Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

বিষমুক্ত সবজিতে নজর সরকারের

জানুয়ারি ১৯, ২০২১, ০৬:৩৫ পিএম


বিষমুক্ত সবজিতে নজর সরকারের
  • সারা দেশে ১০ মডেল ইউনিয়নে নিরাপদ সবজিচাষ
  • যশোর ও বগুড়ার বাঁধাকপি যাচ্ছে মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরে
  • বিদেশে বিষমুক্ত সবজির চাহিদা ব্যাপক, কৃষক লাভবান হবে- ডিজি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর

দেশে সবজিচাষের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছে। বর্তমানে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। উৎপাদনে আরও এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি কতটা কেমিক্যাল বা বিষমুক্ত করে উৎপাদন করা যায় সেদিকেই এখন নজর দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

চলতি মৌসুমে দেশের ১০ উপজেলার ১০ ইউনিয়নে ‘আইপিএম মডেল ইউনিয়ন’ হিসেবে বিষমুক্ত সবজিচাষ শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিষমুক্ত সবজির চাহিদা দেশজুড়ে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও চাহিদা বাড়ছে বিষমুক্ত সবজির। ইতোমধ্যে যশোর এবং বগুড়ার শিবগঞ্জ থেকে ‘আইপিএম মডেল ইউনিয়ন’র চাষকৃত বাঁধাকপি রপ্তানি শুরু হয়েছে। আরও কয়েকটি মডেল ইউনিয়নের বিষমুক্ত সবজি রপ্তানির প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।

জানা যায়, বাংলাদেশ তো বটেই বিশ্ববাজারে অর্গানিক (জৈব) সবজি ও ফলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। জৈব প্রযুক্তিতে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দামও তুলনামূলক বেশি। অন্যদিকে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহারে তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। বাড়ছে উৎপাদন খরচ। দূষিত হচ্ছে মাটি, পানি ও বাতাস। দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।

এসব সমস্যা থেকে কৃষক ও পরিবেশকে বাঁচাতে দেশে প্রথমবারের মতো ১০ উপজেলার ১০ ইউনিয়নকে মডেল হিসেবে নিয়ে কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের আইপিএম প্রকল্পের আওতায় ১০০ একর করে মোট এক হাজার একর জমিতে বিষমুক্ত নিরাপদ সবজিচাষ হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্পের আওতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ‘আইপিএম মডেল ইউনিয়ন’-এ বিষমুক্ত সবজিচাষ করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, প্রকল্পের অধীন দেশের ১০ উপজেলায় আইপিএম মডেল ইউনিয়ন গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি আইপিএম মডেল ইউনিয়নের ২৫টি দলে আটজন নারীসহ ২০ জন করে কিষান-কিষানি সমন্বয়ে ৫০০ কিষান-কিষানি ১০০ একর জমিতে জৈব কৃষি ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে রবি মৌসুমের সবজি উৎপাদন করছেন। সবজির মধ্যে রয়েছে— টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, শসা, লাউ, মরিচ ইত্যাদি। প্রকল্পভুক্ত এসব সবজিক্ষেতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে পরিবেশবান্ধব ভার্মি কম্পোস্ট। ক্ষতিকর পোকা-মাকড় দমনের জন্য রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ, হলুদ আঁঠালো ফাঁদ, নেট হাউস, জৈব বালাইনাশক, ইকোমেকস, বায়োট্রিন ইত্যাদি।

প্রকল্পভুক্ত কৃষকদের বিনামূল্যে সবজির চারা উৎপাদনের জন্য বীজ, কেঁচো সার, সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ, জৈব বালাইনাশক ও নগদ অর্থ দিচ্ছে কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর। এসব ব্যবহার পদ্ধতির ওপর কিষান-কিষানিদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। শেখানো হয়েছে ফাঁদ স্থাপনের কায়দা-কৌশল।

