Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪,

সিন্ডিকেটের ভয়াবহ দৌরাত্ম্য

নিজস্ব প্রতিবেদক

ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২১, ০৯:০৫ পিএম


সিন্ডিকেটের ভয়াবহ দৌরাত্ম্য
  • ফের অভিবাসন ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কা
  • উদ্বিগ্ন বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিসহ পুরো খাত

করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার যখন প্রায় খোলার পথে, তখন ফের তা অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে সিন্ডিকেটের ভয়াবহ দৌরাত্ম্য। এ সিন্ডিকেটের হোতা বলা হয়ে থাকে বেস্টিনেটকে। ঢাকা ও কুয়ালালামপুরে দেদার চলছে প্রতিষ্ঠানটির অপতৎপরতা। এ হীনকর্মে নেপথ্যে থেকে মদত দিচ্ছেন বাংলাদেশেরই বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি যারা জনশক্তি সেক্টরে কোনোভাবেই জড়িত নয়। জনশক্তি রপ্তানিকারী এজেন্সির মালিকরা বরাবরই এ অভিযোগ করে আসছেন। তারা বলছেন, বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্সের সম্ভাবনাময় এ শ্রমবাজার বন্ধও হয়ে গিয়েছিল এ সিন্ডিকেটের অপতৎপরতার কারণেই।

গুটিকয়েক এজেন্সি মিলে করা এ সিন্ডিকেট এ খাতে খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এমন সিন্ডিকেট গঠন প্রবাসী শ্রমিকের স্বার্থ ও দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করবে। বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিসহ পুরো খাতকেই খাদে ফেলবে— আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সিন্ডিকেট হলে ফের অভিবাসন ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি নানা ধরনের অনিয়ম হবে। শুধু তাই নয়, অর্থপাচারেরও আশঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের উচিত নেপালকে অনুসরণ করা। নেপালে প্রায় ১৬শ রিক্রুটিং এজেন্সি সম্মিলিতভাবে মালয়েশিয়ায় দেশটির কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে একটি মডেল হিসেবে নজির স্থাপন করেছে স্বচ্ছতা ও স্বল্প-ব্যয়ের। বাংলাদেশের লাইসেন্স নবায়নকৃত ১২শ এজেন্সিও সম্মিলিতভাবে এগিয়ে এলে শ্রমিক তথা পুরো দেশই লাভবান হবে। লাইসেন্স  সংখ্যা যত বেশি হবে শ্রমিক তত বেশি প্রেরণ করা যাবে এবং খরচ তত কম হবে, কিন্তু লাইসেন্স সংখ্যা যত কম হবে শ্রমিক তত কম প্রেরণ হবে উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ে।  আর  সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর বিপরীতে গুটিকয়েক এজেন্সি এ দায়িত্ব পেলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বরং কুক্ষিগত হয়ে পড়বে; বাড়বে প্রবাসীকর্মীদের অর্থব্যয় ও লাঞ্ছনা-বঞ্চনা। কাজেই কতিপয় এজেন্সির হাতে শ্রমবাজার তুলে দিয়ে স্রেফ তাদের স্বার্থ রক্ষা করা কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না।

এদিকে বৈধ সব রিক্রুটিং এজেন্সি হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলছে, সিন্ডিকেটের হাতে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার তুলে দেয়া হলে তারা আন্দোলনের জন্য রাজপথে নামবে, স্থগিত করতে হাইকোর্টে যাবে এবং এমনকি আইনি লড়াই চালিয়ে যাবে। এতে অনির্দিষ্টকালের জন্য অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। যাতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে দেশের অর্থনীতি, কমে যাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ। উল্লেখ্য, মালয়েশিয়া অভিবাসন সেক্টরে কোনো প্রকার সিন্ডিকেট করা যাবে না এই মর্মে আপিল বিভাগ রায়ও প্রদান করেছে। কেস নম্বর- Civil Petition For Leave To Appeal No. ৮৮২ ২০১৭।

নেপালের নজির তুলে ধরে বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো আরও বলছে, বিশ্বব্যাপী যখন প্রতিযোগিতামূলক খোলাবাজার নীতির জয়জয়কার, তখন সীমিত সংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সির হাতে শ্রমবাজার তুলে দেয়া হবে মারাত্মক আত্মঘাতী; অশান্ত হয়ে উঠবে শ্রমবাজার। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যেই এক সময় বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার। সে সময় কর্মী প্রেরণে বেস্টিনেট যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল, তাতে করে কর্মীদের কাছ থেকে ধাপে ধাপে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার পথ তৈরি হয়। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে একপর্যায়ে মালয়েশিয়ার সরকার বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমদানি বন্ধ করে দেয়। সম্ভাবনাময় এ শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ সরকার সচেষ্ট হয় ফের তা চালু করার। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি দুই দেশের মন্ত্রীপর্যায়ে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। একদিনের সেই বৈঠক দুদিনে গড়ায়। কিন্তু এর পরও কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই তা শেষ হয়। কারণ কুয়ালালামপুরের পক্ষ থেকে ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সি ও বিতর্কিত বেস্টিনেট কোম্পানির মালিকানাধীন এফডব্লিউসিএমএস প্রযুক্তির মাধ্যমে কর্মী নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু শ্রমিক ও খাত-সংশ্লিষ্টদের কথা তথা দেশের কথা বিবেচনায় রেখে ঢাকা এর বিরোধিতা করে সব বৈধ এজেন্সিকে সমান সুযোগ দেয়ার দাবি জানায়। এ নিয়ে মতানৈক্যের কারণে শেষ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয় বৈঠক। ঢাকার এ ভূমিকাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন জনশক্তি রপ্তানিকারক এজেন্সিগুলোর মালিকরা। বিশেষ করে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ও একই মন্ত্রণালয়ের সচিবকে ধন্যবাদ জানিয়ে তারা বলছেন, ২০১৭-১৮ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে এটাই প্রমাণিত যে, সিন্ডিকেটের কারণে অভিবাসন ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যায়, নানা ধরনের অনিয়মের পথ তৈরি হয়, শ্রমিকরা নানা হয়রানির শিকার হয় এবং হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যায়।

