Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

১২শ মামলার বিচারে স্থগিতাদেশ

জানুয়ারি ১৪, ২০২১, ০৪:৩০ এএম


১২শ মামলার বিচারে স্থগিতাদেশ

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলা নিষ্পত্তির হার খুবই কম। দু-একটা ঘটনার বিচার হলেও কেটে যায় বছরের পর বছর। আইনজীবীরা বলছেন, অধিকাংশ সময় আদালতে সাক্ষী হাজির না হওয়া ও মেডিকেল রিপোর্টে অসঙ্গতিতে মামলা প্রমাণে কঠিন হয়ে পড়ে। যার ফলে মামলা হলেই বিচারের অপেক্ষায় ঝুলে থাকে যুগের পর যুগ। 

আবার আইনি ঝামেলা এড়াতে সমঝোতায় শেষ হয় অধিকাংশ নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা। ফলে বিলম্বিত বিচারে বিনষ্ট হয় প্রমাণাদি ও সাক্ষীর সাক্ষ্য প্রদানেও আসে অনীহা। মাঝে মধ্যে সাক্ষী মারা যাওয়ায় মামলার কার্যকারিতাও হারিয়ে যায়। এতে বিপাকে পড়ে ভুক্তভোগী বিচারপ্রার্থীরা। কখনো কখনো আবার তদন্ত ও বিচার সংশ্লিষ্টদের গাফিলতিতেও বিচার বাধাগ্রস্ত হয় বলেও মত দেন তারা। 

এদিকে এ আইনের মামলাগুলো অগ্রাধিকারভিত্তিতে দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য উচ্চ আদালতের একাধিক নির্দেশনা থাকলেও সেটা উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। এদিকে ধর্ষণের ঘটনায় আইনি বিধিবিধান অনুসরণ ও ভুক্তভোগীর সুরক্ষা এবং যথাযথ প্রতিকার দ্রুত বিচার নিশ্চিতে ইতোপূর্বে হাইকোর্টে তিনটি রায়ও হয়। বরাবরই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা মামলা যথাসময়ে নিষ্পত্তির তাগিদ দেন সর্বোচ্চ আদালত। 

আবার সেই উচ্চ আদালতের আদেশেই বছরের পর বছর স্থগিত হয়ে আছে এ আইনে দায়ের হওয়া এক হাজার ২০০-রও বেশি মামলার বিচারকাজ। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন ভুক্তভোগীরা। স্থগিতাদেশের ফলে জামিনে বেরিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আসামিরা। কেউ কেউ আছেন পলাতকও। এ তালিকায় ২১ বছর ধরে স্থগিত রয়েছে ধর্ষণের মামলাও। 

এদিকে বিচারে দীর্ঘসূত্রতায় হতাশা প্রকাশ করে মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীরা বলছেন, নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার বিচার দ্রুত শেষ করতে হাইকোর্টের আগের নির্দেশনা মেনে মনিটরিং সেল গঠন করা উচিত। উচ্চ আদালতে এ ধরনের বিশেষ মামলার বিচারে কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা না থাকায় একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়ারও দাবি জানান তারা। 

দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা উচ্চ আদালতে যে হারে স্থগিত হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি হারে নারী ও শিশু আইনের মামলা স্থগিত হয় কেন- এর কারণ জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির আমার সংবাদকে বলেন, এর কারণ হলো দেশে যতগুলো ফৌজদারি আইন আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপব্যবহার হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের। এবং এখানে দেখা যায় ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট একজন অথচ মামলা করার সময় ১০-২০ জনকে জড়িয়ে মামলা করা হয়। তখন যারা ঘটনার সাথে জড়িত না তারা যখন উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয় তখন ওই মামলার বিচারকাজ হাইকোর্ট স্থগিত করে দেন। 

এভাবেই স্থগিতের হার বেড়ে গেছে। এর জন্যই মামলার প্রকৃত বিচার সম্ভব হয় না এবং বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। আর এসব মামলার ক্ষেত্রে আইনের অপব্যবহার বেশি হয়। ধর্ষণ মামলাগুলো প্রমাণের প্রধান নিয়ামক মেডিকেল রিপোর্ট। কিন্তু সেই মেডিকেল রিপোর্টগুলোই যথোপযুক্তভাবে পাওয়া যায় না আর সাক্ষীরাও আদালতে এসে সাক্ষ্য দিতে চান না। এজন্য এই মামলাগুলোর বিচার অনেক বিলম্বিত হয়। 