প্রকল্পভুক্ত ১০টি ‘আইপিএম মডেল ইউনিয়ন’ হচ্ছে- যশোর সদর উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়ন, ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার রামপুর ইউনিয়ন, কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার ইলিয়টগঞ্জ দক্ষিণ, শেরপুরের লালিতা বাড়ি উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলার মুশুদ্দি ইউনিয়ন, বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার দেউলিয়া ইউনিয়ন, দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার সাতোর ইউনিয়ন, পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার লক্ষী কুন্ডা ইউনিয়ন, ঢাকার ধামরাই উপজেলার ছানুরা ইউনিয়ন এবং রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়ন।

পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক আহসানুল হক চৌধুরী আমার সংবাদকে জানান, এ বছর ১০টি উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন নির্বাচন করা হয়েছে। আগামীতে কৃষককে তাদের নিজ উদ্যোগেই ফসল ফলাতে হবে। আগামী বছর আরও ১০ উপজেলার ১০টি ইউনিয়নকে আইপিএম মডেল ইউনিয়ন হিসেবে নির্বাচন করা হবে। মূলত সবজিপ্রধান এলাকাকেই অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে পরীক্ষামূলকভাবে এই ‘আইপিএম মডেল ইউনিয়ন’র কর্মসূচি। এটি সফল হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মনে করলে এর পরিধি আরও বাড়তে পারে বলে মনে করেন এই কৃষিবিদ।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আসাদুল্লাহ আমার সংবাদকে জানান, আইপিএম মডেল ইউনিয়নের মাধ্যমে সবজিচাষে কৃষকরা খুবই উদ্বুদ্ধ। কারণ অনেকেই তো সবজিচাষে বিষ দেয়। আমরা চেষ্টা করছি বিষ যাতে না দেয়, কম বিষ দেয়। কীটনাশক না দিয়ে যাতে সবজি উৎপাদন করতে পারে কৃষক এবং আমরা যাতে নিরাপদ খাদ্য পেতে পারি— সেভাবেই কৃষককে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়। দেশে যথেষ্ট সবজি উৎপাদন হচ্ছে। এখন সবজির দাম নেই। কৃষক পয়সা পাচ্ছে না। যদি নিরাপদ (কেমিক্যালমুক্ত) সবজি হতো তাহলে দেশের বাইরে রপ্তানি করা যেতো; কৃষকও পয়সা পেতো। সেজন্য আমরা মডেল ইউনিয়ন ধরে বিষমুক্ত নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্ব দিয়েছি। আগামীতে এ কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করা হবে।

যশোর-শিবগঞ্জের বাঁধাকপি যাচ্ছে মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরে

১০টি ‘আইপিএম মডেল ইউনিয়ন’র মধ্যে যশোর সদর উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নও রয়েছে। স্থানীয় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাজ্জাদুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, গত ৫ জানুয়ারি থেকে গত সোমবার পর্যন্ত প্রায় ১২০ টন বাঁধাকপি মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে রপ্তানি হয়েছে। ৫০০ টনের চাহিদা রয়েছে। আমাদের দেশে যেমন বিষমুক্ত সবজির চাহিদা বেশি, তেমনি বিদেশেও যারা নিচ্ছেন তারাও বিষমুক্ত সবজিই চাচ্ছেন। সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক ও জাগরণী ফাউন্ডেশন নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাঁধাকপি রপ্তানি হচ্ছে। মডেল ইউনিয়ন থেকে ৬১ টন বাঁধাকপি দেয়া সম্ভব হয়েছে। বাকিটা উপজেলার অন্য এলাকা থেকে দেয়া হচ্ছে।

