Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪,

নারী শিক্ষার উন্নয়নে ইসলাম

মুফতী মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল

ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২১, ০৮:৩০ পিএম


নারী শিক্ষার উন্নয়নে ইসলাম

ইসলাম নারী জাতিকে এক করুণ অমানবিক অবস্থা থেকে উদ্ধার করে মানুষ হিসাবে যথাযোগ্য অধিকার এবং সম্মানজনক মর্যাদা নিশ্চিত করেছে। নারী জাতির মেধা, মননশীলতা, বিবেক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের ক্ষেত্রে রাসুল (সা.) অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে নারীশিক্ষায় ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতাও দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে নারীদের অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে বলা হয়েছে, “আর পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের ওপর অধিকার রয়েছে, তেমনিভাবে স্ত্রীদেরও নিয়ম অনুযায়ী পুরুষদের ওপর অধিকার রয়েছে। আর নারীদের উপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। আর আল্লাহ হচ্ছে পরাক্রমশালী এবং বিজ্ঞ, (সূরা বাকারা, ২২৮)।

কুরআন ও হাদীসে শুধু নারীশিক্ষার কথা পৃথকভাবে বর্ণনা করা হয়নি। শিক্ষা সম্পর্কে যে কথাই বলা হয়েছে, তা নর ও নারী উভয়ের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। নর ও নারীর জন্য আলাদাভাবে কোনো আলোচনা করা হয় নি। শিক্ষা প্রসঙ্গে যে নির্দেশগুলো দেয়া হয়েছে, তাতে সাধারণত পুরুষবাচক ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন কুরআন মজীদে বলা হয়েছে, “তুমি পাঠ কর তোমার প্রভূর নামে, (সূরা আলাক, ১)। আর হাদীস শরীফে বলা হয়েছে “তোমরা বিদ্যা অন্বেষণ কর” (সুনান দারেমী, ৩৯৬)। এখানে এই নির্দেশ কেবল পুরুষের জন্য নয়, বরং নর ও নারী উভয়ের জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য।

শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, প্রায় সকল বিষয়েই কুরআন ও হাদীসে সাধারণ নির্দেশগুলো এভাবে পুরুষবাচক ক্রিয়াপদ দ্বারা বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও এ দ্বারা নর ও নারী উভয়কেই সমভাবে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় “তোমরা নামায পড়, যাকাত দাও এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর” (সূরা বাকারা, ৪৩)। এখানে ব্যবহূত দু’টি ক্রিয়াপদই পুরুষবাচক। কিন্তু এর দ্বারা নর ও নারী উভয়কেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। কেননা নামায পড়া এবং যাকাত দেওয়া নর ও নারী উভয়ের জন্য ফরয।

নারীদের তালিম তালবিয়ার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘তোমরা নারীদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করো ও উত্তম আচরণ করার শিক্ষা দাও’ (সূরা নিসা, ১৯)। মহানবী (সা.) ঘোষণা করেন, ‘যার রয়েছে কন্যাসন্তান, সে যদি তাকে (শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে) অবজ্ঞা ও অবহেলা না করে এবং পুত্রসন্তানকে তার ওপর প্রাধান্য না দেয়; আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা নারীদের উত্তম উপদেশ দাও (উত্তম শিক্ষায় শিক্ষিত করো)।’ হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘ইলম শিক্ষা করা (জ্ঞানার্জন করা) প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর প্রতি ফরজ (কর্তব্য)’ (ইবনু মাজাহ, ২২০)। হাদিস গ্রন্থসমূহের মধ্যে হজরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ২ হাজার ২১০, যা সব সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তাঁর বর্ণিত হাদিসসমূহের মধ্যে ১৭৪টি বুখারি ও মুসলিম উভয় গ্রন্থে স্থান লাভ করেছে। মুসলিম রমণীদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম শিক্ষিকা, সর্বোচ্চ মুফতি, সবচেয়ে জ্ঞানবতী ও বিচক্ষণা।

ইসলামের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘তারা তোমাদের আবরণস্বরূপ আর তোমরা তাদের আবরণ’ (সূরা বাকারা, ১৮৭)। স্ত্রীর গুরুত্ব সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘উত্তম স্ত্রী সৌভাগ্যের পরিচায়ক’ (মুসলিম)। তিনি আরও বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম’ (তিরমিজি, ৩৮৩০)। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচরণ করো’ (সূরা নিসা, ১৯)। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘নারীদের ওপর যেমন অধিকার রয়েছে পুরুষের, তেমনি রয়েছে পুরুষের ওপর নারীর অধিকার।’ (সূরা বাকারা, ২২৮)।  

ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য না করে উভয়কে সমভাবে জ্ঞানার্জনের আদেশ দিয়েছে। কুরআনের নির্দেশও তাই। কুরআন সকল পাঠককেই আদেশ করছে পড়তে, চিন্তা-গবেষণা করতে, অনুধাবন করতে, এমনকি বিশ্ব প্রকৃতির মাঝে লুকায?িত বিভিন্ন নিদর্শন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে। রাসুলের (স.)কাছে প্রথম যে ওহী নাযিল তার প্রথম শব্দ ছিল ‘ইকরা’ অর্থাৎ পাঠ কর। এখানে স্ত্রী-পুরুষ সকলকেই পাঠ করতে বলা হয়েছে। সুতরাং জ্ঞানার্জন শুধুমাত্র পুরুষের জন্য সীমাবদ্ধ করা হয়নি, পুরুষের মত নারীকেও জ্ঞানার্জনের পূর্ণ অধিকার দেয়া হয়েছে। রাসুল (স.) প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য জীবনব্যাপী জ্ঞানের সাধনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই আমাদের উচিত সর্বদা জ্ঞানার্জনে ব্রতী থাকা। এমনকি তিনি ক্রীতদাসীদেরকেও শিক্ষার সুযোগ দেয়ার নির্দেশ দান করেছেন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই রাসুলের (স.) বক্তৃতার আসরে যোগ দিতেন। বদর যুদ্ধে বন্দীদের শর্ত দেয়া হয়েছিল যে, তাদের মধ্যে যে কেউ দশজন মুসলিমকে বিদ্যা শিক্ষা দিবে তাদের প্রত্যেককেই বিনা মুক্তিপণে ছেড়ে দেয়া হবে।

সমাজে নারীর অবস্থান ও অধিকার নিয়ে আমরা নানা কথা শুনে থাকি। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বর্তমানে যে কথাগুলো বলা হচ্ছে, তার মধ্যে বেশ কিছুই গ্রহণযোগ্য। আবার কিছু কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ আছে। নারী-পুরুষ সবারই অধিকার প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। কারণ, সমাজ ক্রমেই সামনে এগোচ্ছে। শুধু নারী বা পুরুষেরই নয়, সব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।

হাদিসে এসেছে, নারীকে সম্মান করার পরিমাপের ওপর ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদার বিষয়টি নির্ভর করে। তিনটি বিষয় নবী করিম (সা.)-এর জীবনে লক্ষণীয় ছিল্তএক. নামাজের প্রতি অনুরাগ; দুই. ফুলের প্রতি ভালোবাসা; তিন. নারীর প্রতি সম্মান, (বুখারি)।

সমগ্র পৃথিবীতে, বিশেষ করে আমাদের দেশে মানুষের ওপর, বিশেষ করে নারীর ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন চলছে, তার একটা ফাউন্ডেশন আছে, ভিত্তি আছে। অত্যাচার আকাশ থেকে আসছে না। নারীর ওপর পুরুষের এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীরও যে অত্যাচার নির্যাতন, তার আদর্শিক ভিত্তি হলো, সাধারণভাবে মানুষ বিশ্বাস করে যে, বিশেষ করে পুরুষেরা বিশ্বাস করে, নারী পুরুষের চেয়ে নীচু, তাদের মান খারাপ এবং তারা পুরুষের চেয়ে ছোট। এই বিশ্বাস অবশ্য নারীর মধ্যেও কিছুটা বিদ্যমান। মানুষের মধ্যে বিদ্যমান কতগুলো বিভ্রান্তি থেকে এ বিশ্বাসের জন্ম। আর এই বিশ্বাসের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে নারীদের প্রতি অবহেলা, বঞ্চনা ও নির্যাতন।

