Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

রিকশার প্যাডেলে জীবন রোজিনার

কামরুজ্জামান বাঁধন, মির্জাগঞ্জ (পটুয়াখালী)

মার্চ ৭, ২০২১, ০৮:৫০ পিএম


রিকশার প্যাডেলে জীবন রোজিনার

রোজিনা বেগম (৩২)। জীবনযুদ্ধে সংগ্রামী এক নারী। ‘নবীর শিক্ষা করোনা ভিক্ষা মেহনত কর সবে’— এ শিক্ষা বাস্তবেই রূপ দিয়েছেন বিধবা ও শারীরিক প্রতিবন্ধী দুই সন্তানের জননী। প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও পেটের তাগিদে ভিক্ষা না করে রিকশা চালিয়ে সন্তানদের নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন রোজিনা বেগম।

রোজিনার জন্ম আগৈলঝাড়া উপজেলার বাগদা গ্রামে। সাত বছর বয়সে পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে তার বাম পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ বিকলাঙ্গ হয়ে যায়। চিকিৎসার জন্য চলে যান ঢাকায় ফুফুর কাছে। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েও কোনো সুফল পাননি। ঢাকায় ফুফুর সাথে বসবাসের সময় কিশোরী বয়সে বরিশালের মুলাদী উপজেলার খেজুরতলা গ্রামের দরিদ্র মো. সুমন খানের সাথে পারিবারিকভাবে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন রোজিনা। বিয়ের পর স্বামী সুমন খানকে নিয়ে মিরপুর ১০ নম্বরে ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন। দাম্পত্য জীবনে তাদের কোলজুড়ে আসে এক  ছেলে ও মেয়ে। স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে সুখেই সংসার কাটছিল রোজিনার। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ২০১৪ সালে সুখের আঙিনা ঢেকে যায় কালো মেঘে। দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে স্বামী সুমন খান মারা যান। প্রতিবন্ধী রোজিনার জীবনে নেমে আসে অমাবস্যার অন্ধকার। ওই সময় সাত বছরের মেয়ে রিতু আক্তার ও চার বছরের ছেলে হূদয়কে নিয়ে শুরু করেন বেঁচে থাকার এক জীবনযুদ্ধ। স্বামীর মৃত্যুর পর জমানো সামান্য কিছু টাকা দিয়ে চা-বিস্কুট বিক্রি শুরু করেন। চা বিক্রি করে উপার্জিত টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় রোজিনাকে। সিদ্ধান্ত নেন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ভিক্ষায় জড়াবেন না। প্রতিবন্ধী এক ব্যক্তিকে অটো গাড়ি চালাতে দেখে গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহের সিদ্ধান্ত নেন। জমানো টাকা থেকে ৭০০ দিয়ে ১৫ দিন গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়ে সফলতা অর্জন করেই ঢাকার শহরে ভাড়ায় করা রিকশা চালানো শুরু করেন। সাড়া দিন পরিশ্রম করে গাড়ি চালিয়ে যে টাকা পেতেন তা দিয়ে যেনতেনভাবেই সংসার চালাতেন। যতসামান্য আয় দিয়ে ছেলে-মেয়ে নিয়ে ঢাকা শহরে দুর্বিষহ হয়ে পড়ে দুই সন্তানের জননী রোজিনার জীবন।

সিদ্ধান্ত নেন গ্রামে ফেরার। দুই সন্তান নিয়ে আগৈলঝাড়া উপজেলার বাগদা গ্রামের পিত্রালয়ে ফিরলেও বাবার অভাব-অনটনের সংসারে বেশি দিন থাকতে পারেননি। রোজিনার ছোট ভাই আফান তালুকদার বিয়ে করেন পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার মির্জাগঞ্জ ইউনিয়নের চৌকিদার বাড়িতে। এ সূত্রেই মির্জাগঞ্জের ওই বাড়িতে তিন বছর পূর্বে দুই সন্তান নিয়ে আশ্রয় নেন রোজিনা বেগম। ভাইয়ের অভাব-অনটনের সংসারে বোঝা না হয়ে উপজেলা সদর সুবিদখালী কলেজ রোড এলাকায় এক হাজার ২০০ টাকার মাসিক ভাড়ায় এক রুমের একটি ঘর ভাড়া নেন। পেটের তাগিদে মির্জাগঞ্জে এসে ভিক্ষা না করে কর্ম হিসেবে বেছে নেন ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানো। স্থানীয় গ্যারেজ মালিক আনছার মল্লিকের কাছ থেকে দৈনিক ২০০ টাকা জমা চুক্তিতে রিকশা নিয়ে সকাল হলেই বেরিয়ে পড়েন প্রতিবন্ধী রোজিনা। সন্ধ্যা পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে মালিককে টাকা ও রিকশা বুঝিয়ে দিয়ে ১৫০-২০০ টাকা নিয়ে ঘরে ফেরেন রোজিনা আক্তার।