তিনি জানান, যশোর সদর উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নের ১০০ একর জমিতে আমরা প্রজেক্টের আওতায় প্রদর্শনী করেছি। এর মধ্যে ৯০ একর জমিতে বাঁধাকপি এবং বাকি ১০ একর জমিতে বেগুন ও টমেটোচাষ করা হয়েছে। এই প্রদর্শনীর বাইরে এই ইউনিয়নে ব্যক্তি উদ্যোগে আরও প্রায় ৩০০ একরেরও বেশি জমিতে বাঁধাকপি চাষ হয়েছে। পুরো যশোর সদর উপজেলায় প্রায় তিন হাজার একর জমিতে বাঁধাকপি, ফুলকপিসহ অন্যান্য সবজিচাষ হয়েছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আরও জানান, স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে এটি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। স্থানীয় বাজারে যেখানে একটি দেড় কেজি ওজনের বাঁধাকপির দাম পাইকারীভাবে ৫-৭ টাকা করে বিক্রি করে থাকেন কৃষক, সেখানে মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরের বায়ারদের কাছে প্রতি পিস ৯ টাকা করে পাচ্ছেন কৃষক। তার মতে, বাঁধাকপি উৎপাদন অনেকটাই লাভজনক। এক বিঘা জমিতে বাঁধাকপি উৎপাদনে খরচ পড়ে ১৫-২০ হাজা টাকা। আর সবজি বিক্রি হয় ৫৪ হাজার থেকে ৬৫ হাজার টাকা।

বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মুজাহিদ সরকার জানান, উপজেলার আইপিএম মডেল দেউলিয়া ইউনিয়নসহ উপজেলায় রবি মওসুমে মোট এক হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে সবজিচাষ হয়েছে। এর বাইরে প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে আলুচাষ হয়েছে। শিবগঞ্জ থেকে সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ায় বাঁধাকপি রপ্তানি হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৬৫৫ টন কপি রপ্তানি হয়েছে। তাদের মোট চাহিদা দুই হাজার টন। এছাড়া চারশ টন মিষ্টি কুমড়ার চাহিদা রয়েছে। মডেল ইউনিয়নের বিষমুক্ত মিষ্টি কুমড়াও রপ্তানি করা হবে বলে জানান তিনি।

টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি কৃষি কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমানকে এ বিষয়ে ফোন দেয়া হলে তিনি ফোনে তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। তবে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (টাঙ্গাইল) উপপরিচালক আহসানুল বাশার বলেন, ধনবাড়ী উপজেলার মুশুদ্দি ইউনিয়নকে মডেল ইউনিয়ন হিসেবে সবজিচাষ হচ্ছে। সেখানে কীটনাশকের পরিবর্তে সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ, হলুদ আঁঠালো ফাঁদ ব্যবহার করা হচ্ছে। ৫০০ জন কৃষককে এই ফাঁদ দেয়া হয়েছে। সবজিচাষে জৈবিক উপায়ে কম কীটনাশক ব্যবহারে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

ঢাকা জেলার ধামরাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আরিফুল হাসান বলেন, ছানুরা ইউনিয়ন উপজেলার আইপিএম মডেল ইউনিয়ন ছাড়াও উপজেলায় প্রায় ৩ হাজার হেক্টর জমিতে সবজিচাষ হয়েছে। ঢাকায় মানিক মিয়া এভিনিউয়ে প্রতি শুক্র ও শনিবার কৃষকের বাজার এবং স্থানীয় বাজারে এ বিষমুক্ত সবজি সরাসরি বিক্রি করছেন কৃষক।

রাজশাহীর পবা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন সুলতানা জানান, উপজেলার পারিলা ইউনিয়নে মডেল হিসেবে একশ একর জমিতে জৈব সার দিয়ে সবজিচাষ হয়েছে। এছাড়া এ উপজেলায় চলতি রবি মওসুমে প্রায় ২ হাজার ২২৫ হেক্টর জমিতে সবজিচাষ হয়েছে।

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল লতিফ জানান, উপজেলার লক্ষীকুন্ডা ইউনিয়নে মডেল হিসেবে সবজিচাষ হচ্ছে। কৃষকরা বিষমুক্ত সবজিচাষে দিন দিন আগ্রহী হয়ে উঠছে। উপজেলায় ১২শ হেক্টর জমিতে সবজিচাষ হয়েছে। স্থানীয় বাজার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে ঈশ্বরদীর সবজি। মডেল ইউনিয়নের বিষমুক্ত সবজি বিদেশে রপ্তানির জন্য আলোচনা চলছে বলে জানান তিনি।

আমারসংবাদ/জেআই