Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

সাতে সাত কলেজের জয়

আবদুর রহিম ও ওবাইদুর সাঈদ

ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২১, ০৭:০৫ পিএম


সাতে সাত কলেজের জয়
  • সকাল ৯টা-৪টা পর্যন্ত অচল ছিলো পুরো ঢাকা
  • পুলিশের ৫ মিনিটের ঘোষণাকে উপেক্ষা; সেলিম উল্লাহ অবরুদ্ধ 
  • অ্যাকশন নিবৃতে পুলিশকে গোলাপ দিয়ে বরণ করলো শিক্ষার্থীরা

সাতে সাত কলেজের জয়! আন্দোলনে দাবি আদায়ের দলিলে। গতকাল ইতিহাসের পাতায় অন্যরকম নজির ঘটলো। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সাত ঘণ্টার আন্দোলনে দাবি মেনে নিলো প্রশাসন। গত মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হঠাৎ করে সাত কলেজের চলমান পরীক্ষাসহ সব ধরনের পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দেয়। ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক রাত ৮টা থেকে সোয়া ১০টা পর্যন্ত কয়েকশ শিক্ষার্থী নীলক্ষেত মোড়ে অবস্থান নেন। প্রতিবাদ জানান প্রশাসনের সিদ্ধান্তের। পরে রাত সোয়া ১০টার দিকে তারা চলে যান। ঘোষণা দিয়ে যান বুধবার সকাল থেকে আবার অবস্থান নেবেন নীলক্ষেতে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সকাল থেকেই শতশত শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়ে নীলক্ষেত মোড় থেকে সাইন্সল্যাব পর্যন্ত অবরোধ করেন। স্লোগানে স্লোগানে ছড়ান উত্তাপ। অবস্থান নিয়ে সমাধানের জন্য বার্তা দেন প্রশাসনকে। স্লোগানে বলতে থাকেন, ছাত্রজীবন ডুবছে জলে, করোনা শুধু পরীক্ষার হলে, থাকার কথা পরীক্ষার হলে আজ কেন রাজপথে, দাবি মোদের একটাই চলমান পরীক্ষার শেষ চাই, পরীক্ষা নিয়ে প্রহসন চলবে চলবে না, এক দফা এক দাবি ফেব্রুয়ারিতে পরীক্ষার সমাপ্তি চাই, সাত কলেজের ১৫-১৬ সেশনের অভিভাবক কে? ঢাবির টালবাহানা মানবো না, এসো ভাই এসো বোন গড়ে তুলি আন্দোলন, চলমান পরীক্ষা নাও, আমাদের মুক্তি দাও।

এভাবেই চলতে থাকে দুপুর পর্যন্ত। অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি সেবা ছাড়া আর কিছুই চলতে দেয়নি। ফলে নিউমার্কেট-আজিমপুর, শাহবাগ থেকে সাইন্সল্যাব সড়কের উভয় পাশে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আবদুল্লাহপুর থেকে মিরপুর রোডে ল্যাবএইড পর্যন্ত সড়কটি থমকে ছিলো। রমনা পার্কের সামনের সড়ক, শাহবাগ, কাঁটাবন মোড় ও বাটা সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কের অবস্থাও ছিলো একই। পুরান ঢাকার বংশাল, নয়াবাজার সড়কেও যানজটের সৃষ্টি হয় বলে জানা গেছে। একই অবস্থা মহাখালী থেকে সাত রাস্তা পর্যন্ত সড়কেও। এমন পরিস্থিতিতে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাত কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত (ফোকাল পয়েন্ট) আই কে সেলিম উল্লাহ ঢাকা কলেজ ও ইডেন মহিলা কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষক নিয়ে ওই এলাকায়  যান। তিনি জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাত কলেজের অধ্যক্ষদের ডাকা হয়েছে। সেখানে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে বলে তিনি আশা করেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা ভুয়া ভুয়া বলে স্লোগান দেন, তাকে লক্ষ করে পানি ছিটাতে থাকেন। সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দুপুরে জরুরি বৈঠক হবে বললে, মুখের কথা মানি না, লিখিত ছাড়া যাবো না বলে স্লোগান তুলেন। একপর্যায়ে আই কে সেলিম উল্লাহ শিক্ষার্থীদের কাছে প্রায় মিনিট দশেক অবরুদ্ধ হয়ে যান। এর কিছুক্ষণ পরই জানা যায়, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দুপুরে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান, উপ-উপাচার্য এবং সাত কলেজের অধ্যক্ষরা ওই ভার্চুয়াল সভায় অংশ নেন।

এর মধ্যে ভার্চুয়াল মিটিং চলাকালে নীলক্ষেত ও সাইন্সল্যাব মোড়ে পুলিশের মুখোমুখি হয়ে উঠেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশকেও সাঁজোয়া যান নিয়ে প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়। এর মধ্যে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নীলক্ষেত মোড় থেকে সরে যেতে পাঁচ মিনিট সময় দেয় পুলিশ। ডিসি রমনা সাজ্জাদুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, আমরা ছাত্রদের পাঁচ মিনিটের মধ্যে সরে যেতে বলবো। না হয় আমরা অ্যাকশনে যাবো। আমরা তাদের অনুরোধ করেছি সরে যেতে। যানজট শুরু হয়ে গেছে। সারা ঢাকার মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছে। আমরা অ্যাকশনে গেলে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে। তখন আমাদের দায় থাকবে না। পুলিশের এই বক্তব্যের পর প্রায় ঘণ্টা দেড়েক সাইন্সল্যাব এলাকায় পুলিশ-শিক্ষার্থীরা মুখোমুখি হয়ে পড়ে। চলেছে দীর্ঘক্ষণ বাকবিতণ্ডা। একপর্যায়ে জলকামানের মুখে পুলিশের অ্যাকশন মুহূর্তে দুপুর আড়াইটায় সাইন্সল্যাব মোড়ে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা পুলিশকে গোলাপ দিয়ে বরণ করেন। গোলাপ পাওয়ার পর পুলিশ তখন প্রস্তুতি সঙ্কীর্ণ করে পিছু হটে।

