মাহমুদুল হাসান, গাজীপুর থেকে ফিরে
ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২১, ০৭:৪৫ পিএম
মেডিকেল ইক্যুইপমেন্টের নাম শুনলেই চিন্তায় আসে আমদানি নির্ভরতার কথা। কিন্তু এই আমদানি নির্ভরতা আর কতদিন? এমন উত্তর খুঁজতে গিয়ে এগিয়ে এসেছে দেশীয় উদ্যোক্তারা। যদিও শুরুতে পথটা সহজ ছিলো না। বিদেশি বড় বড় ব্র্যান্ড আর মস্তিষ্কেও আমদানি নির্ভরতা ভূত তাড়িয়ে বাজার তৈরি ছিলো দুরূহ বিষয়। পাগলাটে উদ্যোক্তারা সাহস করে দেশে বিশ্বমানের মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট তৈরি করছে। এতে একদিকে দেশের চাহিদা পূরণ হচ্ছে, অন্যদিকে মেড ইন বাংলাদেশ-খচিত বাংলাদেশি মেডিকেল পণ্য বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। অর্জিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের উদার ও আন্তরিক সহযোগিতা পেলে দেশের শতভাগ চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের আরও বড় বাজার তৈরি করতে সক্ষম হবে। গত শনিবার রাজধানীর অদূরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রমিক্সকো গ্রুপের মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট প্রস্তুতকারক কারখানা পরিদর্শনে যান স্বাস্থ্যশিক্ষা সচিব মো. আলী নূর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানু, স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. এ কে এম আমিরুল মোরশেদ খসরু, স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের উপ-সচিব নেওয়াজ হোসেন চৌধুরী এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (উপকরণ ও সরবরাহ) রত্মা তালুকদার প্রমুখ। সেখানে তাদের অভ্যর্থনা জানান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মৌসুমী ইসলাম। প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানানো হয়, গত প্রায় ২০ বছর আগে মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট আমদানির মধ্যদিয়ে এ ব্যবসায় যুক্ত হয় প্রমিক্সকো। তারপর শুরু হয় মেড ইন বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ব্র্যান্ড তৈরির সংগ্রাম। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বছর পাঁচেক আগে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল এক কারখানা। সাড়ে ৩০০ কোটি টাকায় গড়ে তোলা এই প্রতিষ্ঠানটির সুনাম এরই মধ্যে ছড়িয়েছে দেশের পাশাপাশি বিদেশেও। সরকারও এখান থেকে পণ্য নিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় সংসদ সচিবালয়, সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটও পণ্য কিনেছে কারখানাটি থেকে। ৫৩৯ জোড়া হাতের অক্লান্ত পরিশ্রমে ৮০ শতাংশ দেশীয় কাঁচামাল থেকে প্রমিক্সকোর কারখানায় তৈরি হচ্ছে বিশ্বমানের আইসিইিউ-সিসিইউ বেড, এইচডিইউ বেড, হসপিটাল বেড, ইসিজি মেশিন, মাল্টি প্যারামিটার পেশেন্ট মনিটর, ফেটাল ডপলার, পালস অস্কিমিটার, অপারেশন থিয়েটার লাইট, অপারেশন থিয়েটার টেবিল, সার্জিক্যাল হেডলাইট, গাইনি টেবিল, ইমার্জেন্সি স্ট্রেচার, সাকশন মেশিন, অটোক্লেভের জন্যও আর বিদেশে ছুটতে হবে না।
স্টেবিলাইজার, বেবি ইনকিউবেটর, বেবি ওয়ার্মার, ডেন্টাল ইউনিট, সিরিঞ্জ পাম্প, ইনফিউশন পাম্প, সেন্ট্রিফিউজ মেশিন, নেবুলাইজার, এয়ার পাম্প ও ম্যাট্রেস, অ্যাম্বু ব্যাগ, ওয়েট স্কেল, গ্লুকোজ মিটার, ব্লাড প্রেসার মেশিন, স্টেথেসকোপ, গ্লোভস, ট্রাস্টমি কনডম, নির্ভানা হ্যান্ড সানিটাইজারসহ আরও নানা ধরনের পণ্য বানাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। চিকিৎসা সরঞ্জামের কোনো কিছুই এখন আর দেশের বাইরে থেকে আনতে হয় না। দেশেই তৈরি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের পণ্য। এখানকার পণ্য যে বিশ্বমানের, সেটা বোঝা যায় এখানকার বিক্রয়ের চিত্র দেখে। এখান থেকে পণ্য যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। আরও ১২টি দেশ এখান থেকে পণ্য নিতে চায়, যার আলোচনা চলছে।
