Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

করোনা প্রণোদনার অর্থনীতি

প্রণব মজুমদার

জানুয়ারি ২২, ২০২১, ০৭:৩০ পিএম


করোনা প্রণোদনার অর্থনীতি
  • দেশের ৫০ লাখ নিম্নবিত্ত মানুষকে আড়াই হাজার টাকা করে ঈদ উপহার বা নগদসহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই টাকা মোবাইল ফোন আর্থিক সেবা বিকাশ বা নগদের মাধ্যমে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। ৩৮ লাখ মানুষকে এই অর্থ দেয়া সম্ভব হয়। ডাটাবেজ কি সম্পন্ন করা গিয়েছিল? গেলো কোথায় তা হলে সে অর্থ? সহজশর্তে যদি সহযোগিতার অর্থ যোগ্য উদ্যোক্তার হাতে দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব হয়, তা হলে নতুন করে প্রণোদনার টাকা দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করবে নিঃসন্দেহে।

করোনা অতিমারির অর্থনৈতিক সংকট মোচনে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত এ প্যাকেজের বরাদ্দ দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে এবং বাকি এক হাজার ২০০ কোটি টাকা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সহায়তায় রাখা হয়েছে। অনুমোদিত দ্বিতীয় প্যাকেজের আওতায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের ১৫০টি উপজেলায় দরিদ্র বয়স্ক এবং বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা নারীদের ভাতার আওতায় আনা হবে।

আশা করা যাচ্ছে— দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা তহবিলের সহায়তা পাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তা এবং তৃণমূলে হতদরিদ্ররা। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনার পরিমাণ দাঁড়ালো এক লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। যা দেশের জিডিপির ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আগে করোনায় মোট প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছিল এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে পাঁচ হাজার কোটি, শিল্প খাতে ৩০ হাজার কোটি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ২০ হাজার কোটি, কৃষি খাতে পাঁচ হাজার কোটি, রপ্তানি উন্নয়ন খাতে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা উল্লেখযোগ্য। পরে শ্রমিকদের বেতন দিতে পোশাক খাতকে আরো দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা প্রণোদনা ঋণ দেয়া হয়। পোশাক খাত শতকরা ৪ শতাংশ সুদে এই ঋণ পায়। তারা এরই মধ্যে আবারো প্রণোদনা চেয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতের জন্য বরাদ্দ থাকলেও তারা প্রকৃত অর্থে এই প্রণোদনা ঋণ নিতে পারেনি। এর কারণ ব্যাংকের জামানতসহ আরো কিছু শক্ত শর্ত ছিলো। অথচ এ প্রণোদনা তাদেরই অনেক বেশি প্রয়োজন ছিলো। নতুন প্রণোদনা প্যাকেজে যেনো এসএমই খাতের জন্য শর্ত শিথিল করা হয়, সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এমন একটি পদ্ধতি বের করতে হবে যাতে তারা সহজেই প্রণোদনার টাকা পান। একই সঙ্গে কৃষি খাতে প্রণোদনা যেনো প্রকৃত প্রান্তিক কৃষকেরাই পান তা নিশ্চিত করতে হবে। সার-বীজ যেনো তাদের কাছেই পৌঁছায়। আর নিম্নবিত্ত মানুষকে সহায়তার ব্যাপারে তদারকি বাড়াতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীরা সহায়তার অধিকাংশ অংশ খেয়ে ফেলে। আমরা তা চার দশক ধরে দেখে আসছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা উপলব্ধি করেন। সমপ্রতি তা বলেছেনও। এখন পর্যন্ত প্রণোদনা প্যাকেজ অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র প্রান্তিক, কৃষক এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের মানুষের কাছে খুবই কম গেছে। এমনকি প্রবাসী কর্মী, রেমিট্যান্সযোদ্ধা যারা ফিরে এসেছেন তারাও পাননি বলেই চলে। প্রণোদনা পরিকল্পনায় ত্রুটি ছিলো। এবার সেটা দূর না করলে একই পরিস্থিতি হবে। চলমান করোনা সংকটে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে প্রথম দফায় প্রণোদনা— সহায়তা পুরোপরি সুফল ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পায়নি বলেই নতুন করে তহবিল-সহায়তা দেয়া হলো। অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে সরকারকে ব্যক্তি খাতে রাজস্ব প্রণোদনা দেয়ার সুপারিশ করেছেন। মানে, সরকারকে টাকা দিতে হবে যেনো মানুষ সেই টাকা নিয়ে কেনাকাটা করে, ভোগ বাড়ায়। এমনভাবে টাকা ছাড়া হবে, যেনো তা বাজারে চাহিদা তৈরি করে। কিছু ক্ষেত্রে নগদ সহায়তা দিয়ে, কিছু ক্ষেত্রে সাময়িক কাজের বিনিময়ে মজুরি দিয়ে, আর কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর করে চাহিদা তৈরি করা হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রণোদনাগুচ্ছ মূলত বাজারভিত্তিক। সরকার কোনো অনুদান বা এককালীন অর্থসহায়তা না দিয়ে বরং স্বল্পসুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করেছে। প্রণোদনার অর্থ ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে নিতে হবে। এর ইতিবাচক দিক হলো— এই অর্থ নির্বিচারে বিতরণ করা হবে না। পরে পরিস্থিতি অনুসারে কিছু ঋণ মওকুফ হবে কি না-সেটা ভিন্ন বিষয়। এখানে সমস্যা হতে পারে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের, যারা হয়তো প্রয়োজন সত্ত্বেও সময়মতো ঋণ পাবে না নানামুখী সীমাবদ্ধতায় বা প্রক্রিয়াগত জটিলতায়। সে জন্য সুষ্ঠু তদারকি ও স্পষ্ট অথচ নমনীয় নীতিমালা প্রয়োজন। তা না হলে এখানেও বড় অনিয়ম ঘটতে পারে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ মতে, দেশের ৮৫ শতাংশ কর্মজীবী অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। এরাই করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বেসরকারি এবং ব্যক্তি উদ্যোগে সমাজে যাপনকারী নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন করোনা অতিমারিতে। অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। বেতন ও মজুরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। লজ্জা ও সম্মানের ভয়ে এরা পারে না প্রকাশ করতে। বিশ্ব ব্যাংক আর গবেষকরা মধ্যবিত্তের একটা চেহারা দাঁড় করিয়েছেন আয় অথবা ক্রয়ক্ষমতা দিয়ে; কিন্তু বাংলাদেশে এই করোনায় ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত চেনা যাচ্ছে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। কারণ, মধ্যবিত্ত ত্রাণের লাইনে দাঁড়াতে পারেন না। অভাবের কথা মুখ ফুটে বলতেও পারেন না। এই করোনার সময়ে তাই হাঁসফাঁস করছে মধ্যবিত্ত। এখন আমরা যাদের দেখছি, তারা সংজ্ঞায়িত হয়েছে মধ্যবিত্তের প্রথম টায়ার হিসেবে। তবে এই করোনা যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে আরো পরের টায়ারেও আঁচ লাগবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে, এক জনের দৈনিক আয় এক ডলার ৯০ সেন্ট হলে ওই ব্যক্তিকে দরিদ্র ধরা হয় না। এর নিচে হলে দরিদ্র। এখন মধ্যবিত্তের আয়সীমা কত? এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলছে, এক ব্যক্তির ক্রয়ক্ষমতা যদি প্রতিদিন দুই মার্কিন ডলার থেকে ২০ মার্কিন ডলারের মধ্যে হয় তাহলে তাকে মধ্যবিত্ত বলা যায়। এই হিসাবে তারা বলছে, বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জনগণ হলো তিন কোটি সাত লাখ। বিশ্বব্যাংকের মধ্যবিত্তের আয়ের হিসাবটা একটু বেশি। যাদের প্রতিদিন আয় ১০ থেকে ৫০ ডলার, তারা মধ্যবিত্ত। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যার মাসিক আয় ৪০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা সেই মধ্যবিত্ত। এটা বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৩০ ভাগ। ১৬ কোটি মানুষের হিসাবে সংখ্যাটি দাঁড়ায় চার কোটি ৮০ লাখ।

সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সামপ্রতিক জরিপে দেখা গেছে, করোনায় ফর্মাল সেক্টরে কাজ করা ১৩ শতাংশ মানুষ চাকরি হরিয়েছেন। যাদের আয় ১১ হাজার টাকার কম তাদের ৫৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে গেছে, ৩২ দশমিক ১২ শতাংশের আয় কমে গেছে। যাদের আয় ১৫ হাজার টাকার মধ্যে তাদের ২৩ দশমিক ২ শতাংশের আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ৪৭ দশমিক ২৬ শতাংশের আয় কমে গেছে। আর যাদের আয় ৩০ হাজার টাকার বেশি তাদের ৩৯ দশমিক ৪ শতাংশের কমেছে এবং ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। এই জরিপে কিন্তু মধ্যবিত্তের ওপর করোনার অভিঘাত স্পষ্ট। জরিপে বলা হচ্ছে, করোনায় এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে, তারা দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে গেছে। তাই এখন দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা পাঁচ কোটির বেশি। যাদের দিয়ে সরকারের সহযোগিতার অর্থ বা ত্রাণসামগ্রী বিতরণ হয় সেই লোক ও প্রতিষ্ঠান লোপাট করে। সংকটের শুরুতে জনগণ দেখেছে স্বাস্থ্য খাতে চরম অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা। করোনা পরীক্ষায় ও ওষুধে ভেজাল, দুর্নীতি ও নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহ করে জালিয়াতি ও চিকিৎসালয়গুলোর অব্যবস্থাপনা ও সেবার নামের মুনাফাবাণিজ্য পরিলক্ষিত হয়েছে ন্যক্কারজনকভাবে। ঈদুল ফিতরের আগে দেশের ৫০ লাখ নিম্নবিত্ত মানুষকে আড়াই হাজার টাকা করে ঈদ উপহার বা নগদসহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই টাকা মোবাইল ফোন আর্থিক সেবা বিকাশ বা নগদের মাধ্যমে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। ৩৮ লাখ মানুষকে এই অর্থ দেয়া সম্ভব হয়। ডাটাবেজ কি সম্পন্ন করা গিয়েছিল? গেলো কোথায় তা হলে সে অর্থ? সহজশর্তে যদি সহযোগিতার অর্থ যোগ্য উদ্যোক্তার হাতে দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব হয়, তা হলে নতুন করে প্রণোদনার টাকা দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করবে নিঃসন্দেহে।

লেখক : সাংবাদিক ও অর্থনীতি-বিষয়ক কলামিস্ট

আমারসংবাদ/জেআই