Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

বিরোধী রাজনীতিতে হেফাজতের দৃষ্টি!

আবদুর রহিম ও রফিকুল ইসলাম

এপ্রিল ২, ২০২১, ০৮:০৫ পিএম


বিরোধী রাজনীতিতে হেফাজতের দৃষ্টি!
  • হেফাজতের চলমান সবগুলো কাণ্ডই রাজনৈতিক বিরোধিতা 
  • পেছন থেকে জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলোও সাহস যোগাচ্ছে
  • একাত্তরের কাদা নেই হেফাজতের গায়ে, তাই এগিয়ে থাকার প্রত্যাশা তাদের
  • মানুষের চাহিদা ও ধর্মীয় ইস্যুকে গুরুত্ব দিয়ে মাঠে থাকবে হেফাজত
  • যারাই সরকারের বিরোধিতা করবে তারাই এখন সাপোর্ট পাবে এটিই স্বাভাবিক, বাংলাদেশের রাজনীতির ধরনটাই এমন— দাবি বিশ্লেষকদের

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক একটি সংগঠন। ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির বিরোধিতার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে সংগঠনটি। হাটহাজারী মাদ্রাসার সাবেক মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফী ছিলেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংগঠনটি বাংলাদেশে ইসলামি শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন করে আসছে।

২০১৩ সালে তারা ইসলাম ও রাসূল সা.কে কটূক্তিকারী নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসি দাবি করে ব্যাপক আন্দোলন ও সমাবেশ শুরু করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে দাবি উত্থাপন করা হয় ১৩ দফা। বাংলাদেশের বড় একটি অংশ তখন হেফাজতের দাবিকে গ্রহণ করেনি। এরপর ৫ মে, ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলাম সারা দেশ থেকে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করে এবং ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিল শাপলা চত্বরে প্রথম সমাবেশ করে। তখনই ৫ ও ৬ মে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে এই সংগঠনের কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষে হেফাজতে ইসলামের কর্মী, পুলিশ, বিজিবি সদস্যসহ মোট ৪৭ জন নিহত হয় এবং সাংবাদিকসহ আরও অনেকে আহত হন। এভাবেই ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করে সংগঠনটি।

সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও। বৈঠকে সংগঠনটির আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তখন সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্য সরানো হয়, পাঠ্যপুস্তকে কয়েকটি পরিবর্তন আনা হয়, কওমির দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেয়ার ঘোষণাও আসে। এরপর থেকেই সংগঠনটি কখনো সরকারপন্থি হিসেবে কিছুটা পরিচিতি পায়। তবে এখন সংগঠনটি বিরোধী রাজনীতির আসনের দিকে দৃষ্টি  দিয়েছে। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ বাংলাদেশে সরকারবিরোধী ভূমিকায় কোনো দলের ভূমিকা নেই। একসময়কার দেশের নেতৃত্ব দেয়া খালেদা জিয়া আটক হওয়ার পর লন্ডন থেকে দল পরিচালনা করায় বিএনপিও অনেক দূরে চলে যায় জনগণ থেকে। বামপন্থি দলগুলোও আগের অবস্থানে নেই। এখন ইস্যুভিত্তিক ভূমিকায়ও তাদের কম দেখা যায়। জামায়াতে ইসলামী কিছুটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠার সময় একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে এখন অন্তরালে চলে গেছে। নানান পর্যবেক্ষণ থেকে হেফাজতে ইসলামও এখন রাজনীতিমুখী হয়ে ভূমিকা পালন করছে। সরকারের নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, হেফাজতকে বিরোধী রাজনীতিতে দাঁড় করানোর জন্য দেশের বড় একটি অংশ জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে চাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী, প্রকাশ্যে সাথে রয়েছেন ভিপি নূর এবং দেশের ইসলামিক দলগুলোও।

হেফাজতে ইসলামির একাধিক নেতার সঙ্গেও কথা বলে জানা গেছে, তারাও এখন রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে চাচ্ছেন। মানুষের জন্য কাজ করতে চাচ্ছেন। মানুষের চাহিদাকে গুরুত্ব দিতে চাচ্ছেন। তাদের দাবি, এ দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। তারা যদি দেশের মানুষের চাহিদার খোরাককে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে পারেন তাহলে তারা শীঘ্রই মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারবেন। তারা এখন দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন— এক. দেশের মানুষের চাহিদা ও দুই. ধর্মকে। ঢাকা মহানগরীর হেফাজতের এক নেতা আমার সংবাদকে বলেন, ‘এ দেশে অনেক ইসলামি দলই একাত্তরের কাদা গায়ে লাগানোর কারণে দাঁড়াতে পারেনি। আমাদের সংগঠনের জন্ম এক দশক আগে। একাত্তরের চার যুগেরও পর আমাদের অবস্থান। কেউ ইচ্ছে করলেও আমাদের গায়ে কাদা লাগাতে পারবে না। আমরা মানুষের অধিকার ও ধর্মীয় অধিকার নিয়ে কথা বলে যাবো।’