তৎপর সেই হোতারা : মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার খোলার সম্ভাবনা দেখা দেয়ার পর থেকে তৎপর হয়ে উঠেছে সেই পুরনো হোতা আমিন-স্বপন সিন্ডিকেট। সরকারের একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির এতে মদত রয়েছে বলে তারা নিজেরাই বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ফায়দা নেয়ার অপচেষ্টা করছে। তাদের নানা অপতৎপরতা, অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রে সরকারের ভাবমূর্তি ও সুনাম দেশের অভ্যন্তরে ও অন্তর্জাতিকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

সরকারের জন্য অত্যন্ত  উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে আমিন-স্বপন চক্রটি সিন্ডিকেটের ২৫টি লাইসেন্সের নাম অন্তর্ভুক্তির নামে ইতোমধ্যেই  লাইসেন্স প্রতি দুই থেকে পাঁচ কোটি টাকা করে বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন ও মানিলন্ডারিং করেছে বলে একাধিক মাধ্যম থেকে শোনা যাচ্ছে। যা দ্রুত সরকারের গভীর নজরদারির আওতায় আনা প্রয়োজন।

আমিন-স্বপন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী পাঠাতে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) থেকে বেস্টিনেট (বাংলাদেশ) লিমিটেড নামে অনুমোদন নিয়েছে, যেখানে কোম্পানি চেয়ারম্যান হিসেবে আমিনুল ইসলাম বিন আবদুল নূর (দাতো শ্রী আমিন) ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে মো. রুহুল আমিন স্বপনের নাম রয়েছে। আমিনুলের নামে ১০ হাজার ও রুহুল আমিনের নামে দুই হাজার শেয়ার রয়েছে। আশঙ্কার বিষয়, এফডব্লিউসিএমএস-কে ব্যবহার করে বাংলাদেশের জনশক্তি বাজার মুষ্টিবদ্ধ করার অপতৎপরতায় লিপ্ত আমিন-স্বপন সিন্ডিকেট।এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনশক্তি রপ্তানিকারক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, সরকারের মূল উদ্দেশ্য হলো— কম খরচে নিরাপদ অভিবাসন। সুতরাং লাইসেন্সের সংখ্যা কমিয়ে সেটা করা সম্ভব না। যা গত ২০১৬ থেকে ১৮-তে যে পদ্ধতি ছিলো যেখানে সীমিত সংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে করা হয়েছিল, তাদের একটা কমিটমেন্ট ছিলো তারা মাত্র ৩৫ হাজার টাকায় কর্মী পাঠাবে। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা গেছে, সাড়ে তিন লাখ থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয়ে কর্মী মালয়েশিয়ায় গেছে। তাহলে এটা প্রমাণিত রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা সীমিত করলে অভিবাসন ব্যয় কমানো সম্ভব নয়।

বেসরকারি সংস্থা ব্রাকের অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান শরিফুর হাসান বলেন, সিন্ডিকেট করা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। বৈধ সকল রিক্রুটিং এজেন্সিকে সুযোগ দেয়া উচিত। ২৫ থেকে ৩০টি এজেন্সিকে সুবিধা দেয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক হবে না। এতে অভিবাসন ব্যয় কম হওয়ার সুযোগ থাকবে না। বরং অনিয়মের আশঙ্কাই থেকে যাবে পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়।

এদিকে অভিবাসন নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা রেফিউজি অ্যান্ড মিগ্র্যাটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) পরিচালক  মেরিনা সুলতানা বলেন, বৈধ লাইন্সেধারী সব রিক্রুটিং এজেন্সির অধিকার রয়েছে কর্মী পাঠানোর। কিন্তু গুটিকয়েক এজেন্সিকে সুবিধা দেয়া আর অন্যদের বঞ্চিত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। তিনি বলেন, কয়েকটি এজেন্সিকে অনুমোদন দিলে ওইসব এজেন্সিগুলো একা কাজ করবে না, তারা অন্যদের দিয়েই কাজ করাবে। এক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার প্রশ্ন আসবে। কোনোভাবেই প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ হবে না। কর্মী পাঠানোর পর কোনো ধরনের সমস্যা হলে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করবে।

আমারসংবাদ/জেআই