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা উচ্চ আদালতে যে হারে স্থগিত হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি হারে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা স্থগিত হয়। বিচারাধীন কিছু মামলা দ্রুত সুরাহার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট সমপ্রতি কিছু বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে নির্দিষ্টভাবে নারী নির্যাতন মামলার কথা উল্লেখ নেই। দেশের প্রায় ১০ ধরনের ট্রাইব্যুনালে করা সব ধরনের মামলার মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাই উচ্চ আদালতের নির্দেশে সব থেকে বেশি স্থগিত থাকছে। দেশের সব ধরনের ফৌজদারি অপরাধের বিচারে দীর্ঘসূত্রতার সঙ্গে তুলনা করে দেখা যাবে, নারীদের মামলাগুলোর বিচার হতেই বেশি সময় লাগছে।

স্থগিত মামলা নিষ্পত্তিতে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে জানতে চাওয়া হলে প্রধান আইন কমকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, স্থগিত থাকা মামলাগুলো দ্রুততার সাথে নিষ্পত্তির জন্য ইতোমধ্যে একাধিক বেঞ্চ গঠন করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে। আর রাষ্ট্রপক্ষ সব সময়ই পুরনো মামলা শুনানির জন্য আদালতে উত্থাপন করে। মামলার বাদিকেও এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে।

পরিসংখ্যান মতে, দেশে বিচারাধীন নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা রয়েছে এক লাখ ৭০ হাজার ৩৬১টি। এসব মামলার মধ্যে প্রায় ৩৪ হাজার মামলা পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিচারাধীন। আর উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত মামলা সংখ্যা প্রায় ১২ শতাধিক। 

এ অবস্থায় আইনজীবীদের অভিযোগ, উচ্চ আদালতের আদেশ থাকলেও দেশের বহু সরকারি ও বেসরকারি অফিসে নারী নির্যাতন সেল গঠন করা হয়নি। ধর্ষণের মামলা, তদন্ত ও বিচার বিলম্বের জবাবদিহিতা নেই, হাইকোর্টের সাত নির্দেশনা কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। তদন্তে ৯০ দিন, বিচারে ১৮০ দিনের সময়সীমাও মানা হচ্ছে না। তাই উচ্চ আদালতে ধর্ষণের মতো আলোচিত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে আলাদা বেঞ্চ গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন এসব আইনজীবী। ধর্ষণের ঘটনা রোধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন সংশোধনকে সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ বলেও মনে করছেন তারা। যদিও জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা মৃত্যুদণ্ডের বিধান নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। 

বর্তমানে প্রায় এক হাজার ৫০০ মামলা উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে বিচার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে উল্লেখ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ করার মাধ্যমে বিচারহীনতার ঝুঁকি সৃষ্টি করা হচ্ছে। সাধারণ ভুক্তভোগী যেখানে স্থানীয় পর্যায়ে থানা-পুলিশের কাছে যেতেই অনভ্যস্ত কিংবা হয়রানির শিকার হয়, সেখানে উচ্চ আদালত পর্যন্ত মামলা পরিচালনা করা তাদের কল্পনারও অতীত বিধায় অনেকেই আইনের এই মারপ্যাঁচ ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। দুঃখজনকভাবে এক ধরনের ধারণার জন্ম হয়েছে যে, সময় ক্ষেপণের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ করতে পারলে নতুন কোনো ঘটনার ডামাডোলে মানুষ এক সময় ভুলে যাবে এবং শাস্তি এড়ানো সম্ভব হবে।’

গেল বছরের শেষের দিকে সারা দেশে ধর্ষণের ব্যাপকতা বেড়ে যাওয়ায় ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ও সাজা দ্রুত কার্যকর করতে রাজপথে নামে সাধারণ জনগণ। টানা এক সপ্তাহের গণআন্দোলনের মুখে সরকার জনগণের দাবি আমলে নিয়ে জরুরি অধ্যাদেশ জারি করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড রেখে বিদ্যমান আইন সংশোধন করেন। 

