মুফতী মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল
মার্চ ১৮, ২০২১, ০৯:৩০ পিএম
আরবী “উখওয়াত” শব্দের অর্থ- ভ্রাতৃত্ব। ভাইদের মাঝে বিদ্যমান সম্পর্ক। পারিভাষিক অর্থে পরস্পরের মধ্যে বিরাজমান হূদ্যতা, আন্তরিকতা, সৌহার্দ্য-সমপ্রীতী ও বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ককে ভ্রাতৃত্ব বলে। এ ভ্রাতৃত্ব সাদারণত ভাষা, বর্ণ, পেশা জীবনযাত্রা, ভৌগলিক অবস্থান ও জন্ম সম্পর্কের উপর গড়ে ওঠে। ইসলামের শান্তি প্রতিষ্ঠার মিশনে সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হল এই উখওয়াত। কেননা ভাইদের মাঝে যে সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে বিশ্ব মানবকে যদি সে সম্পর্কে আবদ্ধ করা যায় তাহলে সহজেই পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রকৃতপক্ষে দুই প্রকার ভ্রাতৃত্বই ফলপ্রসু হতে পারে এবং মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে- ১. বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব, ২. ইসলামী ভ্রাতৃত্ব।
পৃথিবীর সব মানুষ হযরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) এর সন্তান। তাঁরা আমাদের সকলের আদি পিতামাতা। তাঁদের থেকেই এই পৃথিবীর সব মানুষের বিকাশ। আদম (আ.) এর এই আদি পিতৃত্ব বিবেচনায় পৃথিবীর সব মানুষ ভাই ভাই সম্পর্কে সম্পৃক্ত। ভ্রাতৃত্বের এ ধারাটি পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত বলে এ ভ্রাতৃত্বের নাম বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব। আল্লাহ তায়ালা এর স্বীকৃতি দিয়ে বলেছেন- হে মানুষ! নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রভূক্ত বানিয়েছি। যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার, (হুজুরাত, ১৩)। রাসূল (সা.) বলেন- তোমরা সকলেই আদম হতে এবং আদম মাটি হতে সৃষ্টি, (সুনানু আবু দাঊদ, ৪৪৫২)। উপরোক্ত বর্ণনার আলোকে বুঝা যায় যে, আমরা সবাই আদম ও হাওয়া (আ). এর সন্তান। সুতরাং আমরা পরস্পরের ভাই ভাই। এটা বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব। আর ইসলাম আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক মনোনীত একমাত্র জীবন ব্যবস্থা। এ জীবন ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ও অনুসারী হওয়ার কারণে দেশ, ভাষা, বর্ণ, গোত্র, আকার, প্রভৃতি নির্বিশেষে সকল মুসলমান ভাই ভাই, এটাই ইসলামী ভ্রাতৃত্ব। আল্লাহ বলেন- নিশ্চয়ই মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই, (হুজুরাত, ১০)। আর রাসূল (সা) বলেছেন- এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই, (বুখারী, ২২৬২)।
ইসলামী ভ্রাতৃত্ব মানুষের মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলে এবং মৌলিক মানবীয় গুণাবলীকে বিকশিত করে।
ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বৈশিষ্ট্য- ক) তাওহীদ ও রিসালাতভিত্তিক: ইসলামী ভ্রাতৃত্ব তাওহীদ বা আল্লাহ তাআলার একত্ববাদের সুদৃঢ় বিশ্বাস নির্ভর ভ্রাতৃত্ব। রাসুলের (সা) রিসালাত এবং রিসালাতের মাধ্যমে আনিত বিষয়ে অনুশীলনের মাধ্যমে এ ভ্রাতৃত্ব অস্তিত্ব লাভ করে। এ কারণে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব হলো তাওহীদ ও রিসালাতভিত্তিক ভ্রাতৃত্ব্। এ ভ্রাতৃত্বের মূলমন্ত্র হলো- আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর রাসূল। খ) পারস্পারিক ভালোবাসাভিত্তিক: ইসলামী ভ্রাতৃত্বের রক্ত সম্পর্কীয় ভ্রাতৃত্বের চেয়েও অধিকতর ভালোবাসার প্রকাশ থাকে। কেননা অন্যকোন ভিত্তি নয় বরং শুধু ভালোবাসার ভিত্তিতে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে উঠে এবং টিকে থাকে। এ হলো আল্লাহ তায়ালার মহান পরিকল্পনার অংশ। তিনি বলেন- তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে। তারপর আল্লাহ তাআলা তোমাদের অন্তরে সমপ্রীতি স্থাপন করেছেন। আর তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেলে, (আল-ইমরান, ১০৩)। গ) সুদৃঢ় একতাভিত্তিক: ইসলামী ভ্রাতৃত্ব বিশ্বাস, জীবন দর্শন ও জীবনবিধান অনুশীলনের অভিন্নতার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। যে জন্যে এ ভ্রাতৃত্ব মুসলিমদের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করে। তাদের ঐক্য ও সংহতির সুদৃঢ়তার জন্য আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ভালোবাসেন। তিনি ঘোষণা করেন- নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন যারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, যেন তারা সীসাঢালা প্রাচীর, (সূরা ছফ, ৪)। ঘ) নিঃস্বার্থ ভ্রাতৃত্ব: ইসলামী ভ্রাতৃত্ব সব স্বার্থপরতার মুলোৎপাটন করে আত্মত্যাগ ও ভালোবাসার ভিত্তিতে নিঃস্বার্থ ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলে। এ ভ্রাতৃত্বের দাবিতে মুমিনগণ একজন অপর জনের প্রয়োজন পূরণের মাধ্যমে পরিণত হন। রাসুল (সা) বলেন- একজন মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর যুলুম করবে না, তাকে শত্রুর হাতে সমর্পণও করবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে, আল্লাহ তাআলা তার প্রয়োজন পূরণ করবেন, (বুখারী, ২২৬২)। ঙ) দয়া ও কল্যাণকামিতা: ইসলামী ভ্রাতৃত্ব পারস্পারিক কল্যাণকামিতা ও দয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত। এখানে এক ভাই অপর ভাইয়ের কল্যাণ কামনা করে। কেননা এ কল্যাণ কামনা তাকে পৃথিবীতে শান্তি ও সমৃদ্ধি এবং পরকালে দেয় মুক্তির নিশ্চয়তা। রাসুল (সা) বলেন- এক মুসলিম অপর মুসলিমের উপস্থিত বা অনুপস্থিত অবস্থায় কল্যাণ কামনা করবে, (তিরমযি, ২৬৬১)। চ) উদারতা ও সাম্যবাদভিত্তিক : ইসলামী ভ্রাতৃত্ব মূলত বিশ্বভ্রাতৃত্বেরই আদর্শিক রূপ। এ ভ্রাতৃত্বে সব জাতির নিকট প্রেরিত আল্লাহর নবী-রাসূলগণের প্রতি ঈমান পোষণ করা হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন- আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না, (বাকারাহ, ২৮৫)।
তাছাড়া ইসলামী ভ্রাতৃত্ব মানবিক সাম্যবাদের সুমহান আদর্শভিত্তিক। শুধু মানুষ হিসেবে এ ভ্রাতৃত্বে কারো কোন শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করা হয়নি। রাসূল (সা.) বলেছেন- “মানুষ চিরুণীর দাঁতের মতো, আরবের উপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই অনারবের উপর, শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত হতে পারে কেবল তাকওয়ার ভিত্তিতে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত সে, তোমাদের মধ্যে যে বেশি তাকওয়াবান, (সূরা হুজুরাত, ১৩)।
বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ইসলামী ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব: ইসলাম সার্বজনীন, সর্বকালিন জীবন ব্যবস্থা। যে জন্যে পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে এব সুমহান আদর্শিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। ইসলামী ভ্রাতৃত্ব তাই বিশ্ব ভ্রাতৃত্বেরই বিশেষ রূপ। প্রথাসিদ্ধ বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ইসলামী ভ্রাতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ ভূমিকা পালন করতে পারে। ক) ঈমানের একান্ত দাবি: ইসলামী ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা কারো ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়। আল্লাহ তাআলা ও রাসুলের (সা.) ওপর ঈমান আনার সাথে সাথে মুমিনদের মধ্যে এ ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। এ ভ্রাতৃত্ব ঈমানী ভ্রাতৃত্ব। আল্লাহ তাআলা বলেন- মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই, (৪৯/১০)। এ ভ্রাতৃত্ব সর্বব্যাপী বিস্তৃত। এটি ব্যাপক এবং সার্বজনীন। ইসলামী উখওয়াতের এ ঈমানী দাবির ব্যাপকতার জন্যে স্বাভাবিকভাবেই তা বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে। খ) পারস্পারিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা: পৃথিবীর সব প্রান্তের মুসলিমদের মধ্যে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব সুন্দর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহের ফলে তারা সুমধুর সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন- তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর। যখন তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু। (ইসলাম গ্রহণের পর) তোমাদের অন্তরে আল্লাহ সমপ্রীতি স্থাপন করে দিয়েছেন। এরপর তাঁরই অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেলে (সূরা আল- ইমরান, ১০৩)। ইসলামী ভ্রাতৃত্ব তাই মানুষে মানুষে স্নেহ, মায়া, মমতা ও পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে সৌহার্দ ও সমপ্রীতি গড়ে তোলে। গ) সাম্য প্রতিষ্ঠা: সার্বজনীন বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির সবচেয়ে বড় বাধা হলো মানুষের তৈরি করা বিভিন্ন বিভেদ-বৈষম্য। ইসলামী ভ্রাতৃত্ব এ সব বিভেদ দূর করে মানুষ হিসেবে সকলের মানবিক মর্যাদা ও অধিকারের সমতা নিশ্চিত করে। রাসুল (সা.) বলেন- অনারবদের ওপর আরবদের বা আরবদের ওপর অনারবদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। বরং তোমরা সবাই আদম সন্তান এবং আদম মাটির তৈরি, (আহমদ, ২২৩৯১)। ঘ) আত্মশুদ্ধি ও আত্মরক্ষা: মানুষ মাত্রই ভুল করে। তার হূদয়ে অনেক খারাপ বিষয় স্থান করে নিতে পারে। মানুষের এই ভুল ও খারাপ প্রবণতা পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট করে। এ জন্যে রক্ত সম্পর্কীয় সব রকমের ভ্রাতৃত্ব বিনষ্ট হয়। ইসলামী উখওয়াত পারস্পারিক সম্পর্ক বিনষ্টকারী এসব ত্রুটি সংশোধনে ভূমিকা পালন করে। রাসূল (সা.) বলেন- নিশ্চয়ই তোমরা এক ভাই অন্য ভাইয়ের আয়না স্বরূপ। কাজেই কেউ যখন অপরের মধ্যে খারাপ কিছু দেখে তখন যেন সে তা দূর করে দেয়, (সুনানু তিরমিযি, ১৮৫২)। ঙ) নিরাপত্তা বিধান: একজন অপরজনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করলে বা জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের জন্য হুমকিতে পরিণত হলে সম্পর্ক বিনষ্ট হয়। ইসলামী ভ্রাতৃত্ব কারো নিরাপত্তা ব্যাহত করে না, বরং এ ভ্রাতৃত্ব মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। রাসূল (সা.) বলেন- একজন মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার ওপর যুলুম করবে না, তাকে শত্রুর হাতে সমর্পণও করবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে, আল্লাহ তাআলা তার প্রয়োজন পূরণ করবেন, (মুসলিম, ৪৬৭৭)। চ) সাহায্য-সহযোগীতা বৃদ্ধি: মানুষ একা স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বনির্ভর নয়। সহজ, সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য তাকে অপরের সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হয়। পারস্পারিক সাহায্য সহযোগিতার ফলে সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। রাসূল (সা.) তাই পারস্পারিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করে বলেছেন- যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে, আল্লাহ তার অভাব পূরণ করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের কষ্ট দূর করবে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহের কোন একটি বড় বিপদ দূর করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ ত্রুটি ঢেকে রাখবে, কিয়ামাতের দিন আল্লাহ তার দোষ ত্রুটি ঢেকে রাখবেন, (সহিহ বুখারী, ২২৬২)।
বস্তুত বিশ্বভ্রাতৃত্ব এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্ব প্রায় সমার্থক। বিশ্বভ্রাতৃত্ব যেমন দেশের সীমানা মানে না তেমনি ইসলামী ভ্রাতৃত্বেও দেশ, কাল, বর্ণ বা অঞ্চল কোন গুরুত্ব পায় না, বরং এর সাথে যুক্ত হয় দায়িত্ব্শীলতা। এভাবে বিশ্বভ্রাতত্বের চেয়েও ব্যাপক এবং দায়িত্বশীল ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব তার গুরুত্ব প্রমাণ করে।
লেখক : প্রভাষক (আরবী), চাটখিল কামিল মাদরাসা, নোয়াখালী।
ibrahim010187@gmail.com
আমারসংবাদ/জেআই