এরপর বিকাল পৌনে ৪টার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার এবং পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা এলে সড়কে অবস্থান নিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। আনন্দ প্রকাশ করে স্লোগান দিতে দিতে তারা ফিরে গেলে বিকাল ৪টার পর থেকে সড়ক আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করে। সাত সরকারি কলেজের প্রধান সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘সাত কলেজের চলমান পরীক্ষাগুলো অব্যাহত থাকবে। গতকাল এবং আজকের পরীক্ষাগুলোর তারিখ ওয়েবসাইটে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে।’ তবে শর্ত দেয়া হয়েছে, পরীক্ষা চলাকালে কলেজগুলোর হোস্টেল খোলা যাবে না এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে।

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘আজ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সাত কলেজের অধিভুক্ত অধ্যক্ষ মহোদয়গণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যসহ আমাদের একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সেখানে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি যে, এই সাত কলেজের চলমান এবং ঘোষিত পরীক্ষাগুলো পরীক্ষার্থীরা হোস্টেলে না ওঠার শর্তে চলমান থাকবে। আমি আশা করি, এই সাত কলেজের কোনো পরীক্ষা নিয়ে কোনো সংশয় থাকবে না, পরীক্ষাগুলো চলবে। কিন্তু আমাদের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ২৪ মে খুলবে আর হলগুলো খুলবে ১৭ মে। তার আগে সকল প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয় করবে। সেক্ষেত্রে যেখানে যে সহযোগিতা লাগবে, সে সহযোগিতা আমরা দেবো।’

২০১৫-১৬ ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী তাসনুমা বিনতে জামান বলেন, আমাদের ফাইনাল ইয়ারের আর মাত্র একটা পরীক্ষা বাকি। আজকে সেটি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করে পরীক্ষা স্থগিত করে দেয়া হলো। এটা আমাদের সাথে প্রহসন। একটা পরীক্ষার জন্য কি আরও এক বছর নষ্ট করতে হবে? এমনিতেই ২০১৯ সালের পরীক্ষা ২০২১ সালে নেয়া হচ্ছে। একই কলেজের ফারিহা হাসনাত বলেন, আমাদের ফোর্থ ইয়ারের পরীক্ষা প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই পর্যায়ে এসে পরীক্ষা স্থগিত করে দেয়ার কোনো মানে হয় না। ২০১৯ সালে যে পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ছিলো, তা এখনো আটকে আছে। আমরা আর কত সেশনজটে পড়ে থাকবো? আমরা আমাদের ক্যারিয়ার নিয়ে চরম হতাশা ও অনিশ্চয়তায় আছি। ঢাকা কলেজের ২০১৫-১৬ সেশনের দর্শন বিভাগের ছাত্র বাঁধন বলেন, আজকে আমাদের হলে থাকার কথা। একটি মাত্র পরীক্ষাই বাকি। এ পরীক্ষাটি দিলে আমাদের আজ পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ছিলো। একটি পরীক্ষার জন্য আবারো ঝুলে থাকা কোনো মানে হয় না। এ সিদ্ধান্ত অত্যন্ত অন্যায়। ঢাকা কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শাহাদাত হোসাইন জানান, আমরা আন্দোলনে সফল হয়েছি। সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যেকোনো ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, সেটা আজকে প্রমাণ হলো।

সরকারি তিতুমীর কলেজের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মো. জুয়েল রানা বলেন, আমাদের (২০১৫-১৬) শিক্ষাবর্ষ, যেই পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ২০১৯ সালে, কিন্তু সেই পরীক্ষা আমরা এখনো ২০২০ সালেও শেষ করতে পারি নাই, ৯টি পরীক্ষার মধ্যে আটটি পরীক্ষা শেষ হয়েছে কিন্তু তখন করোনা ভাইরাসের সমস্যা ছিলো না, এখন একটি পরীক্ষার জন্য করোনা ভাইরাসের সমস্যা, এটা তো রাজনৈতিক ইস্যু, বন্ধের পর পরীক্ষা নিলে আমরা আরও ছয় মাস পিছিয়ে যেতাম এই জন্য আমরা আন্দোলন করতে বাধ্য হয়েছি। এমনকি পরীক্ষার পর রেজাল্ট পাবলিস্ট হতেও ছয়-সাত মাস সময় নেয়, তাই চার বছরের কোর্স শেষ হতে প্রায় সাত বছর সময় চলে যায়।

দিনব্যাপী আন্দোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে সাত কলেজের সমন্বয়ক ও ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার আমার সংবাদকে জানান, ‘আমরা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে পরীক্ষা স্থগিত করেছিলাম। তারা যেহেতু আন্দোলন করেছে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বিবেচনা করে পরীক্ষা নেয়ার কথা বলেছেন। আমরা শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া মেনে নিয়েছি। এখন আমি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলবো, তারা ভালো করে পড়াশোনা করুক এবং পরীক্ষা দিক।’

আমারসংবাদ/জেআই