Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে হার্ড ও সফট পাওয়ার

রায়হান আহমেদ তপাদার

জানুয়ারি ২৫, ২০২১, ০৮:৫৫ পিএম


আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে হার্ড ও সফট পাওয়ার

ক্ষমতা হলো এক ধরনের দক্ষতা বা প্রভাব যা অন্যের ওপর প্রযুক্ত হয়। অন্যের অস্তিত্বকে প্রভাবিত করতে সমর্থ হলে তবেই কারোর ক্ষমতার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। এমিল ডুর্থেইস এ কারণেই বলেছেন, সমাজই ব্যক্তিকে উৎকৃষ্ট কিংবা নিকৃষ্ট, আদেশ দানকারী কর্তা ও পালনকারী ভৃত্য শ্রেণিতে বিন্যস্ত করে, সমাজই কর্তাব্যক্তিদের সবসময় সম্পদ দান করে যা তাদের নির্দেশকে ফলপ্রসূ করে তোলে যা ক্ষমতাকেই নির্মাণ করে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র চীন, কিউবা, ভিয়েতনাম দাপটের সাথে সংকট মোকাবিলা করে এখন পর্যন্ত ভালো আছে, চিকিৎসা সামগ্রী ও চিকিৎসক পাঠাচ্ছে বিভিন্ন রাষ্ট্রে। পুঁজিবাদের ফসল হিসেবে পৃথিবী প্রত্যক্ষ করলো একটি কঠিন বাস্তবতা, অল্পসংখ্যক অর্থলিপ্সা, অতি মুনাফালোভীর কাছে বিশ্বব্যবস্থা আজ অবরুদ্ধ। মানুষের মূল্য তার কাছে কতটুকু? আসল কথায় আসি— প্রকৃতির সাথে মানুষের নিষ্ঠুরতা ক্রমেই বেড়ে উঠছে, মানুষ অমানবিক আচরণ করছে প্রকৃতির সাথে, প্রকৃতি তার সহ্যের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। তাই মানুষ প্রত্যক্ষ করছে প্রকৃতির ভয়াবহতা। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়কালে এবং এমনকি, উপসাগরীয় যুদ্ধকালীন সময়েও সেনা ও যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সমরাস্ত্র সরবরাহ করতে এ জলপথগুলোর কয়েকটা ব্যবহার করা হয়েছে। তাই বৈশ্বিক রাজনীতিতে প্রভাব ও আধিপত্য স্থাপনের ক্ষেত্রে ওই জলপথগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা অতীব জরুরি বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা। তা ছাড়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আরব উপসাগরীয় অঞ্চল বিশ্ব-রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্যও অপরিহার্য হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে সুদূর অতীতকাল থেকে।

অথচ বিশ্বব্যবস্থায় নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর প্রায় সবকটি উপাদানই মুসলিম বিশ্বের রয়েছে বলে মনে করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, জনসংখ্যা, মুসলিম রাষ্ট্রের সংখ্যা, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক সামর্থ্য, ভূ-রাজনীতি ও ভূ-কৌশলগত অবস্থান, ভূ-অর্থনীতি তথা তেল-গ্যাসের প্রাচুর্য— যা শিল্পায়ন ও প্রতিরক্ষা শিল্প উৎপাদনের পরিচালিকাশক্তি, এই জ্বালানি শক্তির ওপর মুসলিম বিশ্বের কয়েকটা দেশের রয়েছে একাধিপত্য। তেল-গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্ব অচল হয়ে পড়তে পারে। মুসলিম বিশ্ব মূল্যবান এ প্রাকৃতিক সম্পদ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মুসলিম বিশ্বের আধিপত্য ও প্রভাব বৃদ্ধির জন্য কাজে লাগাতে পারে। আন্তর্জাতিক নৌরুটের ওপর রয়েছে মুসলিম বিশ্বের প্রভাব বিস্তারকারী সুবিধা, রয়েছে সামরিক সক্ষমতা, আছে আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ, রয়েছে ঐতিহ্যগত আদর্শ ইত্যাদি। এসব দিক বিবেচনায় বিশ্বব্যবস্থায় নীতিনির্ধারণে ও নেতৃত দেয়ার ক্ষেত্রে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বিশেষ ভূমিকা পালন করার সুযোগ রয়েছে। মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান পৃথিবীর মধ্যভাগে অবস্থিত, যা বিশ্বের হিট বেল্ট খ্যাত সাউথ-ইস্ট এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া থেকে নর্থ-ইস্ট আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত, বিরাট ওই ভূ-খণ্ডে বিশ্বের প্রায় ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্রের অবস্থান। বিশ্বের মোট ৭৮ বিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যা ইসলাম ধর্মের অনুসারী। খ্রিস্ট ধর্ম অনুসারীদের পরই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মানুসারী হলো ইসলাম ধর্মের।

