Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

৩ বছরেও বাস্তবায়ন নেই!

এপ্রিল ৬, ২০২১, ০৮:০৫ পিএম


৩ বছরেও বাস্তবায়ন নেই!
  • নির্দিষ্ট আইন ও শাস্তির বিধান থাকলেও প্রয়োগ নেই
  • পরিবেশ আইন অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ দূষণ প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছে -মনজিল মোরসেদ, আইনজীবী
  • আদেশ না মানা আদালত অবমাননার শামিল -মত বিশেষজ্ঞদের

দূষণে নাকাল নগরবাসী। ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোও পিছিয়ে নেই। প্রতিনিয়তই বাড়ছে বায়ুদূষণ। ফুসফুসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। বায়ুদূষণ রোধে আইন ও দূষণকারীর বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান থাকলেও কার্যকর প্রয়োগ নেই। ফলে বেপরোয়া দূষণকারীরা। দূষণের কবল থেকে মুক্তি মিলছে না ঢাকাবাসীর। দিন দিন বিষে ভরে উঠছে রাজধানীর বাতাস। দূষণ রোধে উচ্চ আদালত একাধিকবার বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে বাস্তবায়ন হয়নি তার অধিকাংশই। নানা সময় আদেশ কার্যকর করতে তদারকিমূলক বিভিন্ন নির্দেশনা দিলেও তাতেও কাজের কাজ হচ্ছে না। ফলে উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাগুলো।

২০১৯ সালের শুরুতে উচ্চ আদালত বায়ুদূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সপ্তাহে দুবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে ঢাকার যেসব এলাকায় উন্নয়ন ও সংস্কারকাজ চলছে সেসব এলাকা (কাজের স্থান) ঘেরাও করে কাজ করতে বলা হয়। পাশাপাশি উন্নয়ন ও সংস্কারকাজের কারণে ধুলাবালিপ্রবণ এলাকায় দিনে দুবার পানি ছিটাতে সংশ্লিষ্টদের আদেশ দেন। আদেশের পরও দীর্ঘ তিন বছর পেরিয়ে গেলেও বাস্তবায়নে অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্টদের তৎপরতা চোখে পড়েনি।

শুধু ঢাকাই নয়, পরিবেশের বিপর্যয় রক্ষায় গেল বছর ঢাকার আশপাশের পাঁচ জেলার অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করা, মাত্রার চেয়ে বেশি কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে চলা যান জব্দ ও ধুলাপ্রবণ এলাকায় দুই সিটি কর্পোরেশনের নিয়মিত পানি ছিটানোসহ বায়ুদূষণ রোধে ৯ দফা  নির্দেশনা দিয়েছিল। তবে এর কার্যকর বাস্তবায়ন লক্ষ্য করা যায়নি। পরিবেশ রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে উচ্চ আদালত নির্দেশ দিলেও তা মানা হচ্ছে না। সরেজমিন রাজধানী ও ঢাকার  আশপাশের এলাকা ঘুরে এসব নির্দেশনাগুলোর অধিকাংশেরই বাস্তবায়ন চোখে পড়েনি। দেখা গেছে প্রতিটা নির্মাণাধীন সড়ক ও মেগা প্রজেক্ট এলাকা ধুলায় ঢেকে আছে। দেদার চলছে ইটভাটা। বন্ধেও নেই কোনো পদক্ষেপ।

নিয়মানুযায়ী ছিটানো হচ্ছে না পর্যাপ্ত পানি। এসব এলাকা দিয়ে একটি যানবাহন গেলেই পিছনের পুরো এলাকা ধুলায় সাদা হয়ে যাচ্ছে। না ঢেকেই নির্মাণসামগ্রী নিয়ে চলাচল করছে ট্রাক। রাস্তায় ১০ মিনিট দাঁড়ালেই মিলছে কালো ধোঁয়া নিঃসরণকারী যানবাহন। এদিকে ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে দেদার চলছে ইটভাটা। ইটভাটার নির্গত কালো ধোঁয়ায় পরিবেশও দূষিত হচ্ছে নিয়মিত।

