Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

বন্ধের পথে জিল বাংলা চিনিকল

এম এ রাজ্জাক মিকা, দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর) ঁঁ

জানুয়ারি ১৪, ২০২১, ১১:৩৫ পিএম


বন্ধের পথে জিল বাংলা চিনিকল

জিল বাংলা চিনিকল লিমিটেড; উত্তর বাংলার সবচেয়ে ভারী শিল্পের নাম। বাংলাদেশে যে কয়টি চিনিশিল্প রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্টমানের চিনি উৎপাদনকারী চিনিশিল্প জিল বাংলা চিনিকল আজ কর্তৃপক্ষের সীমাবদ্ধতা আর আখের উৎপাদন সংকটে ধ্বংসের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। অস্তিত্বের টানাপড়েনে দেশের এই খ্যাতনামা চিনিশিল্প।

বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে এলাকার আখচাষিরা দিন দিন আখচাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ফলে ক্রমেই উৎপাদন হ্রাস পেয়ে লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জিল বাংলা চিনিকল লিমিটেড। অথচ আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদনের শুরুর থেকে মিলটি লাভের অংক গুনে উৎকৃষ্টমানের চিনি উৎপাদনের গৌরব অর্জন করেছিল। এ মিলে উৎপাদিত চিনির আলাদা গুণগত ও মানগত উৎকৃষ্টতার জন্য মিলটি দেশের সর্বত্র খ্যাত ও সুপরিচিত।

১৯৫৮ সালে ১৫১ একর জমির ওপর জিল বাংলা চিনিকল লিমিটেডটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে জিল বাংলা চিনিকলে শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা ৬০০ জন। তার মধ্যে স্থায়ী ২৪৪ জন, মৌসুমী ২৮৩ জন, কর্মকর্তা ৩৫ জন ও চুক্তিভিত্তিক ৩৮ জন। পদ শূন্য রয়েছে ৩৮৯টি। স্বাধীনতার আগে মিলটির নাম ছিলো জিল পাক চিনিকল লিমিটেড।

এ মিলের চিনি উৎকৃষ্টমানের বলে এ মিলের সব চিনি পাকিস্তানে নেয়া হতো। স্বাধীনতার পর মিলটির নাম দেয়া হয় জিল বাংলা চিনিকল লিমিটেড। শুরুর দিকে মিলটি প্রতিদিন এক হাজার ১৬ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে প্রায় ৬৫ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করে লাভের অংক গুনেছে। বিগত কয়েক বছর থেকে কর্তৃপক্ষের সীমাবদ্ধতা ও বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে এ মিল অঞ্চলের চাষিরা আখচাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ফলে প্রতি বছর লোকসানের বোঝা টানতে হচ্ছে মিলটিকে।

অথচ আখ উৎপাদনে লাভের পরিমাণ বেশি বলে এ অঞ্চলের চাষিরা আখচাষে আগ্রহী। এক বিঘা জমিতে আখচাষ করে উৎপাদন ব্যয়ের তিনগুণ লাভ হয়। বিঘাপ্রতি আখ চাষে ব্যয় ১৪ হাজার টাকা (মিলে আখ সরবরাহসহ) এবং বিঘা প্রতি ৩০০ মণ ফলন হলে মিলে আখ সরবরাহ করে চাষিরা পান প্রায় ৪০ হাজার টাকা।

