Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

খুঁড়িয়ে চলছে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল

ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২১, ০৬:৪০ পিএম


খুঁড়িয়ে চলছে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল
  • টিনশেড ভবন সংস্কার হয়নি ৩২ বছরেও
  • নেই সরকারি আইনজীবীদের জন্য পৃথক প্যানেল
  • দুই দশক ধরেই এজলাস ভাগাভাগি করে চলছে বিচারকাজ
  • বিচারাধীন মামলা এক হাজার ২০০টি, ঝুলছে ১০ বছর আগের মামলাও

আদালত আছে। বিচারও চলে, তবে নেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিচারক। যারা আছেন তারাও অনিয়মিত। ফলে তৈরি হয়েছে মামলাজট। আবার বহুকাল ধরেই প্রশাসনিক ও আপিল ট্রাইব্যুনাল ভুগছে এজলাস সংকটে। বিচারকাজও চালাতে হচ্ছে এজলাস ভাগাভাগি করে। রয়েছে বিচারকদের বসার প্রয়োজনীয় জায়গার সংকট। বিচারক থাকলেও সহায়ক জনবলেরও ভয়াবহ সংকট রয়েছে। আবার দীর্ঘ বছরেও সংস্কার হয়নি প্রায় দুইশ বছরের পুরানো জরাজীর্ণ টিনশেড ভবন। করোনায় বিচারকাজ নিয়মিত না হওয়ায় আইজীবীদেরও আনাগোনা কম।

সমস্যার যেনো অন্ত নেই। সমাধানেরও কার্যকর উদ্যোগ নেই। ফলে নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়েই একপ্রকার খুঁড়িয়ে চলছে সরকারি চাকরিজীবীদের প্রতিকার চাওয়ার জায়গা আপিল ও প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল। সমস্যা সমাধানে সাম্প্রতিক সময়ে প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রীকে একাধিকবার চিঠি দিয়ে নজরে আনা হলেও সমস্যা নিরসনে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। উদ্যোগ নেয়া হয়নি সংস্কারেও। ধসে পড়ার শঙ্কা নিয়েই চলছে চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত দুর্বল ভবনটি। ফলে ঝুঁকি মাথায় নিয়ে দীর্ঘদিন অফিস করছেন বিচারক ও আইনজীবীরা। ট্রাইব্যুনালের জন্য ‘ল’ টাওয়ার নামে বহুতল ভবন নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন আইনজীবীরা। এতো সমস্যা নিয়ে কীভাবে বছরের পর বছর সরকারি চাকরিজীবীদের চাকরি, পদোন্নতি, অপসারণ ও অব্যাহতি, বিভাগীয় মামলাসহ বিভিন্ন ধরনের মামলা চলছে— এ নিয়েও জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এখানে সরকারি আইনজীবীদের পৃথক দুটি প্যানেল থাকার কথা থাকলেও তা নেই। চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিব ছাড়া অন্য কক্ষগুলোতে ঝুলছে তালা। বৃষ্টিতে টিন ছিদ্র হয়ে পানি পড়ায় অনেক আইনজীবীও নিয়মিত আদালতে আসেন না। তবুও বিচারকাজ চলে, বিচারপ্রার্থীরাও প্রতিনিয়ত আসা-যাওয়া করেন। তবে করোনার প্রভাবে দীর্ঘদিন বিচারকাজ বন্ধ থাকায় নেই আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের আনাগোনা। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন চাকরি, পদোন্নতি, অপসারণ ও অব্যাহতি, বিভাগীয় মামলাসহ বিভিন্ন ধরনের মামলার বিচার চাওয়া সরকারি চাকরিজীবীরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু দেশের ১৪ লাখ সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীর চাকরিসংক্রান্ত সমস্যা নিরসনে গঠিত প্রশাসনিক ও আপিল ট্রাইব্যুনালের অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। মামলাজট নিরসনেও নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ। অবকাঠামোগত নানা সমস্যাকে সঙ্গী করে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে গত ৩২ বছর যাবৎ টিনশেড ভবনেই চলছে বিচার কার্যক্রম।

ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে ৯৫০টি মামলা বিচারাধীন। এ ছাড়া ঢাকায় তিনটি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে এক হাজার ৫২টি এবং ঢাকার বাইরে চারটি ট্রাইব্যুনালে দেড় শতাধিক মামলা বিচারাধীন। সাম্প্রতিক সময়ে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম ধীর গতিতে চলতে থাকায় ২০১১, ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৫ সালের মামলাও বর্তমানে বিচারাধীন। বর্তমানে হাইকোর্টে এ ধরনের প্রায় ১০ হাজার রিট মামলা বিচারাধীন। এসব মামলা নিষ্পত্তির জন্য প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে ফেরত পাঠিয়েছেন আপিল বিভাগ।