নবী করিম (সা.) নারীদের সৃজনশীল চিন্তা-চেতনায় ও শিক্ষা-গবেষণায় সুদক্ষ করার জন্য সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যবস্থা চালু করেন। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিন শুধু নারীদের শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতেন। নারী সমপ্রদায় রাসুলের (সা.) কাছে এই মর্মে অভিযোগ করলেন যে, আপনার কাছে শিক্ষার্জনের ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে পুরুষেরা এগিয়ে। আমাদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিন বরাদ্দ করুন। রাসুল (সা.) প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন এবং নির্দিষ্ট দিনে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দিকনির্দেশনামূলক শিক্ষা ও উপদেশ দিতেন, (বুখারি)। একদিন নবী করিম (সা.) হজরত বেলালকে (রা.) নিয়ে বের হলেন। তিনি ধারণা করলেন, রাসুল (সা.) পুরুষদের শিক্ষা দিতে গিয়ে পেছনের সারিতে বসা নারীদের কথা শুনতে পাচ্ছেন না। তখন তিনি নারীদের কাছে গিয়ে জ্ঞান ও উপদেশ শোনালেন’ (বুখারি)।

ইসলামের শিক্ষার আলোকে পুরুষদের মধ্য হতে যেমনি আবূ বকর, উমার, উসমান, আলী, ইবনে আব্বাস, ইবনে মাসউদ, ইবনে উমার (রা) এবং হাসান বসরী, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম শাফেয়ী এর মত মহাপুরুষগণের আবির্ভাব ঘটেছিল, ঠিক তেমনি আয়েশা, হাফসা, শিফা বিনতে আব্দুল্লাহ, কারীমা বিনতে মিকদাদ, উম্মে কুলসুম (রা:) মত মহিয়সী নারীও আত্মপ্রকাশ করেছিলেন।

রাসুলের (সা.) সহধর্মিণী হযরত আয়েশা (রা.) নারীশিক্ষার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁকে হাদিস বর্ণনাকারী ইমাম ও অধিক জ্ঞানসম্পন্ন সাহাবিদের মধ্যে গণ্য করা হয়। তিনি ছিলেন হাদিস বর্ণনা ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সর্বাধিক মর্যাদাশালী। বহুসংখ্যক সাহাবি ও তাবেয়ি তাঁর কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেন এবং ইলমে দ্বীন শিক্ষা লাভ করেন।

মোটকথা, ইসলামের নির্ধারিত সীমা ও গ্লির মধ্যে অবস্থান করেই সে যুগের মহিলাগণ আত্মসংশোধন এবং জাতির খিদমতের উদ্দেশ্যে দীনি-শিক্ষা লাভ করতেন এবং নিজ সন্তানদেরকে এমন আদর্শবান করে গড়ে তুলতেন, যাতে তাঁরা নিজেদের যুগের পথিকৃৎ রূপে কওমের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন।

আধ্যাত্মিক মহিমা অর্জনের ক্ষেত্রেও নারীর কর্তব্য রয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘এ কথা সুনিশ্চিত, যে পুরুষ ও নারী মুসলিম মুমিন, হুকুমের অনুগত, সত্যবাদী, সবরকারী, আল্লাহর সামনে বিনত, সাদকা দানকারী, রোজা পালনকারী, নিজেদের সম্ভ্রমের হেফাজতকারী এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণকারী, আল্লাহ তাদের জন্য মাগফিরাত ও প্রতিদানের ব্যবস্থা করে রেখেছেন’ (সূরা আহজাব, ৩৫)।

বাংলাদেশে সর্বজনীন শিক্ষার উন্নয়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে এবং এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে নারীশিক্ষায়। যার ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ থেকে কুসংস্কার ও সংকীর্ণ মনোভাব ক্রমেই দূর হচ্ছে। তাই মেধাবী নারীদের কোণঠাসা করে না রেখে, তাদের শালীনভাবে চলাফেরা ও উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষায় সুযোগ করে দিতে হবে; এ জন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। নারীদের শিক্ষার্জনের দিককে অস্বীকার করার মানেই হলো প্রকারান্তরে তাদের মর্যাদাকে হেয়প্রতিপন্ন করা। কাজেই সর্বক্ষেত্রে তাদের প্রতি সমীহ আচরণ করা জরুরি এবং ইসলাম ধর্মে তাদের শিক্ষার্জনের যে মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়েছে, তা কড়ায়-গন্ডায় আদায় করা হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে নজরদারি বৃদ্ধিতে আলেমসমাজেরও এগিয়ে আসা উচিত।

লেখক : প্রভাষক (আরবী), চাটখিল কামিল মাদরাসা, নোয়াখালী।

ibrahim010187@gmail.com

আমারসংবাদ/জেআই