স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আলী নূর বলেন, প্রমিক্সকোর মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট তৈরির কারখানা পরিদর্শন করে খুবই ভালো লাগছে। তারা সুন্দর একটি কারখানা তৈরি করেছে। আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে দুই দশক ধরে প্রমিক্সকো স্বাস্থ্য খাতে এত কাজ করে কিন্তু আমরা খুব একটা জানতাম না। আমি অল্প কয়েকদিন আগে জানতে পেরেছি প্রমিক্সকো এই দেশেই মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট তৈরি করছে। বাংলাদেশের একটি উদীয়মান ও সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান। তারা বিশ্বমানের মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট তৈরি করছে। একটি হাসপাতাল সাজাতে যা প্রয়োজন সবকিছু প্রমিক্সকো দেশেই তৈরি করছে। এসব পণ্য আগে অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হলে ২০০ টাকার জিনিস ৫০০ টাকা দিয়ে কিনতে হতো। তবে এখন দেশীয় কোম্পানি উৎপাদনে স্বল্পমূল্যে পাচ্ছে দেশের মানুষ। আমাদের সরকার দেশের উদ্যোক্তাদের সবসময় সহযোগিতা করে থাকে। এ বছর কোভিড-১৯ এর কারণে বেসরকারি খাতকে আরও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। সহযোগিতার হাত আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরকারের সঙ্গে দেশের মানুষ এগিয়ে আসার কারণে বাংলাদেশ করোনা মোকাবিলায় অনবদ্য অবদান রেখে প্রমাণ করেছে— বাংলাদেশ সবকিছু পারে।
তিনি বলেন, সরকার এককভাবে সব কাজ করতে পারে না। বেশির ভাগ কন্ট্রিবিউশন হলো প্রাইভেট সেক্টরের। আমি বলি প্রাইভেট সেক্টর যদি উদারভাবে এগিয়ে না আসতো, সহযোগিতা না করতো তাহলে স্বাস্থ্য খাত এত দ্রুত সাফল্য অর্জন করতে পারতো না। এজন্য প্রাইভেট সেক্টরের প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিষ্ঠান প্রমিক্সকোকে ধন্যবাদ জানাই। তারা এককভাবে স্ট্রাগল করে মানসম্মত বাংলাদেশি পণ্য তৈরি করছে। আমাদের হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পণ্যের সরবরাহ দিচ্ছে। জেলখানাতেও তাদের পণ্য সরবরাহ হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়ন কামনা করি। সেই সাথে প্রমিক্সকোর অগ্রগতির জন্য যা যা করা দরকার আমরা করবো। কারণ এটা আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের পণ্য বাইরে রপ্তানি হয় সেটার লাভ হবে আমাদের দেশের। আমাদের দেশের মানুষের রুটি-রুজির ব্যবস্থা করেছে তারা। এসব ক্ষেত্রে প্রমিক্সকো অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। এখন আমাদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে তারা আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানু বলেন, প্রমিক্সকো গ্রুপের কারখানা পরিদর্শন করে আমরা অভিভূত। আমরা দেখলাম সরকারি ও বেসরকারিভাবে স্বাস্থ্য খাত অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এদেশেই এখন উন্নত প্রযুক্তি সামগ্রী তৈরি হচ্ছে। আমাদের দেশে এখন অনেক বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে। প্রমিক্সকোর উদ্যোগ দেশের স্বাস্থ্য খাতকে অনেক দূর নিয়ে যাবে। আমি তাদের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি। আমাদের দিক থেকে যতটা পাশে থাকা প্রয়োজন সেটি অব্যাহত থাকবে। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. এ কে এম আমিরুল মোরশেদ খসরু বলেন, প্রমিক্সকোতে এসে দেখলাম আমাদের দেশে উন্নত এবং মানসম্মত মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট তৈরি হচ্ছে। তাদের বলবো, আপনারা বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখুন। দেশের মানুষ যাতে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশি পণ্য ব্যবহার করে। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতনদের বলবো, প্রমিক্সকোসহ এ খাতের দেশীয় উদ্যোক্তাদের যেনো বিশেষভাবে সুবিধা দেয়া হয়। মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট ক্রয়ের ক্ষেত্রে যেনো দেশীয় উদ্যোক্তাদের অগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এক্ষেত্রে আমার পক্ষ থেকে যা করার আমি সেই চেষ্টা অব্যাহত রাখবো।
প্রমিক্সকো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মৌসুমী ইসলাম বলেন, আমি মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট নিয়ে প্রায় ২০ বছর কাজ করছি। আমাদের দেশের মাটিতে মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট তৈরি হচ্ছে। যা অন্যান্য দেশের তুলনায় মান অনেক ভালো। আমরা যদি এই মান ধরে রাখতে পারি তাহলে আমরা চীনকে ছাড়িয়ে যাবো। তিনি বলেন, আর্ন্তজাতিক মেডিকেল মান সনদ প্রদানকারী প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের শর্তাবলি পূরণ করে আমরা পণ্য উৎপাদন করি। স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় দেশের মাটি পেরিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে আরও ত্বরান্বিত করবো।
আমারসংবাদ/জেআই