Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

দুর্নীতির মামলায় ধীরগতি

ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২১, ০৭:৪৫ পিএম


দুর্নীতির মামলায় ধীরগতি
  • উচ্চ আদালতে ঝুলে আছে আড়াই সহস্রাধিক মামলা
  • আইনি জটিলতায় দুর্নীতি মামলা নিষ্পত্তিতে বাধা
  • সারা দেশে বিচারাধীন দুর্নীতি  মামলা ৫,৩৯৮টি
  • আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বিচার বিলম্বিত করছে প্রভাবশালী আসামিরা
  • দুদকের মামলাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা উচিত -মনজিল মোরসেদ, আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
  • দুদক ও আমরা সমন্বয় করে স্থগিত মামলা পুনঃশুনানির ব্যবস্থা করছি -এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল
  • হাইকোর্টের নির্দেশনা প্রতিপালন হলে নিষ্পত্তি বেড়ে যাবে -খুরশিদ আলম খান, দুদকের আইনজীবী

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়। অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে ফেঁসে যান অনেকে। গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণও করেন কেউ কেউ। বাদ যাননি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বড় নেতারাও। দুদকের দায়ের করা অধিকাংশ মামলার রায় তৎকালীন বিশেষ আদালতে হলেও উচ্চ আদালত এসে কিছু মামলার সাজা বাতিল হয়ে যায়। আবার বহু মামলার বিচারিক কার্যক্রমও  স্থগিত হয়ে যায়। অনেক মামলার কার্যক্রম এখনো বিশেষ আদালতে চলছে। আবার হাইকোর্টেও নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ঝুলছে আড়াই সহস্রাধিক মামলা। দুর্নীতির দায়ে এখনো কারাভোগ করছেন অনেকে, আবার কারাদণ্ড ছাড়াই জামিনে মুক্ত আছেন কেউ কেউ। তেমনই একজন হাজী মোহাম্মদ সেলিম।

অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় একটি মামলা করে দুদক। এক বছর পরই বিচারিক আদালত তাকে অভিযুক্ত করে ১৩ বছরের কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়ে রায় দেন। এরপরই ২০০৯ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। সেই বছরই হাজী সেলিম নিম্ন আদালতের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন। হাইকোর্ট ২০১১ সালের ২ জানুয়ারি বিচারিক আদালতের দেয়া ১৩ বছরের সাজা বাতিল করে রায় দেন। ফলে ফের ওই মামলার রেকর্ড নিম্ন আদালতে চলে যায়। এরপর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও ওই মামলার রেকর্ড আর হাইকোর্টে আসেনি। কয়েক দফা চেষ্টা চালিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে যায় দুদক। ওই আপিলের শুনানি শেষে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি পুনরায় শুনানির নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। এরপর থেকে মামলার বিচারকাজ আর এগোয়নি। দীর্ঘদিন উচ্চ আদালতেই ঝুঁলে আছে এর বিচারপ্রক্রিয়া। আর এ মামলায় জামিনে আছেন ঢাকা-৭ আসনের এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিম। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের একাধিক আবেদনের প্রেক্ষিতে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ওই মামলার আপিলের পুনঃশুনানি শুরু করে হাইকোর্ট। মামলার যাবতীয় নথিও তলব করে। গত ৭ ডিসেম্বর ঢাকার ৭ নম্বর বিশেষ জজ আদালত থেকে নথি (এলসিআর) উচ্চ আদালতে পাঠানো হয়।