হাইকোর্টের আদেশের বিষয়ে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ আদালত যে নির্দেশনা দেন সেটা একপ্রকার আইনে পরিণত হয়। সুতরাং আদালতের নির্দেশনা না মানা আইন ভঙ্গের সামিল। উচ্চ আদালত নির্দেশনা দেবে কিন্তু সেটা পালন বা কার্যকর করার দায়িত্ব প্রশাসন ও পরিবেশ সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু অনেকসময় দেখা যায় সংশ্লিষ্টদের গাফলতিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয় না।  উচ্চ আদালতের নির্দেশনা না মানা আদালত অবমাননার শামিল। যাদের বিষয়ে উচ্চ আদালত নির্দেশনা পালনের আদেশ দিয়েছেন তারা যদি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উদ্যোগ বা সমস্যা প্রশমনে ব্যবস্থা না নেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা যাবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবেশ দূষণ রোধে মূল দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। এ ছাড়া বিআরটিএ, নগর কর্তৃপক্ষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্ব আছে। যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। কিন্তু যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ার দূষণের মাত্রা পরিমাপ করার যন্ত্র প্রতিষ্ঠানটির কাছে নেই। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাছেও নেই কালো ধোঁয়ার দূষণ পরিমাপের যন্ত্র। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের পরিবেশ সার্কেল থাকলেও কালো ধোঁয়া বন্ধে তাদের উদ্যোগ নেই।

দূষণরোধে হাইকোর্টের যত নির্দেশনা

চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ রোধে তিন দফা নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। এগুলো হলো— ঢাকা শহরের প্রবেশমুখ গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, পূর্বাচল, কেরানীগঞ্জ, টঙ্গীসহ বিভিন্ন পয়েন্টে পানি ছিটানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও ঢাকা শহরের সড়কে পানি ছিটানো। সেইসাথে সড়কের পাশের গাছে জমে থাকা ধুলা-ময়লা পরিষ্কারে পানি ছিটানোর নির্দেশনা দেয়াও হলেও কার্যত পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।  ২০১৯ সালের ১৮ জানুয়ারি দেয়া এক নির্দেশে ঢাকা শহরে যারা বায়ুদূষণের কারণ সৃষ্টি করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সপ্তাহে দুবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। জনস্বার্থে করা এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে এদিন বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান এবং বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদেশে আদালত বলেছিলেন, রাজধানীর যেসব জায়গায় উন্নয়ন ও সংস্কারকাজ চলছে, সেসব জায়গা ১৫ দিনের মধ্যে এমনভাবে ঘিরে ফেলতে হবে, যাতে ধুলা ছড়িয়ে বায়ু দূষণ বাড়াতে না পারে। পাশাপাশি ‘ধুলোবালিপ্রবণ’ এলাকাগুলোতে দিনে দুবার পানি ছিটাতে হবে। ঘেরাওয়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নের বিষয়ে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের দুই মেয়র ও নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন হাইকোর্ট। একই বছরের ২৬ নভেম্বর বায়ুদূষণ কমাতে ঢাকাসহ আশপাশের পাঁচ জেলার সকল অবৈধ ইটভাটা ১৫ দিনের মধ্যে বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। চার জেলার মধ্যে রয়েছে- নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জ। এসব এলাকায় অবৈধ ইটভাটা বন্ধে প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে বলা হয়েছে। এছাড়াও ঢাকার বায়ুদূষণ কমাতে নীতিমালা প্রণয়নে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন সচিবের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ কমিটিকে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এদিকে মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া নির্গত হলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছাড়া ক্ষতিকর ধোঁয়া নিঃসরণকারী যানবাহন চালুই করা যাবে না। অথচ, রাজধানী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কালো ধোঁয়া ছড়ানো যানবাহন। ফিটনেসবিহীন বাস, মিনিবাস, ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়াও ঢাকায় নিবন্ধিত ৭৪ হাজার ৩৩০টি ট্রাকের বড় একটি অংশই কালো ধোঁয়া ছাড়ছে। এছাড়া পুরান ঢাকায় সন্ধ্যার পর বিভিন্ন কারখানায় পোড়ানো হচ্ছে টায়ার ও প্লাস্টিক। এতে ভয়াবহ দূষণ সৃষ্টি হচ্ছে।