ট্রাইব্যুনালে নিবন্ধিত পাঁচ শতাধিক হলেও প্রায় দেড়শ আইনজীবী নিয়মিত প্র্যাকটিস করছেন। কিন্তু তাদের বসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। জায়গা থাকলেও বিচারক ও কর্মকর্তাদের গাড়ি পার্কিং করার কোনো নির্ধারিত স্থান নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সিদ্দিক উল্যাহ মিয়া বলেন, যুগের সাথে তালমিলিয়ে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালও আধুনিকায়ন করা উচিত— এটা সময়ের দাবি। ট্রাইব্যুনালে প্রয়োজনীয় জনবল ও কাঠামোগত উন্নয়ন জরুরি। তবে ট্রাইব্যুনাল আগের চেয়ে উন্নত হচ্ছে। নতুন চেয়ারম্যান অনেক তৎপর। তিনি আসার পর আমরা ট্রাইব্যুনালে প্রাণ ফিরে পেয়েছি। বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ কমাতে তিনি নানা উদ্যোগ নিয়েছেন।

আগে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের যেকোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিসংক্রান্ত বিষয়ে সংক্ষুব্ধ হলে প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টে রিট করতে পারতেন। এখন সেটা বন্ধ। কারণ প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল থাকার পরও তারা সেখানে না গিয়ে সরাসরি হাইকোর্টে রিট করছেন। তবে ট্রাইব্যুনালে বিচারকালে যদি সরকারি চাকরিজীবী আইন লঙ্খিত হয়— এমন আদেশ বা রায় হয় সেক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধরা তা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে আসতে পারবেন। আপিল বিভাগ গত মে মাসে এ সংক্রান্ত একটি মামলা নিষ্পত্তি করে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন।

প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল বারের সভাপতি আব্দুর রহিম কাজল বলেন, বিচারকাজে ধীরগতির নানা কারণ আছে। টিনশেড ভবনে আদালত কোনোভাবেই মানানসই নয়। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ও জেলা জজ পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা টিনশেড ভবনে বসে বিচার করতে পারেন না। তাছাড়া ভবনটা অনেক দিনের পুরানো। বৃষ্টি হলেই পানি চুইয়ে পড়ে। মামলার নথিপত্র, রেকর্ড— সব নষ্ট হয়ে যায়। আমরা ঠিকমতো বসতে পারি না। তিনি বলেন, আপিল ও প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালও একটি আদালত। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের মর্যাদা ও নিরাপত্তার স্বার্থে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ খুবই জরুরি। তিনি বলেন, প্রশাসনিক বারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গত ফেব্রুয়ারি মাসে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরে। পাশাপাশি সংগঠনের পক্ষ থেকে কয়েকটি প্রস্তাবনাও দেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে— প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের স্থায়ী অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রশাসনিক ও আপিল ট্রাইব্যুনালে রেকর্ডরুম স্থাপন, জনবল নিয়োগ, আইনজীবী বসার স্থান সংকুলান, লাইব্রেরিতে বই সরবরাহ প্রভৃতি। এখন দেখা যাক মন্ত্রণালয় কি পদক্ষেপ নেয়।

দেশের মোট সাতটি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল আছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই (১, ২ ও ৩) তিনটি। অপর চারটি— চট্টগ্রাম, খুলনা, বগুড়া ও বরিশালে। এসব ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল নিষ্পত্তির জন্য একমাত্র প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনাল। এমএলএসএস থেকে সচিব পর্যন্ত সরকারি যেকোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের চাকরি নিয়ে প্রশাসনিক কোনো সংকটে পড়লে এই ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হন চাকরিজীবীরা। এছাড়া আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরতদের চাকরিগত সমস্যা নিয়ে সরকারের এ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে মামলা করা হয়। ১৯৮২ সালে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের কয়েক বছর পর আপিল ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রথম থেকেই এটি ছিলো গণভবনে। পরে এটা ঢাকা জজকোর্ট এলাকায় সরিয়ে নেয়া হয়। ১৯৮৮ সালে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালটি ১৪ নম্বর আব্দুল গণি রোডে স্থানান্তর করা হয়। সেই থেকে অদ্যাবধি গত ৩২ বছর আপিল ও প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম চলছে সচিবালয় সংলগ্ন গণি রোডের টিনশেড ভবনে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বেশ সচল থাকলেও বর্তমানে ট্রাইব্যুনালটি গতি হারিয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শওকত হোসেন আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান। জেলা জজ পদমর্যাদাসম্পন্ন দুজন মমতাজ পারভীন ও বদরুন নাহার এই ট্রাইব্যুনালের সদস্য। প্রায় ২শ বছরের পুরানো দোতলা ভবনের ওপর তলায় নিবন্ধন অধিদপ্তরের প্রধানের কার্যালয় এবং নিচতলায় প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও দুজন সদস্যের চেম্বার।

ঢাকার বাইরে বগুড়া, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও খুলনায় প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল থাকলেও রাজশাহী, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগে কোনো প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয়নি। ফলে এসব বিভাগের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মামলা করতে অন্য বিভাগের ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। এতে এসব এলাকার সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।

আমারসংবাদ/জেআই