সমপ্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলাম আবারো সামনে আসে। পালন করে হরতাল। দেশব্যাপী সংঘর্ষ হয়। সংগঠনটির ১৭ নেতাকর্মী মারা যান বলেও দাবি করা হয়। বিশেষ করে হেফাজতের ডাকা তিনদিনের কর্মসূচিকে ঘিরে এক ভয়াবহ অরাজকতা সৃষ্টি হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর, সরকারি বাসভবন, পুলিশ ফাঁড়ি, ক্যাম্পে হামলা, জলকামানসহ সরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও তাণ্ডবে চালানো হয় বহু স্থানে। আত্মরক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি, টিয়ারগ্যাস ও লাঠিচার্জ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মাতুয়াইলের সাইনবোর্ড এলাকায় বিজিবি ও পুলিশের সঙ্গে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। নিরাপত্তার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট, নোয়াখালীর পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। হেফাজতের নেতাদের হাতে দা-লাঠি, বল্লমসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র দেখা যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন, জেলা পরিষদ, পুলিশ সুপার কম্পাউন্ড, পৌরসভা, পৌর মিলনায়তন, আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন, শিল্পকলা, শহর সমাজসেবা প্রকল্প কার্যালয়, সদর উপজেলা ভূমি অফিস, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের অফিস, বাসভবন ও তার শ্বশুরবাড়ি, ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বাসভবন, জেলা ক্রীড়া সংস্থা, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডের সদর দপ্তরের গাড়ির গ্যারেজ, হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি, আশুগঞ্জ টোল প্লাজার পুলিশ ক্যাম্প পুড়িয়ে দেয়া হয়।

এখনো চলছে হেফাজতের আন্দোলন। গতকাল শুক্রবার করোনার কঠিন পরিস্থিতিতে শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত না করে সারা দেশে কর্মীদের ওপর নির্যাতন ও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে বিক্ষোভ সমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম। সমাবেশে সংগঠনটির নেতা মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘দেশব্যাপী হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। কেউ যদি চিন্তা করেন, বন্দুকের নল দিয়ে হেফাজতে ইসলামকে শান্ত করে ফেলবেন; তাদের বলবো, আপনারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।’ এদিকে গতকালও গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তায় পুলিশের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, টিয়ারশেল ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন আমার সংবাদকে  বলেন, ‘ইসলামিক দলগুলো রাজনৈতিক দল নয়, এরা হচ্ছে এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী। তারা ধর্মের অপব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। তারা রাজনীতির নামে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে চায়। দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে এদের ভালো কোনো প্রোগ্রাম নেই। এই সকল ধর্মব্যবসায়ীদের ওপর দেশের জনগণের কোনো আস্থা নেই।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান মিয়াজী আমার সংবাদকে বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনৈতিক দল নয়। তাদের কোনো নিবন্ধনও নেই। এরা ইসলামের নামে একটি দল করেছে। ইসলামিক অন্য দলগুলোর সাথে তাদের সু-সম্পর্ক আছে কি-না, তাও প্রশ্নবিদ্ধ।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলের যে ভূমিকা থাকে তা বহু বছর ধরেই দেখতে পাচ্ছি না। তারপরও হেফাজতের সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই।’

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইশফাক ইলাহী চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, ‘হেফাজতের এমন ভূমিকা বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক ও দুঃখজনক। তারা বাংলাদেশের আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদের ইন্ধন যোগাচ্ছে। এ জন্য সরকার দায়ী, বিরোধী দলগুলো দায়ী, আমার সকলেই দায়ী। আমরা নিজেদের স্বার্থে এদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছি। যার ফলে এমন সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বের কোথাও এমন নেই, যেখানে একটি জাতীয় মসজিদ দখল হয়ে যায় এবং সেখানে রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া হয়। এ ধরনের কার্যকলাপ আধুনিক ও অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার বিপরীত অবস্থান।’ তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান বিরোধী দলগুলোর কার্যকর কোনো ভূমিকা নেই। তাই যারাই সরকারের বিরোধিতা করবে, তাদেরই বিরোধী দলগুলো সহযোগিতা দেবে, এটিই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের রাজনীতির ধরনটাই এমন।’

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস আমার সংবাদকে বলেন, ‘দেশের অভ্যন্তরে কোনো রাজনৈতিক দল সহিংসতা সৃষ্টি করুক, এটি আমরা কেউ চাই না। কিন্তু হেফাজতে ইসলাম আন্দোলনের নামে সহিংসতা করছে, এটি খুবই দুঃখজনক।’ তিনি আরও বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম আন্দোলনের নামে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙলো এটি কি রাজনৈতিক বিরোধিতা নয়, মানুষের বাড়িঘর ভাঙচুর করলো এটি কি রাজনৈতিক বিরোধিতা নয়। হেফাজতে ইসলাম রাজনৈতিক দল নয়, কিন্তু তারা যে তাণ্ডব চালিয়েছে, সবগুলোই রাজনৈতিক বিরোধিতা।’

প্রবীণ ইসলামি রাজনীতিবিদ মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফ আমার সংবাদকে বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদি ইস্যুতে হেফাজতে ইসলাম যতগুলো আন্দোলন সংগ্রাম করেছে, একটিতেও সহিংসতা হয়নি। সহিংসতা হেফাজত করে না, সহিংসতা করে হেলমেট বাহিনী। মসজিদের মধ্যে গিয়ে হেফাজতের লোকেরা সহিংসতা করেনি। বরং এটা বলার মাধ্যমে কেউ কেউ হেফাজতকে ইঙ্গিত করার অপচেষ্টা করছে এবং নিজেরা উস্কানি দিচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনৈতিক দল নয়, রাজনৈতিক ভূমিকাও নেয় না। হেফাজতে ইসলাম শুধু ধর্মীয় ইস্যুতেই কথা বলছে, আন্দোলন সংগ্রাম করছে। হেফাজত কখনো রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে কথা বলে না।’

আমারসংবাদ/জেআই