সর্বশেষ উপেক্ষিত ৯ দফা নির্দেশনা : রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৩ জানুয়ারি নয় দফা নির্দেশনা দেয় উচ্চ আদালত।  হাইকোর্ট গত ১৩ জানুয়ারি রাজধানী ও আশপাশের বায়ুদূষণ রোধে ৯ দফা নির্দেশনা দেন। নির্দেশনাগুলো হলো- ১. ঢাকা শহরে মাটি, বালি, বর্জ্য পরিবহনকৃত ট্রাক ও অন্যান্য গাড়িতে মালামাল ঢেকে রাখা। ২. নির্মাণাধীন এলাকায় মাটি, বালি, সিমেন্ট, পাথর, নির্মাণাসামগ্রী ঢেকে রাখা। ৩. সিটি কর্পোরেশন রাস্তায় পানি ছিটাবে। ৪. রাস্তা, কালভার্ট, কার্পেটিং, খোঁড়াখুঁড়ি কাজে টেন্ডারের শর্ত পালন নিশ্চিত করা। ৫. কালো ধোঁয়া নিসরণকৃত গাড়ি জব্দ করা। ৬. সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে গাড়ির চলাচল সময়সীমা নির্ধারণ ও উত্তীর্ণ হওয়া সময়সীমার পরে গাড়ি চলাচল বন্ধ করা। ৭. অবৈধ ইটভাটাগুলো বন্ধ করা। ৮ পরিবেশ লাইসেন্স ব্যতীত চলমান সকল টায়ার ফ্যাক্টরি বন্ধ করা।  ৯. মার্কেট, দোকানে প্রতিদিনের বর্জ্য ব্যাগে ভরে রাখা এবং অপসারণ নিশ্চিত করা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক মিহির বিশ্বাস বলেন, রাজধানীতে বায়ুদূষণ উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বায়ুদূষণের কারণে মানুষের শরীরে নানা রোগবালাই যেমন বাসা বাঁধছে, তেমনি মনের মধ্যেও রোগশোকের জন্ম দিচ্ছে। দূষণ রোধে ইতোপূর্বে বিভিন্ন প্রকল্প নেয়া হলেও তার সুফল পাওয়া যায়নি। প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও সেটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামীতে প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তবে আপাতত উচ্চ আদালত যে নির্দেশনাগুলো দিয়েছে সেটা বাস্তবায়ন করা জরুরি।

বায়ূ দূষণ নিয়ে উচ্চ আদালতে রিটকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদ, পরিশে আইন ১৯৯৫ এবং পরিবেশ বিধিমালা ১৯৯৭-এ বায়ুদূষণ রোধসংক্রান্ত পদক্ষেপের নির্দেশনা দেয়া থাকলেও কর্তৃপক্ষ ঢাকা শহরের বায়ূ দূষণ প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বিশ্বের সর্বোচ্চ ১০টি বায়ূদূষণকারী শহরের মধ্যে ঢাকা তৃতীয় হয়েছে। বর্তমানে যেভাবে বায়ু দূষিত হচ্ছে তাতে আমাদের সবারই বেঁচে থাকার অধিকার লঙ্ঘিত হবে। আইনজীবী মনজিল বলেন, ৯ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা নানা সীমাবদ্ধতার কথা বলছে  সিটি কর্পোরেশন বলেছে পানি ছিটানোর গাড়ির সংখ্যা কম থাকায় ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে পানি ছিটানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমার মনে হয় এটা নেহাতই একটা অজুহাত ছাড়া কিছু নয়।

আমারসংবাদ/জেআই