Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

‘হুজুর কেবলা’রা সবসময় থাকেন

মহিউদ্দিন খান মোহন

এপ্রিল ১৮, ২০২১, ০৮:৩০ পিএম


‘হুজুর কেবলা’রা সবসময় থাকেন

প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদের ‘হুজুর কেবলা’ গল্পটি অনেকেই পড়ে থাকবেন। ওই গল্পে তিনি আমাদের দেশের এক শ্রেণির ভণ্ড, প্রতারক ও ধর্ম ব্যবসায়ীর চরিত্র অত্যন্ত চমৎকাররূপে তুলে ধরেছেন। গল্পটি এরকম। বিএ পরীক্ষার্থী এমদাদ একদিন তার সব জামা-জুতা ছিড়ে টুকরা টুকরা করে জোব্বা-আলখেল্লা পরিধান করে এক ‘হুজুরের’ মুরিদ হয়ে গেলো। দুনিয়াবি সব কায়কারবার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে সে হুজুরের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলো। এভাবে অনেকদিন গত হলো। একবার হুজুর কেবলা তার এক মুরিদের বাড়িতে তাশরিফ আনলেন। ওই মুরিদের সুন্দরী পুত্রবধূর প্রতি হুজুরের ‘নেক নজর’ পড়লো। তিনি নানা কায়দায় ফতোয়া দিয়ে সবাইকে বোঝালেন যে, তাদের আর দম্পতি থাকা উচিত নয়। এলাকার সব মুরিদ হুজুরের কথায় ঠিক ঠিক রব তুললো। অনেক কান্নাকাটি করেও বধূ এবং স্বামী হুজুরের ফতোয়া পরিবর্তন করতে পারলো না। অবশেষে তাদের তালাক হলো। এরপর হুজুর কেবলা অসহায় তালাকপ্রাপ্তা নারীকে উদ্ধারের মহৎকর্ম সম্পাদনের লক্ষ্যে ওই তরুণীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলেন। মুরিদরা মহাধুমধামে বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিন্তু এমদাদের মনে বিবেকের দংশন শুরু হলো। সে হুজুর কেবলার এই কাজকে মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। বিয়ের দিন হুজুর বর সেজে বসে আছেন। ভেতর বাড়িতে তরুণী বারবার মূর্ছা যাচ্ছে। আর স্বামীটি স্ত্রী হারিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ করছে। এমদাদের আর সহ্য হলো না। সে বিয়ের মঞ্চে গিয়ে হুজুর কেবলার পাগড়ি টেনে ধরে বলল, ‘রে ভণ্ড, পাষণ্ড, তুই নিজের লোভ চরিতার্থ করার জন্য দুইটি জীবন ধ্বংস করে দিলি? আমি তোকে ছাড়ব না’। মুরিদরা ঝাঁপিয়ে পড়ে হুজুরকে এমদাদের হামলা থেকে রক্ষা করল। হুজুর মুরিদদের বললেন, ছেলেটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ওকে চিকিৎসা দিতে হবে। মুরিদরা এমদাদকে সরিয়ে নিয়ে গেল। হুজুর কেবলা নির্বিঘ্নে তার দায়িত্ব পালন করলেন।

এবার আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি তখন একটি বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। আমার বস একদিন আমাকে বললেন, আজ সন্ধ্যার পরে আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে। গেলাম তার সাথে। সার্কিট হাউস রোডে পিডব্লিউডির এক ইঞ্জিনিয়ারের বাসায়। গিয়ে দেখলাম সেখানে বেশকিছু মুসল্লি বসা। আর একটি চেয়ারে বসে হালকা পাতলা চেহারার দাড়িওয়ালা-পাগড়িওয়ালা এক ব্যক্তি ওয়াজ করছেন। পরিচয় জানলাম, তিনি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর, নাম মতিউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন, পেয়েছেন বীর প্রতীক খেতাবও। জলসা শেষে ‘পীর সাহেবের’ সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন বস। পীর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আমি ব্যবসা করি কি-না। বললাম না, আমি তার ফার্মে চাকরি করি। পীর সাহেবের মুখটা একটু ম্লান হলো। বুঝলাম একজন কর্মচারীর চেয়ে ব্যবসায়ী-বিত্তবান মুরিদ পীর সাহেবের বেশি পছন্দ। সপ্তাহখানেক পরে আবার আমাক নিয়ে গেলেন পীর সাহেবের জলসায় (তারা বলতেন ক্লাস)। এবার স্থান খিলগাঁও তালতলাস্থ পীর সাহেবের নিজস্ব বাসভবন। সেদিন তার দুটি কাজ আমার খটকা লাগিয়ে দিলো। প্রথমত তিনি মুরিদদের একাধিক বিয়ের জন্য উৎসাহিত করলেন। বললেন, স্ত্রী হলো পাওয়ার হাউস। আপনি সেখান থেকে আপনার মানসিক শক্তি বাড়াতে পারবেন। উল্লেখ্য, তখন পীর সাহেব তার ঘরে তিনজন বিবিকে পালন করছিলেন। দ্বিতীয় যে কাজটি করলেন তা প্রতারণা মূলক মনে হলো আমার কাছে। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য  বিষয়ে লেকচার শেষ করে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্য সম্বন্ধে বলার আগে তিনি তার খাস মুরিদকে বললেন, শহীদুল্লাহ বাহার, ভেতরের মাইকের কানেকশনটা বন্ধ করে দাও’। অর্থাৎ ভেতরের ঘরে জমায়েত হওয়া স্ত্রীলোকরা যেনো তাদের অধিকারের কথা জানতে না পরেন। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এই পীরের দরবারে আর যাবো না। আমার বস পরেরবার  আমাকে যেতে বললে আমি বললাম, আমি যাবো না। আমার বাবা বেঁচে আছেন। এ মুহূর্তে তিনিই আমার পীর। তাই অন্যকোনো পীরের কাছে যাবো না। তিনি একটু মনোক্ষুণ্ন হলেও কিছু বললেন না।