এ বিষয়ে মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন কাউকে আসামি করা যাবে না, এতে মামলার গুরুত্ব হারিয়ে যায়। আইন সংশোধন করে কি লাভ? আগে বিচারে দীর্ঘসূত্রতা কমাতে হবে। ‘কেন ধর্ষণের ঘটনায় বিচার হয় না, কেন বিচারে দীর্ঘসূত্রতা- এটি সবার জানা। বারবার এ বিষয়ে কথা হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয় না। নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনায় দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই এই ধরনের অপরাধ কমানোর একমাত্র পথ। আইনে আছে ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। তারপরও উচ্চ আদালতকে নির্দেশনা দিতে হয়েছে। এরপরও দ্রুত ধর্ষণের বিচারে তেমন নজির স্থাপিত হয়নি, এটি দুর্ভাগ্যজনক।’

বিচারিক আদালতের রায়ের পর উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত : ২০১৫ সাল। টাঙ্গাইলের ১৩ বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এ ঘটনায় মামলা হয়। ধর্ষণের ওই মামলায় মেডিকেল রিপোর্ট ও ডিএনএ পরীক্ষা করে সাত মাসে চার্জশিট জমা দেয়া হলেও মামলাটির বিচারকাজের এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। ভিকটিমের সাক্ষ্য সম্পন্ন হয়েও কার্যক্রম থেমে আছে। সর্বশেষ সাক্ষ্য চলাকালীন উচ্চ আদালতে আবারো ডিএনএ টেস্টের আবেদন করে বিচারিক আদালতের কার্যক্রম স্থগিত করা আছে। 

এ মামলার আইনজীবী জানান, টাঙ্গাইলের ১৩ বছরের শিশু ধর্ষণের মামলা গত পাঁচ বছর ধরে ঝুলে আছে। যে মামলায় ডিএনএ টেস্ট আগে একবার হয়েছে সেই মামলা আবারো ডিএনএ পরীক্ষার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আদালত কোনো কারণ ছাড়াই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে এসে আবারো ডিএনএ টেস্ট চেয়ে স্টে অর্ডার নিয়ে রাখার কারণে এখন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে আছে। প্রসিকিউশন যদি এই বিষয়টি উচ্চ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষকে সঠিকভাবে জানাতে পারতো তাহলে হয়তো এমন কিছু নাও ঘটতে পারতো। মামলায় কালক্ষেপণের জন্য নানা আবেদন নিয়ে উচ্চ আদালতে যাওয়া ও স্টে অর্ডার চাওয়ার একটা প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। এই মামলায়ও সেটাই হয়েছে।

১৯৮৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর। মাঠে গরু চরাতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয় ১০ বছরের বালিকা। পরে শিশুটির বাবা ধর্ষক শওকতের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার চার্জ গঠন ও সাক্ষগ্রহণ শেষে শওকতকে সাত বছরের সাজা দেন খুলনার বিচারিক আদালত। দুই বছর পর ১৯৮৯ সালে মামলার কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করে আসামি। এরপর থমকে যায় বিচারের কার্যক্রম। হাইকোর্টের স্থগিতাদেশে প্রায় তিন বছর আটকে থাকে মামলার বিচারকাজ। তবে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্যোগে নিষ্পত্তি হয় মামলাটি। ৩১ বছর পর আপিলের রায় আসে। বিচারিক আদালতের সাজা বহাল রাখেন হাইকোর্ট।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে, ‘আসামি হাতেনাতে ধরা পড়লে তদন্ত করতে প্রথমে ১৫ দিন ও পরে ৩০ দিন এবং সর্বোচ্চ ৪৫ দিনে তদন্ত শেষ করতে হবে। আসামি হাতেনাতে ধরা না পড়লে ট্রাইব্যুনাল থেকে তদন্তের আদেশপ্রাপ্তির তারিখ থেকে প্রথমে ৬০ দিন এবং পরবর্তীকালে ৩০ দিনে অর্থাৎ সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। অন্যথায় তদন্ত শেষ না হওয়ার কারণ লিপিবদ্ধ করে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ বা তদন্তের আদেশ প্রদানকারী ট্রাইব্যুনালকে অবহিত করতে হবে।

আমারসংবাদ/এআই