Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ১১ মে, ২০২৪,

খোঁজ নেই দণ্ডপ্রাপ্ত ৪৭ যুদ্ধাপরাধীর

মার্চ ২৪, ২০২১, ০৭:৫৫ পিএম


খোঁজ নেই দণ্ডপ্রাপ্ত ৪৭ যুদ্ধাপরাধীর
  • মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৩৫ ও আমৃত্যু ১১ জনই পলাতক
  • পলাতকদের গ্রেপ্তারে প্রশাসনের বড় অংশ আন্তরিক নয়- রানা দাসগুপ্ত, প্রসিকিউটর
  • ইন্টারপোলের মাধ্যমে বিদেশে পলাতকদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে -সানাউল হক, প্রধান তদন্ত সমন্বয়ক

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের এক যুগ পূর্তি হলো আজ। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারীদের বিচারে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের যাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘ ১২ বছরে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ১১১ যুদ্ধাপরাধীর সাজা হয়েছে। এদের মধ্যে কারো মৃত্যুদণ্ড, কারো আমৃত্যু আবার অনেককে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও রিভিউ পর্ব শেষে ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরও হয়েছে। তবে ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৭০ যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে ৩৫ জনই পলাতক রয়েছেন।

কবে পলাতকদের গ্রেপ্তার করা হবে এটা ভাবিয়ে তুলছে প্রসিকিউটরদের। খোঁজ মেলেনি আত্মগোপনে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের। কোথায় পালিয়ে আছেন সেই তথ্যও জানা সম্ভব হয়নি। শুধু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তই নয়, আমৃত্যু সাজা হওয়া ২৪ আসামির  মধ্যে ১১ আসামি এখনো পলাতক রয়েছেন। ১০ বছরেও তাদের হদিস মেলেনি। তবে পলাতকদের গ্রেপ্তারের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে এমনটিই দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে বিদেশে পালিয়ে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করছে বলে জানা গেছে। পলাতকদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড় অংশ আন্তরিক নয়— অভিযোগ করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রসিকিউটর দাবি করেছেন, দণ্ডপ্রাপ্তদের অনেকেই বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। কারণ, যে কজন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মারা গেছেন; পরে জানা গেছে তারা বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন।

তাহলে তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কিভাবে? এমন প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। এ পর্যন্ত রায় হওয়া ৪২টি মামলায় ১২৪ আসামির মধ্যে ১২ জন বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তবে বিচার চলাকালে অনেক আসামি পলাতক থাকায় মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলও দায়ের করা হয়নি। পরে পলাতক আসামিদের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপক্ষই তাদের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মধ্য দিয়েই বিচার নিষ্পত্তি  করেছে।

তবে ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত খালাস পেয়েছেন মাত্র একজন। তিনি গফরগাঁওয়ের মো. আব্দুল লতিফ। ৪২তম রায়ে ৯ আসামির মধ্যে তিনি খালাস পান। পলাতক আসামিদের বাইরে ট্রাইব্যুনালে গ্রেপ্তার ৪৭ আসামির দণ্ড হয়েছে। তাদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে ৩৩ আসামির। আর ১২ আসামির আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং একজনের ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড  হয়। এমন অবস্থায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা বলছেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যে ৩৫ আসামি এখনো পলাতক আছেন, তারা গ্রেপ্তার হওয়ার পরপরই তাদের দণ্ড কার্যকর করা সম্ভব। কারণ ট্রাইব্যুনালে এ আসামিদের বিরুদ্ধে যে রায় এসেছে, তার বিরুদ্ধে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উচ্চ আদালতে আপিল করা হয়নি। যে কারণে ট্রাইব্যুনালের রায়ই চূড়ান্ত। তাই তাদের খুঁজে বের করে ফাঁসি কার্যকরের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত আমার সংবাদকে বলেন, ‘যারা পলাতক রয়েছেন, আমার ধারণা তাদের অনেকেই দেশেই অবস্থান করছেন। যে কজন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মারা গেছেন পরে জানা গেছে, তারা নিজ বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। তাদেরকে জীবদ্দশায় গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড় অংশ আন্তরিক ছিলো না। এই দায়িত্ব পালনে আইন, বিচার ও প্রশাসনের মধ্যে যাদের সোচ্চার হওয়ার কথা ছিলো তারা তা করছেন না। যেমন— যারা রাজাকারের তালিকা তৈরি করতে গিয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটরকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন সেই দায়ীদের বিরুদ্ধে তো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হলো না। বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি হলে ট্রাইব্যুনালের আর কোনো দায়িত্ব থাকে না। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর দণ্ড কার্যকরের দায়িত্ব এসে পড়ে।’