এদিকে দুর্নীতি দমন কমশিনের আইনজীবীরা বলছেন, বিচারিক আদালতের দেয়া যেসব মামলার সাজা উচ্চ আদালতে বাতিল হয়েছে সেগুলোর প্রত্যেকটি নিয়ে আলাদা আলাদা প্রতিবেদন তারা কমিশনের কাছে জমা দিচ্ছেন। এরপর কমিশন দ্রুত আবার আইনগত প্রক্রিয়া শুরু করবে বলে কর্মকর্তারা বলছেন। ইতোমধ্যে বেশ কিছু মামলার পুনর্বিচার চেয়ে আবেদনও করা হয়েছে বলে জানা তারা। শুধু হাজী সেলিমই নন, উচ্চ আদালতে আড়াই হাজার দুর্নীতির মামলা বিচারের অপেক্ষা ঝুলছে। এ ধরনের আসামির মধ্যে রয়েছেন— এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি কানাডায় পলাতক প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার, ঢাকার এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিম, সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, দুদক পরিচালক এনামুল বাছির, ডিআইজি পার্থ, ডিআইজি মিজান, ডিআইজি প্রিজন বজলুর রশিদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাঈল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, যুবলীগ নেতা এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম, কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল এমপি, জেকেজির মালিক ডা. সাবরিনা চৌধুরী, ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক ওরফে বাবুল চিশতী, আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু ও রুপন ভূঁইয়া, হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, ডেসটিনি গ্রুপের এমডি রফিকুল আমীন প্রমুখ। এ ছাড়া ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, আমানউল্লাহ আমান, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাবেক এমপি আউয়াল, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, সিগমা হুদা, হাফিজ ইব্রাহীম, গিয়াসউদ্দিন আল মামুন, যুবলীগ নেতা পলাতক কাজী আনিসুর রহমান, কর্নেল (অব.) দিদার, কক্সবাজারের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদিসহ বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, হলমার্ক, অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন।

এসব মামলার বিভিন্ন ধাপে পক্ষগুলো বিচারিক আদালত থেকে উচ্চ আদালতে ও সর্বোচ্চ আদালতে আইনি প্রতিকার নিতে আসে। যার ফলে দুদকের আলোচিত মামলার সংখ্যা উচ্চ আদালতে দিন দিন বেড়েইে চলেছে। মামলাজট ও নানা আইনি জটিলতার কারণে দুর্নীতির এসব মামলার বিচার নিষ্পত্তি হচ্ছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। তাছাড়া মামলার আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বিচারপ্রক্রিয়া বিলম্ব করা হচ্ছে। এসব মামলায় অর্ধশতাধিক আসামি কারাগারে রয়েছেন। আসামিরা বিভিন্ন সময়ে উচ্চ আদালত থেকে বিচার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ ও জামিনসহ বিদ্যমান নানা আইনি সুবিধা নিতে আসেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে কঠোর অবস্থানের কারণে সফল হতে পারেননি তারা। ফলে তারা আদালতে জামিন চেয়ে একাধিকার ব্যর্থও হয়েছেন। উচ্চ আদালতে এসব মামলার মধ্যে রয়েছে— ক্রিমিনাল, রিট, আপিল, ক্রিমিনাল মিস, ক্রিমিনাল রিভিশন, কোম্পানি মামলা ও আদালত অবমাননা মামলা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো ব্যক্তির সম্পদের হিসাব চাইলে তিনি হাইকোর্টে দুদকের ওই নোটিসের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট মামলা করেন। সেটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দুদক তার কার্যক্রম শুরু করতে পারে না। এমন বহু মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা জানান, দুদকের মামল অবৈধ সম্পদ অর্জন, সম্পদের তথ্য ফাঁকি, উৎকোচ গ্রহণ, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, সরকারি ক্রয়ে দুর্নীতি, অর্থপাচার ইত্যাদি। দুর্নীতির এসব অভিযোগে রাজনৈতিক ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, সরকারের বর্তমান ও সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে হয় তাই তারা অত্যাধিক প্রভাবশালী হওয়ায় দুদকেরও এসব মামলায় বিচার পেতে বেগ পেতে হয়। অনেক সময় প্রভাবশালীদের আইনের আওতায় আনাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। দুদক কোনো ব্যক্তির সম্পদের হিসাব চাইলে প্রথমে নোটিসের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট পরে অনুসন্ধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করা হয়। এরপর মামলার কার্যক্রম চ্যালেঞ্জ করে রিট দায়ের করা হয়। পরে বিচারিক আদালতে সাজার বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। সেটা হাইকোর্টে বহাল থাকলে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হয়। আপিল নিষ্পত্তি হলে রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করা হয়। অন্যদিকে, বিচারিক আদালতে কেউ খালাস, জামিন বা অব্যাহতি পেলে দুদকও উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়। এভাবেই চলে আইনি লড়াই। ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে সময় লেগে যায় বছরের পর বছর।