এ অঞ্চলের জমি পলি দো-আঁশ। প্রতিবছর বন্যায় পলি জমে বলে এ অঞ্চলে অন্যান্য ফসলের তুলনায় আখের ফলন ভালো হয়। এ কারণে লাভবান বলে এ অঞ্চলের চাষিরা আখচাষে বেশি আগ্রহী। মরাডুবুরী, কুলকান্দি, চিকাজানী, ফারাজীপাড়া, গুলুরঘাট, পোল্যাকান্দি, সর্দারপাড়া, চরবাহাদুরাবাদ, দিঘলকান্দি, গায়েনপাড়া, উৎমারচর, গামারিয়া, বাহাদুরাবাদ, নাজিরপুর, কাজলাপাড়া, চরডাকাতিয়া, ঝালরচর, সবুজপুর, মাইছানীরচর, মদনেরচর, মাদারেরচর, ইসলামপুর এ মিলের আওতাধীন প্রধান আখ উৎপাদনকারী অঞ্চল। এ অঞ্চলে চাষকৃত আখের জাত উন্নত ও অধিক লাভজনক। ঈশর্দী ১৬, ২৬, ৩০, ৩৩ থেকে ঈশর্দী ৪০ এবং বিএসআরআই ৪৩ থেকে বিএসআরআই ৪৬ চাষ করেন চাষিরা। এসব জাতের আখে স্বল্প ব্যয় ও তুলনামূলক কম শ্রম বিনিয়োগ করলেই বিঘাপ্রতি ৩০০ থেকে ৪০০ মণ আখ উৎপাদন করা যায়।

জিল বাংলা চিনিকল লিমিটেডের ৫৪ একর নিজস্ব বীজতলা রয়েছে। এখানে উন্নত জাতের বীজ উৎপাদন করে চাষিদের মাঝে চাষের জন্য বিতরণ করা হয়। দরিদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের আখচাষে দাদন হিসেবে বীজের পাশাপাশি সার কীটনাশকও প্রদান করা হয়। তথাপিও কিছু সুনির্দিষ্ট ক্রটি-বিচ্যুতির জন্য চাষিরা দিন দিন আখচাষ থেকে সরে যাচ্ছেন। ক্রটি-বিচ্যুতির মধ্যে মিলে আখ সরবরাহের অনুমতিপত্রের (পূর্জি) সুষম বণ্টনের অভাব ও সীমাবদ্ধতা, মিলে আখ সরবরাহ করে সঠিক সময়ে আখের মূল্য না পাওয়া, আখ সরবরাহ ও আখের মূল্য প্রাপ্তিতে বিলম্ব অন্যতম। এসব কারণে আখচাষে চাষিরা দিন দিন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।

আখের উৎপাদন কমের কারণে মিলটি এখন পূর্ণ মৌসুমে আখ মাড়াই করতে পারছে না। মোট ৩৩টি আখ ক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে আখ ক্রয় করে মিলটি চিনি উৎপাদন করে থাকে। আখ ক্রয়কেন্দ্রের মধ্যে কাজলাপাড়া, চরডাকাতিয়া, চরভাটিপাড়া, চরভাটিপাড়া ১, বাহাদুরাবাদ ১, বাহাদুরাবাদ ২, বাসেতপুর, কাঠারবিল, তারাটিয়া, মাইছানীরচর, মাদারেরচর, মেরুরচর, গোয়ালেরচর, টুপকারচর, চিনাডুলি, ইসলামপুর, সবুকুড়া, পলবান্ধা, গংগাপাড়া, গিলাবাড়ী, জারুলতলা, দূরমুঠ, চরদাদনা, মেলান্দহ, পাথালিয়া, মাহমুদপুর, রাজনপুর, নান্দিনা, বৈঠামারী, গোলাবাড়ী, ঢেউয়েরচালা, পশ্চিমখামার ও মিল গেট।

