Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

ঝুঁকি এখন ঘরে ঘরে

এপ্রিল ১৩, ২০২১, ০৯:২০ পিএম


ঝুঁকি এখন ঘরে ঘরে
  • শেষ সময়ে মানুষের স্রোত ঠেকানো যায়নি
  • মার্কেটে আখেরি কেনাকাটা
  • কাঁচাবাজারগুলোতে মানুষের ঠাসাঠাসি 
  • গাদাগাদি করে ঝুঁকি নিয়ে ফেরিতে নদী পার
  • নিষেধাজ্ঞার দিনেও রাজধানীতে তীব্র যানজট

শেষ সময়ে মানুষের স্রোত ঠেকানো যায়নি। মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজনে সব নিয়ম ভেঙে গেছে। রাজধানীর মার্কেটগুলোতে ছিলো আখেরি কেনাকাটার ধুম। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোতে ছিলো ভিড়। রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে টাকা তুলেছে মানুষ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রাক, পিকআপ, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেলসহ ব্যক্তিগত যানবাহনে করে গ্রামের বাড়ির দিকে ছুটছে মানুষ। যে যেভাবে পারছে ঝুঁকি নিয়ে সে-ই গ্রামের বাড়ি যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নামেন। লকডাউন সময়ের নিষেধাজ্ঞা কেউ মানেননি।

১৪ থেকে ২১ এপ্রিল কঠোর লকডাউনের পূর্বে গতকাল রাজধানীর নিউমার্কেট, গাউছিয়া, চাদনী চক, নূরজাহান মার্কেটসহ সবগুলো মার্কেটেই দেখা গেছে জনস্রোত। বিশেষ করে নিউমার্কেট এলাকায় ছিলো না তিল ধারণের ঠাঁই। ঈদ সময়ের আখেরি কেনাকাটার দৃশ্য ছিলো। যদিও দেশে করোনায় মৃত্যু প্রায় প্রতিদিন শতের ঘরের কাছাকাছি। আক্রান্ত সাত হাজার প্রতিদিন ছাড়িয়ে যাচ্ছে, এটি যেনো কেউ গুরুত্বই দিচ্ছে না। সাধারণ মানুষের মাঝে ভয়, আতঙ্ক কিংবা কোনো সচেতনতা দেখা যাচ্ছে না। পরিবার-পরিজন নিয়েই মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। এছাড়া বন্ধ রয়েছে দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল। কিন্তু ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাতায়াত করছেন মানুষ। ভ্যান রিকশায়ও ভেঙে ভেঙে যাতায়াত করা হচ্ছে। গতকাল বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এমন খবর পাওয়া গেছে। এ নিয়ে দেশের সচেতন মহল, সুশীল ও রাজনীতিতে প্রশ্ন উঠেছে সাতদিন পর কী হবে?

শারীরিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঢাকাসহ সিটি কর্পোরেশনগুলোতে গাড়ি চলাচলের অনুমতি থাকায় মানুষ প্রয়োজনে রাস্তায় নেমে আসে। ঢাকাসহ ভিবিন্ন অঞ্চলে শহরজুড়েই সৃষ্টি হয় যানজটের। আজ থেকে এক সপ্তাহের পূর্ণ লকডাউন ঘোষণার পর রাজধানীর বাজারগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে মানুষের ভিড় দেখা যায়। কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়ায় কাঁচাবাজারগুলোতে মানুষের ঠাসাঠাসির চিত্র ছিলো চোখে পড়ার মতো। সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েই গাদাগাদি করে ট্রলারের দিকে ছুটছে মানুষ। অনেকের মুখে ছিলো না মাস্ক। নদীঘাটগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ফেরিতে গাদাগাদি করে নদী পার হয় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ।