স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় ছেলে মো. হূদয়কে (১০) স্থানীয় সুবিদখালী মোহাম্মাদিয়া নূরানি মাদ্রাসায় শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করিয়েছেন। কিন্তু বড় মেয়ে রিতু আক্তার (১৪) ঢাকার ধানমন্ডির রায়ের বাজার এলাকার কচিকণ্ঠ বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করে মায়ের সাথে মির্জাগঞ্জে ফিরে এলেও কপালে জোটেনি লেখাপড়া। বাধ্য হয়েই মায়ের অবর্তমানে ছোট ভাইকে দেখাশুনা করা আর বাসায় রান্না করে সময় পার করছে রিতু।

রিতু আক্তার (১৪) জানায়, ‘মায়ের সাথে এখানে আসছি, টাকার অভাবে বই কিনতে পারি নাই তাই স্কুলেও ভর্তি হইতে পারি নাই। আমি পড়তে চাই, লেখাপড়া শিখে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হইতে চাই।’ প্রতিবন্ধী রোজিনা বেগম বলেন, ‘মির্জাগঞ্জে এসে রিকশা চালানো শুরু করলে প্রথম প্রথম আমার গাড়িতে ভয়ে কেউ উঠতে চাইতো না। এখন আমার সম্পর্কে জানতে পেরে যাত্রী হিসেবে অনেকেই গাড়িতে ওঠেন। আমার একটি পা পঙ্গু হয়েছে তাতে কি হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা দুটি হাত ও একটি পা-তো সচল রেখেছেন। পরিশ্রম করে সামান্য উপার্জন দিয়ে ছেলে-মেয়ে নিয়ে কোনো রকমে সংসার চালাই। বিধবা ভাতার জন্য আবেদন করেছি কিন্তু এখনো পাই নাই। আমার যদি নিজের একটি গাড়ি থাকতো তাহলে সারা দিনের উপার্জনের টাকা থেকে মালিককে ২০০ টাকা দেয়া লাগতো না, ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভালোই থাকতে পারতাম।’

রিকশা মালিক আনছার মল্লিক বলেন, ‘রোজিনা আমার মেয়ের মতো। ও ভিক্ষা না কইরা কাম কইরা খাইতে পছন্দ করে। রোজিনার ছোট দুইটা বাচ্চার মুখের দিকে তাকাইয়া আগের ড্রাইভারটারে বাদ দিয়া ওরে (রোজিনা) গাড়ি দিছি। গাড়ির আগের ড্রাইভার উল্টাপাল্টা চালাইতো, সন্ধ্যায় গাড়ি জমা দেয়ার সময় প্রায়দিনই নানান অজুহাতে টাকা কম দিতো। ওর হাতে গাড়ি দিয়া আমি নিশ্চিন্ত থাকি, ও ভালো গাড়ি চালায়। এক টাকাও কম দেয় না।’

স্থানীয় বাসিন্দা মো. সাইফুল ইসলাম ও মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের সমাজে অনেক সুস্থ মানুষ ভিক্ষা করলেও রোজিনা বেগম প্রতিবন্ধী ও বিধবা হওয়া সত্ত্বেও কাজ করে দুটি সন্তান নিয়ে কষ্ট করে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের রোজিনার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানাই।’

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোসা. তানিয়া ফেরদৌস আমার সংবাদকে বলেন, ‘একজন বিধবা নারী প্রতিবন্ধী হয়ে ভিক্ষা না করে রিকশা চালিয়ে সন্তানদের নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। আমি তাকে স্যালুট জানাই। রোজিনার থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। ৮ মার্চ আর্ন্তজাতিক নারী দিবসে জীবনযুদ্ধে সংগ্রামী নারী রোজিনা বেগমকে জয়িতা পুরস্কারে ভূষিত করার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। তাকে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছি। এছাড়াও মুজিববর্ষে দরিদ্রদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার একটি ঘর ও তার উপার্জনের জন্য একটি ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা ব্যাটারিচালিত ছোট বাহন (অটো) দেয়ার জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

আমারসংবাদ/জেআই