গত ৫ বছরের রেকর্ড অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ আখ মাড়াই মৌসুমে ৭০ দিনে ৫৮ হাজার ৫৩৫মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে চিনি উৎপাদন করে চার হাজার ৭৯ মেট্রিক টন, লোকসান দিয়েছে ৩৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ আখ মাড়াই মৌসুমে ৭৮ দিনে ৬২ হাজার ৪৩৪ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে চিনি উৎপাদন করে চার হাজার ৬৬৯ মেট্রিক টন, লোকসান দিয়েছে ৩২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ আখ মাড়াই মৌসুমে ১০২ দিনে ৮৩ হাজার ৩৫৩ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে চিনি উৎপাদন করে পাঁচ হাজার ৬০৮ মেট্রিক টন, লোকসান দিয়েছে ৩৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ আখ মাড়াই মৌসুমে ১০১ দিনে ৮৩ হাজার ৫০৪ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে চিনি উৎপাদন করে পাঁচ হাজার ২২২ মেট্রিক টন, লোকসান দিয়েছে ৬২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ আখ মাড়াই মৌসুমে ৮৫ দিনে ৭০ হাজার ৬৮৯ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে চিনি উৎপাদন করে পাঁচ হাজার ১৫৩ মেট্রিক টন, লোকসান দিয়েছে ৫৬ কোটি টাকা। চলতি ২০২০-২১ আখ মাড়াই মৌসুমে ৮০ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে চিনি উৎপাদনের লক্ষমাত্রা ধার্য করা হয়েছে ছয় হাজার ২০০ মেট্রিক টন।

মিলটি আধুনিকায়ন করা হলে দৈনন্দিন আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। চাষিদের মাঝে আখ সরবরাহের অনুমতিপত্রের (পূর্জি) সুষম বণ্টন, আখ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যে চাষিদের মাঝে আগাম সার বীজ কীটনাশক সরবরাহ করে চাষিদের আখচাষে উদ্বুদ্ধ করণ ও মিলে সরবরাহকৃত আখের মূল্য চাষিদের মাঝে সঠিক সময়ে বিতরণ করা হলে আখ উৎপাদনে আগ্রহী হবে চাষিরা, বৃদ্ধি পাবে আখচাষ। আর আখচাষ বৃদ্ধির ফলে মিলটি শতপ্রতিকূলতা ডিঙিয়ে লাভের অংক গুনে আবারো মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে সগৌরবে।

জিল বাংলা চিনিকল লিমিটেডের ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. রায়হানুল হক রায়হান বলেন, সরকার মিলটিকে টিকিয়ে রাখতে তৎপর কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার জন্য মিলটি প্রতি বছর লোকসান গুনছে। মিলটির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন অবহেলা-অনিয়ম দূর করতে পারলেই কেবল মিলের লোকসান কাটানো সম্ভব। চাষিদের মাঝে আগের মতো সার বীজ কীটনাশক বিতরণ করে মাঠপর্যায়ে আখের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করলে আখের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। আর আখের উৎপাদন বৃদ্ধি ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন অবহেলা-অনিয়ম দূর করতে পারলেই টিকে থাকবে মিলটির ঐতিহ্য ও অস্তিত্ব।

জিল বাংলা চিনিকল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফ আলী বলেন, মিলটির লোকসানের অন্যতম কারণ হচ্ছে উৎপাদনের চেয়ে উৎপাদন ব্যয় অধিক। এ মিলে চিনি উৎপাদন ব্যয় প্রতি কেজি ১১৬ টাকার উপরে। অন্যদিকে এক বছরের ফসল আখচাষে চাষিরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোনো প্রকার গড়িমসি, অনিয়ম বা দুর্নীতি নেই। মিলটির যন্ত্রাংশ পুরনো হওয়ার ফলে দৈনিক আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হচ্ছে না। এ কারণে চাষিদের আখ ক্রয় করতে সময়ক্ষেপণ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে লোকসানের আরেকটি অন্যতম প্রধান কারণ এ মিলের সোনালী ব্যাংকে ২০৫ কোটি, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের কাছে ২০৮ কোটি এবং ২৫ কোটি টাকা সরকারি ঋণ রয়েছে। প্রতি বছর যে ঋণের সুদ দিতে হয় ৩২ কোটি টাকা। ঋণ পরিশোধ করে চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি পণ্যের বহুমুখীকরণ করা হলে এ মিল লাভের অংক গুনতে পারবে।

আমারসংবাদ/জেআই