উল্লেখ্য, বিশ্বে খ্রিস্ট ধর্মানুসারী লোক সংখ্যা হলো, ২১৬৮ বিলিয়ন বা ৩১৪ শতাংশ। সারা বিশ্বের ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রায় দু’-শতাধিক রাষ্ট্রে ১৯ বিলিয়ন বা ২৩২ শতাংশ মুসলমান মানুষের বসতি রয়েছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ এশিয়ায়, ২০ শতাংশ মধ্যপ্রাচ্য ও নর্থ আফ্রিকায় এবং সাব-সাহারান আফ্রিকায় ১৫ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠী বসবাস করে। অন্যদিকে, ৩৪ শতাংশ মুসলমান ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলোতে বসবাস করে। ভূ-কৌশলগত দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মুসলিম বিশ্বের তিনটি মুখ্য অঞ্চল সাউথ-ইস্ট এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং নর্থ আফ্রিকাজুড়ে বিশ্বের জলপথের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নৌরুট, চ্যানেল এবং স্ট্রেইট, অর্থাৎ মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যবর্তী মালাক্কা প্রণালি, মধ্য-পূর্বাঞ্চলীয় মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যভাগ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে হরমুজ প্রণালি এবং বাব-আল-মানদেব ও সুয়েজ খাল প্রবাহিত হয়েছে মুসলিম প্রধান নর্থ-ইস্ট এবং হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলজুড়ে এবং গুরুত্বপূর্ণ দান্দানেলিশ ও বসফরাস প্রণালিও মুসলিম বিশ্বের সাথে সংযুক্ত এবং এগুলো আন্তর্জাতিক ট্রান্সপোর্টেশন, আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য, দ্রব্যাদি পরিবহনের জন্য, বিশেষ করে, তরল তেল, গ্যাস ও ক্রুডওয়েল এবং সমরাস্ত্র বিশ্বের নানান দেশে আমদানি-রপ্তানির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ জলপথ হিসেবে কৌশলগত কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে এ সকল জলপথ নিয়ন্ত্রণ করা বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর জন্য অপরিহার্য। কিন্তু এগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা, দ্বন্দ্ব ও সঙ্ঘাত ঘটতেও দেখা গেছে অতীতে এবং এখনো অব্যাহত আছে। মুসলিম বিশ্ব একসময় বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তি হিসেবে বিশ্বব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এমনকি, গোটা পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি ভূ-খণ্ডের ওপর শাসন ও প্রভুত্ব করেছিল। অবশ্য পরবর্তীতে মুসলমানরা বিশ্বব্যবস্থায় ক্ষমতাহীন হতে থাকে এবং বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় সম্পূর্ণভাবে গুরুত্বহীন অবস্থায় পড়েছে, বিশ্ব পরিমণ্ডলে মুসলমান জনগোষ্ঠী ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলো নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কোনোই ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ১৯৪৫ সালে সমাপ্ত হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে বিশ্ব রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ ও বিশ্বের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হওয়ার প্রেক্ষিতে উপসাগরীয় অঞ্চলসহ গুরুত্বপূর্ণ জলপথগুলোর ওপর প্রভাব ও আধিপত্য স্থাপনের জন্য ওই রাষ্ট্র দুটি অব্যাহত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কার্যক্রমে লিপ্ত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য এবং উপসাগরীয় অঞ্চলে তাদের ভাইটাল স্বার্থ রয়েছে বলে সর্বদা মনে করে থাকে। এ ছাড়া, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল হলো ইসলাম ধর্মের উৎপত্তি স্থল ও কেন্দ্র এবং ওই অঞ্চল থেকেই পরবর্তীতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল ইসলাম ধর্ম। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে গঠিত ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা বা ওআইসি জাতিসংঘের পরই বিশ্বের বৃহত্তম একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। যার সদস্য সংখ্যা ৫৭ এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে আছে আরব লিগ। সামরিক সক্ষমতার দিক থেকেও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান, মিসর ও ইন্দোনেশিয়া আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এবং পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্র।