দু’তিন বছর পরের ঘটনা। একদিন শুনলাম সেই মেজর পীর ‘মুসলিম মিল্লাত বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন করেছেন। ওই সময় একদিন মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার উইং কমান্ডার এম. হামিদুল্লাহ খানকে (অব.) জিজ্ঞেস করলাম, ভাই মেজর মতিউরকে চেনেন নাকি? তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন ও কি এখন জেলে, না বাইরে? আমি বললাম, সে তো এখন পীর। তার অনেক মুরিদ আছে। বিস্মিত হামিদুল্লাহ খান তারপর ওই পীরের কাহিনী শোনালেন। সে পলাশ হাউজিং নামে কোম্পানি খুলে প্লট দেয়ার নামে অনেকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়। হামিদুল্লাহ খানও প্রতারিতদের মধ্যে একজন। প্রতারণার মামলায় মেজর মতিউরের জেল হয়। এর কয়েক মাস পরেই ঘটলো সেই পিলে চমকানো ঘটনা। সম্ভবত ১৯৮৯ সালে নভেম্বর মাসে কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়ায় পীর মেজর মতিউরের বাহিনীর সাথে পুলিশের দুই দিনব্যাপী বন্দুকযুদ্ধ হয়। তার কয়েকজন শিষ্য নিহত হয়; তাদের মধ্যে শহীদুল্লাহ বাহার একজন। আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন পীর মেজর মতিউর। তারপর আর তার কোনো খোঁজ খবর পাওয়া যায়নি। অবশেষে বেরিয়ে এলো তার নানা রকম কুকীর্তির খবর। নারী কেলেঙ্কারিও ছিলো তার মধ্যে। শুনেছি এক মুরিদের সুন্দরী স্ত্রীর দিকে হাত বাড়িয়েছিল সে। সে জন্য ওই মুরিদ একদিন পীরকে উত্তম-মধ্যমও দিয়েছিল।

তো, আবুল মনসুর আহমদ তার গল্পে যে পীর বা হুজুর কেবলার চরিত্র এঁকেছেন, তার অভাব নেই আমাদের সমাজে। বর্তমানেও পীরালি ব্যবসা বেশ জমজমাট আমাদের দেশে। এক শ্রেণির বর্ণচোরা মুখোশের আড়ালে নিজেদের কদর্য চেহারাটা লুকিয়ে রেখে সমাজে মর্যাদার আসনে উপবেশন করে। আর আখিরাতে ‘দয়াল মুর্শিদ’ পার করবেন— এ আশায় সরলমনা মানুষরা এদের খপ্পরে পড়ে টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ, এমনকি নিজের স্ত্রীকেও হারায়। যেমন হারিয়েছে বাগেরহাটের হাফজ শহীদুল ইসলাম। যাকে সে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতো, সে-ই তার ঘর ভেঙেছে। গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের একটা রিসোর্টে নারীসহ হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক প্রথমে স্থানীয় জনগণের হাতে অবরুদ্ধ, পরে পুলিশের হাতে আটক হয়। কিন্তু হেফাজতকর্মীরা পুলিশের কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে নেয়। এরপর সে ঘটনা নিয়ে সারা দেশে হয় তোলপাড়। প্রশ্ন ওঠে মামুনুল হকের সঙ্গে থাকা নারী কে? ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে মামুনুল হক মহিলাকে তার দ্বিতীয় স্ত্রী বলে দাবি করে। সে ওই মহিলার নাম আমিনা তাইয়্যেবা বলে জানায়। ওইদিন রাতেই মামুনুল ও তার স্ত্রীর একটি টেলিফোন সংলাপ মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। তাতে শোনা যায়, মামুনুল তার স্ত্রীকে বলছে, তার সঙ্গে থাকা মহিলা হাফেজ শহীদুল ইসলামের ওয়াইফ। পরিস্থিতির কারণে সে তাকে স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিতে বাধ্য হয়েছে। এ নিয়ে সংবাদ এবং সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরদিন হেফাজতে ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ওই মহিলা মামুনুলের দ্বিতীয় স্ত্রী এবং আন্দোলনে ক্লান্ত-শ্রান্ত মামুনুল একটু অবকাশ কাটানোর জন্য ওই রিসোর্টে গিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে খবর বেরিয়ে পড়ে যে, আমিনা তাইয়্যেবা মামুনুলের প্রথমা স্ত্রীর নাম। তার সঙ্গে থাকা মহিলার নাম জান্নাত আরা ঝর্ণা। স্ত্রীর নাম নিয়ে মামুনুলের মিথ্যাচার সবাইকে বিস্মিত করেছে। প্রথমা স্ত্রীর নাম পরিচয় রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করে ভিন্ন একজন মহিলাকে নিয়ে অবকাশ যাপন শরিয়তের কোনো বিধান সম্মত কিনা এ প্রশ্ন ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের।

