধ্যম বা নিউ মিডিয়ার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। 

জনমত গঠনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন— ফেসবুক, ইউটিউব, ব্লগ, টুইটার, স্কাইপ, ম্যাসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসআপ, ভাইবার, ইমু এবং কমিউনিটি মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় জনমত গঠনে তাই গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে— এ দায়িত্ব আমাদের সকলের।
 

শিশু ও নারী উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম-বিষয়ক (পিআইডি) নিবন্ধ

আমারসংবাদ/এআই