Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

খাদ্যে ভেজাল মেশানো হারাম

মুফতী মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল

জানুয়ারি ১৪, ২০২১, ১১:২৫ পিএম


খাদ্যে ভেজাল মেশানো হারাম

জীবনধারণের জন্য রিযিক তথা খাদ্যের বিকল্প নেই। মহান আল্লাহ তায়ালা সকল জীবের একমাত্র প্রতিপালক এবং রিযিকদাতা। আল্লাহ প্রদত্ত সকল রিযিক শতভাগ নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর। সুস্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধিশালী জাতি গঠনে প্রয়োজন বিশুদ্ধ খাদ্য, যা দেহে পুষ্টি জোগায়, রোগ প্রতিরোধ করে ও বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।

কিন্তু উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের একটি শ্রেণি অধিক মুনাফার লোভে মনুষ্যত্ব ভুলে গিয়ে প্রাকৃতিক উপাদানে মিশিয়ে চলেছে প্রচুর মাত্রায় কেমিক্যাল, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন, আর্টিফিশিয়াল রং, ইউরিয়াসহ বিষাক্ত সামগ্রী। ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান দিয়ে তৈরি করছে পানীয়। এ সমস্ত কেমিক্যাল অত্যন্ত বিষাক্ত। আর প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ এসব খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে জীবন।

এমনকি এগুলো ক্যান্সারের ন্যায় মরণব্যাধিকেও ডেকে আনতে পারে। বিধায় খাদ্যে ভেজাল একটি অনৈতিক ও অমানবিক কাজ। এগুলো মুমিনেরতো নয় বরং মানুষেরই কাজ নয়। ইসলামে এ ধরনের কাজ চরমভাবে নিন্দিত। এতে কয়েক ধরনের অপরাধ জড়িয়ে আছে। এক. এটি প্রতারণা ও ধোকাবাজি। দুই. এটি মূলত অবৈধ পন্থায় অপরের অর্থ গ্রহণ যা আত্মসাতের শামিল। তিন. ভেজালমিশ্রিত খাদ্য বিক্রয়ের সময় মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কসম করতে হয়। চার. মানুষকে কষ্ট দেয়া। পাঁচ. মানুষকে শারিরীকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করা। খাদ্যে ভেজাল দেয়া ক্রেতার সাথে প্রতারণা।

অথচ রাসুল (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন পাপিষ্ঠ ব্যবসায়ী তথা যারা খাদ্যে ভেজাল মেশায়, ওজনে কম দেয়, মিথ্যা কথা বলে পণ্য বিক্রি করে, সর্বোপরি ক্রেতাকে ঠকায়, তাদের কঠোর শাস্তির জন্য জড়ো করা হবে।  তবে সেসব ব্যবসায়ী ছাড়া, যারা ব্যবসার কাজে আল্লাহকে ভয় করে চলে, কথা কাজে সৎ থাকে, (তিরমিজি)।

ব্যবসা করা ইসলামে সুন্নত ও সৎকর্ম বলে গণ্য হলেও সব ধরনের ব্যবসা ইসলামে বৈধ নয়। যে ব্যবসায়ে জুলুম, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, ঠকবাজি, মুনাফাখোরি, কালোবাজারি এবং হারাম জিনিস যেমন- মাদকদ্রব্য, শূকর, মূর্তি, প্রতিকৃতি ইত্যাদির ব্যবসা ইসলামে হারাম। নবী করিম (সা.) একদিন সালাতের জন্য বের হয়ে দেখতে পেলেন, লোকজন কেনাবেচা করছে। তখন তিনি তাদের ডেকে বলেন, ‘হে ব্যবসায়ী লোকেরা! কিয়ামতের দিন কিছু ব্যবসায়ী মহা পাপীরূপে উঠবে; তবে তারা নয়, যারা আল্লাহকে ভয় করবে, সততা, বিশ্বস্ততা সহকারে ব্যবসা করবে’ (তিরমিজি,  ১২১০)।

ন্যায্যমূল্যের বিনিময়ে ভেজালমুক্ত পণ্য পাওয়া ক্রেতা বা ভোক্তার অধিকার। কিন্তু ভেজালদানকারীরা ভোক্তাদের এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করে থাকে, যা ধর্মে নিষিদ্ধ। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে লোক শপথ করে কোনো মুসলমানকে বৈধ অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত এবং জান্নাত হারাম করে দেন।’ এক ব্যক্তি আরজ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তা যদি খুবই সামান্য বিষয় হয়?