ঘরে ঘরে করোনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা : গতকাল স্রোতের মতো রাজধানী ছেড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে এভাবে গাদাগাদি করে বাড়ি ফেরায় দেশব্যাপী করোনা সংক্রমণ আরও ভয়ঙ্করভাবে বেড়েছে। ছড়িয়ে যেতে পারে ঘরে ঘরে। ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও মোটরসাইকেলে করেও যাত্রা করতে দেখা গেছে অনেককে। এতে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে পাঁচ শতাধিক যানবাহন। খালি ট্রাক ও পিকআপ দেখলেই দৌড়ে সেখানে চড়ে বসছেন। কোথাও মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। যাত্রীরা জানান, কঠোর লকডাউনে সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর রোজাও শুরু হচ্ছে। তাই কষ্ট হলেও বাড়ি ফিরছেন তারা। তবে বাড়িতে যেতে তাদের গুনতে হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া। তারপরও যেতে পারলে খুশি তারা।

ঢাকা ছাড়ছে মানুষ মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট : লকডাউনের খবরে ঘরমুখো মানুষের চাপের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়েছে। গতকাল ভোর থেকে গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে শহীদনগর পর্যন্ত তিন কিলোমিটার যানজট তৈরি হয়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। জানা গেছে, করোনার দ্রুত সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকাতে সরকারের কঠোর বিধিনিষেধের কারণে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। আজ থেকে সারা দেশে সর্বাত্মক লকডাউন দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে সরকারের তরফে। ফলে অনেকে ঝামেলা এড়াতে আগেভাগেই বাড়ি ফিরছেন ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা ট্রাক, পিকআপে করে। এসব ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ থাকায় এই যানজট সৃষ্টি হয়েছে। মনোহরগঞ্জ উপজেলার কচুয়া গ্রামের বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. আলম জানান, সকাল ৬টায় যাত্রাবাড়ী থেকে রওনা হন তিনি। সকাল সাড়ে ৯টায় তিনি দাউদকান্দির গৌরীপুরে পৌঁছেছেন। ৫০ কিলোমিটার পথ যেখানে এক ঘণ্টায় পাড়ি দেয়া যায়, সেখানে আজ সাড়ে তিন ঘণ্টা লেগেছে।

রাজধানীর নিউমার্কেটে যেনো ঈদের কেনাকাটা : রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় গতকাল ঈদের মার্কেটের চিত্র দেখা গেছে। সেখানে ছিলো না তিল ধারণের ঠাঁই। দেশে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় গত ৫ এপ্রিল থেকে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। এর মধ্যেও প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। এ পরিস্থিতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার শুরুর দিন থেকে বিপণি বিতানগুলোতে স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই লক্ষ্য করা যায়নি। রাজধানীর নিউমার্কেট, গাউছিয়া, চাদনী চক, নূরজাহান মার্কেটসহ বেশির ভাগ মার্কেটগুলোতেই ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। আগের মতোই গাদাগাদি করে কিনতে হচ্ছে প্রয়োজনীয় পণ্য। এদের দেখে বোঝার উপায় নেই যে, গোটাদেশই এখন মহামারির হুমকিতে রয়েছে। দেখা গেছে, সময় যত গড়িয়েছে ক্রেতার চাপে ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্যবিধি। মার্কেটের প্রবেশপথে জীবাণুনাশক টানেল থাকলেও তা ব্যবহারে চরম অনীহা দেখা যায় ক্রেতা-দর্শনার্থীদের। আবার বিপণিবিতানের ভেতরে মাস্ক ছাড়া দেখা যায় বিক্রয় কর্মীদেরও। ক্রেতাদের অনেকেরই দাবি, অনেকটা বাধ্য হয়ে এসেছেন কেনাকাটা করতে।