তেল-গ্যাসের প্রাচুর্যতার জন্যও উপসাগরীয় অঞ্চলের ওপর নজর বিশ্বশক্তিগুলোর। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে তেল-গ্যাসের মোট মজুতের ৬০ শতাংশ মজুত রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে। উল্লেখ্য, বিশ্বের অন্যতম পরিচালিকাশক্তি হলো তেল-গ্যাস। বিশ্বের তেল-গ্যাসের চাহিদার অধিকাংশ রপ্তানি ও সরবরাহ হয়ে থাকে মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো থেকে। ১৩ সদস্যের তেল-গ্যাস রপ্তানিকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা-ওপেক বিশ্বের মোট ৪০ শতাংশ তেল উৎপাদন ও রপ্তানি করে থাকে এবং সংস্থার দুটি সদস্য দেশ, ভেনিজুয়েলা ও ইকুয়েডর ব্যতীত অন্য সব সদস্য রাষ্ট্র মুসলিম রাষ্ট্র। বিশ্বের প্রমাণিত তেল-গ্যাসের রিজার্ভের ৮০ শতাংশই ওপেকভূক্ত দেশগুলোতে রিজার্ভ রয়েছে বলে পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়। কাজেই তেল-গ্যাস উৎপাদনকারী মুসলিম রাষ্ট্রগুলো মুসলিম বিশ্বের স্বার্থে এসব প্রাকৃতিক সম্পদ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে বিশ্বব্যবস্থায় স্থান করে নিতে পারে। কিন্তু মুসলিম রাষ্ট্রগুলো সেটি করতে পারেনি নিজেদের নানাবিধ দুর্বলতার কারণে। উপরোক্ত উপাদানসমূহ ইসলামি বিশ্বের জন্য দুটি পাওয়ার রিসোর্স অর্থাৎ হার্ড ও সফট পাওয়ার গঠন করেছে বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা। হার্ড ও সফট পাওয়ার ক্ষমতার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বৃহৎ শক্তির সক্ষমতার প্রকাশ। সব মিলে বিশ্ব একটি নয়া রূপ দেখতে পাবে। তাবত শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোকে মনে রাখতে হবে— পৃথিবী নামক এ গ্রহটির বাসিন্দা হলো মানুষ, যারা এখানকার এক?ই অক্সিজেন, পানি, বাতাস ব্যবহার করে বেঁচে আছে। এগুলোকে বিনষ্ট করে আমরা কেউ শান্তির পতাকা উড়াতে পারবো না। এ জন্য মানবকল্যাণে ঐক্য, সমন্বয়, সহযোগিতা, সমপ্রীতির পথে সকল নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। করোনা ক্ষুদ্র একটি ভাইরাস আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো আমাদের অসহায়ত্বের চিত্র। এই মুহূর্তে বিশ্ব সমপ্রদায়ের মানবিক কল্যাণে সর্বোত্তম পন্থা হ?ওয়া উচিত। স্বার্থ বড়, মানুষ নয়। সাগরে-মহাসাগরে পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে ভূ-প্রকৃতি বিনষ্ট হচ্ছে। আকাশ, পাতাল, বাতাস, পানি, নদী, সাগর, মহাসাগর, পাহাড়-পর্বত হয়ে উঠেছে বিষে বিষময়। যুক্তরাষ্ট্রের কার্বন নিঃসরণের হার সবচেয়ে বেশি, জলবায়ুগত পরিবর্তনের বিষয়টি বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে এলেও উন্নত রাষ্ট্রগুলো এ ব্যাপারে কোনো ভ্রুক্ষেপ?ই করেনি। পৃথিবী যখন করোনার কবলে পড়ে আজ ভারসাম্য রক্ষায় ব্যস্ত, ঠিক মানুষ তার জীবন রক্ষার তাগিদে নিজেকে ঘরবন্দি করতে ব্যস্ত। করোনা পৃথিবীর মানুষের স্বাভাবিক জীবন কেড়ে নিয়েছে, জাতিসংঘের মহাসচিব এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বসমপ্রদায়ের সামনে আজ সর্বোচ্চ চ্যালেঞ্জ। পৃথিবীর ভবিতব্য ভেবে বিশ্লেষকরা বলছেন— পৃথিবীতে এক ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে যা দীর্ঘস্থায়ী হবে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

raihan567@yahoo.com

আমারসংবাদ/জেআই