তিনি বলেন, ‘যদি একটা গাছের কাটা ডালও হয় তবুও’ (সহিহ মুসলিম)। রাসুল (সা.) আল্লাহর ইবাদত তথা ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা ও চর্চা এবং দ্বীনি দাওয়াতের জন্য মদিনায় মসজিদ নির্মাণ করেছেন, তেমনি মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য মদিনায় তিনি ইসলামী বাজার প্রতিষ্ঠা করেছেন। বনু কায়নুকার বাজারটির পরিচালনার দায়িত্বভার তিনি নিজেই নিয়েছিলেন। এ বাজারটির বৈশিষ্ট্য ছিল- এখানে কোনো রকম ধোঁকা-প্রতারণা, ঠকবাজি, মাপে কম-বেশি করার বা পণ্যদ্রব্য মজুদ অথবা আটক করে কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধি করে জনগণকে কষ্ট দেয়ার সুযোগই ছিল না।

হযরত আবূ হরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন - একদা রাসূল (স.) বাজারে এক খাদ্য স্তুপের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি খাদ্য স্তুপের ভিতরে হাত প্রবেশ করিয়ে দেখলেন ভিতরের খাদ্যগুলো ভিজা। তিনি খাদ্য বিক্রেতার নিকট জানতে চাইলেন - এটি কেমন কথা? সে বলল- বৃষ্টিতে ভিজে গেছে, হে আল্লাহর রাসূল! তদুত্তরে রাসূল (স.) বললেন - তাহলে তুমি খাদ্যগুলো উপরে রাখনি কেন, যাতে মানুষ দেখতে পেত। অতঃপর নবি (স.) বললেন- যে ব্যক্তি প্রতারণা করবে সে আমার উম্মাত নয়, (মুসলিম, ১০২)।

মানুষ হয়ে মানুষের ক্ষতি করে যারা পবিত্র ও স্বাস্থ্যকর খাবারের সঙ্গে লুকোচুরির মাধ্যমে অপবিত্র ও অস্বাস্থ্যকর বর্জ্য পদার্থ এমনকি রোগাক্রান্ত হওয়ার মতো দূষিত উপকরণ মিশ্রণ করে, তারা দেশ ও জাতির শত্রু, ইসলামের দৃষ্টিতে মস্ত বড় গুনাহগার। ঈমানদারির কারণেই ভেজালমুক্ত খাদ্যসামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় ও সরবরাহ করা উচিত। যেহেতু ভেজাল খাদ্য-পানীয় মানবদেহের জন্য অকল্যাণকর, ক্ষতিকর ও নিষিদ্ধ সামগ্রীর অন্তর্ভুক্ত, তাই তা সর্বাবস্থায় পরিহার করা অপরিহার্য।

সুতরাং ভেজালের ব্যবসা যেমন হারাম, তেমনি তা খাদ্য হিসেবে গ্রহণও হারাম। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি তাদের জন্য পবিত্র বস্তুসামগ্রী হালাল করেন এবং অপবিত্র বস্তুসমূহ হারাম করেন’ (সূরা আরাফ, ১৫৭)। খাদ্যে ভেজাল দেয়ার অর্থ হলো সত্যের সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণ।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা সত্যের সঙ্গে অসত্যের মিশ্রণ ঘটাবে না এবং জেনেশুনে সত্য গোপন কোরো না’ (সুরা বাকারা, ৪২)। কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তিন ব্যক্তির দিকে ফিরেও তাকাবেন না। তাদের একজন হলো- যে তার ব্যবসায়িক পণ্য মিথ্যা কসম খেয়ে বিক্রি করে’ (মুসলিম, ১০৬)। খাদ্যে ভেজাল শুধু মানুষের মানসিক ও আর্থিক ক্ষতিই করে না, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তা মানুষের জীবনও নষ্ট করে দেয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সে, যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ এবং প্রকৃত মুমিন সে, যার পক্ষ থেকে অন্য মানুষের জান ও মালের কোনো শঙ্কা থাকে না’ (তিরমিজি, ২৬২৭)।

খাদ্যে ভেজাল একটি অনৈতিক, অমানবিক ও জাতি বিধ্বংসী নীরব গণহত্যা। এসব কোনো মুসলমান ও বিবেকবান মানুষের কাজ নয়। প্রতিনিয়ত ভেজাল খেয়ে সরাসরি রোগাক্রান্ত হয়ে মরছে হাজার হাজার মানুষ। তাই এ কথা বলা যায়, ‘ভেজাল খাদ্য’ নামের নীরব ঘাতকের শিকার লাখ লাখ মানুষ। অথচ মহান আল্লাহ বলেছেন,  ‘তোমরা পরস্পরকে হত্যা কোরো না’(সুরা নিসা, ২৯)। চলবে

লেখক : প্রভাষক (আরবী), চাটখিল কামিল মাদরাসা, নোয়াখালী।

ibrahim010187@gmail.com 

আমারসংবাদ/জেআই