নিষেধাজ্ঞার দিনেও রাজধানীতে ছিলো তীব্র যানজট : করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের দিনেও  রাজধানীতে যানজট দেখা গেছে। রাজধানীতে যানবাহন চলাচল দেখে মনে হয়নি দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে কোনো বিধিনিষেধ চলছে। গণপরিবহনে প্রতি দুই সিটে একজন করে যাত্রী বহনের নির্দেশনা দিয়ে শতকরা ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী গণপরিবহনগুলো অর্ধেক যাত্রী বহনের নির্দেশনা উপেক্ষা করে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে ২ থেকে ৪ গুণ পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায় করছে। যাত্রীদের অভিযোগ— ভাড়া বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে গণপরিবহনগুলোতে ভাড়া আদায়ের নামে ডাকাতির মহোৎসব চলছে। যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, শাহবাগ, গুলিস্তান, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় তীব্র যানজট দেখা গেছে। ট্রাফিক সিগন্যালে কোথাও কোথাও দীর্ঘক্ষণ যানজট লেগে থাকার দৃশ্যও দেখা গেছে। কেউবা কাজের উদ্দেশ্যে ছুটছেন কর্মস্থলে, কেউবা কারণ ছাড়াই রাস্তায় বেরিয়েছেন। কিন্তু বাসগুলোতে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ইচ্ছামাফিক। মানুষের চলাচলেও দেখা গেছে, সবার মধ্যে গা ছাড়া ভাব, যেনো দেশে করোনা বলতে কিছু নেই। সামাজিক দূরত্বের বালাই দেখা যায়নি বেশির ভাগ জায়গায়। বাসের ড্রাইভার-কন্ডাক্টর-হেলপার অধিকাংশের মুখেই মাস্ক নেই। যাত্রীদের অনেকের মাস্ক ছিলো থুতনির নিচে। কাজের উদ্দেশে বা কর্মস্থলে যাওয়া ছাড়াও অকারণে গল্প-গুজবে লিপ্ত থাকতে দেখা গেছে অনেককে।

গাদাগাদি করে জীবনের ঝুঁকি ফেরিতে নদী পারাপার : শিমুলিয়া ঘাটে ঘরমুখী মানুষের চাপ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। আজ থেকে সর্বাত্মক কঠোর লকডাউনের ঘোষণায় দেশের দক্ষিণবঙ্গের অনেকে রাজধানী ছাড়ছেন। শিমুলিয়া ঘাটে এখন পারাপারের অপেক্ষায় সহস্রাধিক যান। আর বাংলাবাজার ঘাটে অপেক্ষমাণ সাত শতাধিক যান। এসব তথ্য দিয়ে শিমুলিয়া ঘাটের বিআইডব্লিউটিসির ম্যানেজার সাফায়েত আহম্মেদ জানান, শিমুলিয়া-বাংলাবাজারের ফেরি বহরের ১৬ ফেরির মধ্য চলমান ১৪টি ফেরি পার করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। নৌরুটটিতে লকডাউনের শুরু থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। সাড়ে ৪০০ স্পিডবোট ও কয়েকশ ট্রলারে হাজার হাজার যাত্রী পারাপার হচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। ফেরিযোগেও সমানে যাত্রী দাঁড়িয়ে পার হচ্ছেন। দুই পাড়ে পণ্যবাহী ট্রাকসহ বিপুল যানবাহন আটকা পড়ায় হাজার হাজার মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সরকারের কোনো সমন্বয়, পরিকল্পনা, রোডম্যাপ নেই। এই যে সাতদিনের লকডাউন দিয়েছে, তারপর কী হবে?’ মির্জা ফখরুল বলেন, ‘হাউ ডু দে প্ল্যান টু ফিট দ্যাট কমন পিপলস। যারা দিন আনে দিন খায় তাদের খাওয়ার তারা কী ব্যবস্থা করছেন। এই লোকগুলোকে তো ঘরে রাখতে পারবেন না। যার পেটে ভাত নেই তাকে লকডাউন, করোনা দিয়ে কী করবেন। সে তো চিন্তা করতে পারবে না। এই সংখ্যা কিন্তু অনেক।’

আমারসংবাদ/জেআই