সাবেক আইজিপি ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক এম সানাউল হক মিয়া বলেন, ‘বিশ্বের ইতিহাসে এত দীর্ঘ সময় পর তদন্ত করে অপরাধের বিচার করার ঘটনা বিরল। একদল নিবেদিতপ্রাণ তদন্ত কর্মকর্তা ও দেশের সর্বস্তরের মানুষের আন্তরিক সহযোগিতায় সফলভাবে বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘সময় ও জনবলের সীমাবদ্ধতায় হয়তো সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। তবুও শীর্ষ ও কুখ্যাতদের বিচার সম্পন্ন করে জাতি আজ বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির দায় থেকে অনেকটাই মুক্ত। তদন্ত সংস্থা জাতির এই মহান কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার গৌরবে গৌরবান্বিত। স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী ও জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে তদন্ত সংস্থার সব প্রচেষ্টা এই উদযাপনে উৎসর্গ করেছে। আর ইন্টারপোলের মাধ্যমে বিদেশে পলাতকদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক যুদ্ধাপরাধী ৩৬ জন : ফরিদপুরের বোয়ালমারির আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু, ফেনীর দাগনভূঁইয়ার আশরাফুজ্জামান খান ওরফে নায়েব আলী, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের চৌধুরী মঈনউদ্দিন, ফরিদপুরের নগরকান্দার এম ডি জাহিদ হোসেন খোকন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের সৈয়দ হাসান আলী, কিশোরগঞ্জের কমিরগঞ্জের রাজাকার কমান্ডার গাজী আব্দুল মান্নান, নাছির উদ্দিন আহম্মেদ ওরফে ক্যাপ্টেম এ টি এম নাছির এবং মো. হাফিজ উদ্দিন, জামালপুরের আব্দুল মান্নান, আশরাফ হোসেন ও আব্দুল বারী, শরীয়তপুরের পালংয়ের মো. ইদ্রিস আলী সরকার, কিশোরগঞ্জের নিকলির সৈয়দ মোহাম্মদ হুসাইন ওরফে হোসেন, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের আবু সালেহ মুহাম্মদ আব্দুল আজিজ ওরফে ঘোড়ামারা আজিজ, রুহুল আমিন, আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলী, নাজমুল হুদা ও আব্দুর রহিম মিয়া, মৌলভীবাজারের রাজনগরের নেছার আলী ও মোবারক মিয়া, নোয়াখালীর সুধারাম উপজেলার আবুল কালাম ওরফে এ কে এম মনসুর, মৌলভীবাজারের আব্দুন নূর তালুকদার ও আব্দুল মোছাব্বির মিয়া, মো. আনিস মিয়া, হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার রাজাকার লিয়াকত আলী, কিশোরগঞ্জের রাজাকার আমিনুল ইসলাম, আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীন, নেত্রকোনার পূর্বধলার শেখ আব্দুল মজিদ ওরফে মজিদ মাওলানা, আব্দুল খালেক তালুকদার, কবির খান, আব্দুল সালাম বেগ এবং নুর উদ্দিন ওরফে রাদ্দিন, নেত্রকোনার আটপাড়ার হেদায়েত উল্লাহ আনজু, গাইবান্ধার সদর উপজেলার আব্দুল জব্বার মণ্ডল, জাছিচার রহমান ওরফে খোকা, আব্দুল ওয়াহেদ মণ্ডল ও মনতাজ আলী বেপারী ওরফে মমতাজ।

আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ১১ জন পলাতক : মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কারাগারে থাকতে হবে এমন ১২ আসামিকে ট্রাইব্যুনাল বিচার শেষ করে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে। তাদের মধ্যে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার মো. আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ার রয়েছেন। তিনি গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক অবস্থায় মারা যান বলে গণমাধ্যমে খবর আসে। এছাড়া আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ১১ জনের মধ্যে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের মো. আজহারুল ইসলাম, জামালপুরের আবুল হাশেম, অধ্যাপক শরীফ ও মো. হারুন, যশোরের কেশবপুরের কাজী ওহিদুর ইসলাম ওরফে কাজী ওয়াহিদুস সালাম, আব্দুল আজিজ সরদার, আব্দুল খালেক মোড়ল, শেখ মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান ওরফে মুজিবর রহমান।

আমারসংবাদ/জেআই