উচ্চ আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত উচ্চ আদালতসহ সারা দেশে বিভিন্ন আদালতে দুদকের দায়ের করা বিচারাধীন মামলা রয়েছে পাঁচ হাজার ৩৯৮টি। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ৪২২টি, হাইকোর্ট বিভাগে দুই হাজার ৫৩টি, ঢাকার আদালতে ৮২৭টি এবং ঢাকার বাইরে অন্যান্য জেলায় দুই হাজার ১০৪টি। এই সময়ে সাজা হয়েছে ১১১ জনের, খালাস পেয়েছেন ৪৪ জন এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ১৫৫টি মামলা। সর্বোচ্চ আদালতে ৯৫টি মামলা এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৬৯০টি দুর্নীতির মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। আপিল বিভাগে ৪৬টি এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৩০৪টি মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। অবশ্য গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টসহ সারা দেশে আরও কিছু মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তি হয়েছে। এ ছাড়া ২০০৪ সালে বিলুপ্ত হওয়া দুর্নীতি দমন ব্যুরোর আমলে করা ৪৫১টি মামলার মধ্যে ২৪৯টি চলমান এবং উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত রয়েছে ২০২টি।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘দুদকের মামলাগুলো অগ্রাধিকারভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা উচিত। কারণ দ্রুত বিচার হলে দুর্নীতি করতে সবাই নিরুৎসাহিত হবে। উচ্চ আদালতে অথবা নিম্ন আদালত সব জায়গায়ই এসব মামলার খুবই ধীরগতি বিরাজমান এটা গুরুত্বসহকারে সমাধান করতে হবে। তবে বর্তমানে কিছু মামলার নিষ্পত্তিতে  হাইকোর্ট কার্যকরি ভূমিকা রাখছে। যেমন পিকে হালদারের বিষয়টি। অন্যমামলার ক্ষেত্রেও আগের চেয়ে কিছুটা গতি ফিরেছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, ‘দুর্নীতির পুরনো মামলাগুলো আমরা খুঁজে খুঁজে বের করে সেটার বিচারকাজ আবার শুরু করছি। বর্তমানে দুর্নীতির মামলার জন্য হাইকোর্টে একটি পৃথক বেঞ্চও রয়েছে। এ ছাড়া অন্য দু’-একটা বেঞ্চেও এসব মামলা দেখা হচ্ছে। আসলে আমরা উচ্চ আদালতে দুর্নীতির মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। দুদক ও আমরা সমন্বয় করে স্থগিত মামলাগুলো আবার পুনঃশুনানির ব্যবস্থা করছি।’

দুদকের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘দুদকের প্রতিটি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আইনজীবী প্যানেল কাজ করছে। যেসব মামলা নানা আইনি ব্যাখ্যার কারণে বিচারাধীন, সেগুলো আমরা ত্বরিতগতিতে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করছি। উচ্চ আদালতও যথাসময়ে মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরাও চেষ্টা করছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয়ও ঘটছে। হাইকোর্টের নির্দেশনা প্রতিপালন করা হলে মামলা নিষ্পত্তির পরিমাণ বেড়ে যাবে। মামলাজটও কমে আসবে। দুর্নীতির বিচারগুলো দৃশ্যমান হবে।’ পুরনো ও চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির মামলা দ্রুতলয়ে নিষ্পত্তি করে অর্ধেকের নিচে নিয়ে আসা সম্ভব বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

বিচারের জন্য শুনানির অপেক্ষায় থাকা মামলা প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, “আইন অনুযায়ী ‘উপযুক্ত যৌক্তিক কারণ’ ছাড়া বিনা কারণে মামলা মুলতুবি করা যাবে না। কিন্তু প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে সেটা মানা হচ্ছে না। প্রভাবশালীরা আবেদন করলেই তাদের দুর্নীতির মামলাগুলোর বিচার স্থগিত হয়ে যাচ্ছে। আর আইনে যেভাবে ১২০ দিন ১৮০ বা সুনির্দিষ্টভাবে মামলা নিষ্পত্তির বিধান আছে, সেটা মেনে চলতে হবে। তাহলে কোনো মামলাই দীর্ঘদিন আদালতে ঝুলে থাকবে না, দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।’

আমারসংবাদ/জেআই