সবচেয়ে বড় বোমাটি ফাটায় জান্নাত আরার ঝর্ণার প্রথম পক্ষের ছেলে আবদুর রহমান জামি। সে গত ৪ এপ্রিল এক ভিডিও বার্তায় তার মা ও বাবার বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য মামুনুল হককে দায়ি করে। সে বলেছে, মামুনুল হকের মধ্যে কোনো মনুষ্যত্ববোধ নেই। তিনি অসদুদ্দেশ্য পূরণ করতে তার বাবা শহীদুল ইসলাম ও মা জান্নাত আরা ঝর্ণার মধ্যে পরিকল্পিতভাবে দূরত্ব তৈরি করেন। এ ক্ষেত্রে মামুনুল শহীদুলের অন্ধ আনুগত্যকে  ব্যবহার করেছেন। জামি তার বক্তব্যে এ ঘটনার জন্য তার বাবাকেও দায়ি করে। সে বলে, ‘এটা আমি বলব যে, আমার বাবার কর্মফল। আমার বাবা এই মানুষটাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতো। পাগলের মতো ভালোবাসত। জামি বলেছে, পারিবারিক ঝগড়াঝাটির সুযোগ নিয়ে সুকৌশলে মামুনুল তার বাবা-মার মধ্যে ডিসটেন্স বাড়িয়ে দিয়েছে। এভাবে সে একটি পরিবারের খুশি, ভালোবাসা, একটা পরিবারের যে মিলমিশ, একটা সম্পর্ক পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে। জামি দেশবাসীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছে কাউকে অন্ধের মতো বিশ্বাস না করতে।

এদিকে এসব ঘটনার তদন্ত এখন চলছে। তদন্ত শেষ হওয়ার পরেই বোঝা যাবে আসল ঘটনা কী। তবে এটা পরিষ্কার যে, রিসোর্টে যাওয়া মহিলার পরিচয় নিয়ে মামুনুল হক মিথ্যাচার করেছেন। প্রকৃত নাম গোপন করে প্রথমা স্ত্রীর নাম রেজিস্ট্রারে লিখে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’। তা ছাড়া ওই মহিলা যদি তার বৈধ স্ত্রী হন তাহলে তো তাকে আলাদা বাসায়ই রাখতে পারতেন। অবকাশ কাটাতে তাকে নিয়ে রিসোর্টে যেতে হবে কেন? এদিকে গণমাধ্যমের খবরে নিশ্চিত করা হয়েছে, মামুনুলের এই কথিত দ্বিতীয় বিয়ে সম্বন্ধে তার প্রথমা স্ত্রী এবং বোন অবগত নন। প্রথমা স্ত্রীর অনুমতি ব্যতিরেকে গোপনে আরেকটি বিয়ে করা শরিয়ত এবং রাষ্ট্রীয় আইনবিরোধী কাজ। সে বেআইনি কাজটিই করেছেন মামুনুল হক। যদিও মামুনুল হক তার এই কথিত বিয়েকে মানবিক বিয়ে বলেছেন, কিন্তু এর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে চরম অমানবিক এক কাহিনী। সে একটি সংসার ভেঙেছে, নিজের স্ত্রীর সাথে প্রতারণা করেছে। ঘটনার পরিসমাপ্তি কোথায় হবে কেউ জানে না। পুলিশি তদন্ত শেষ হলেই তা জানা যাবে। তবে, সে তদন্ত কবে শেষ হবে বা আদৌ শেষ হবে কি-না তা নিয়ে অনেকের সংশয় আছে। সব আলেম খারাপ এ কথা বলা যাবে না। কিন্তু ওই যে কথায় আছে ‘এক মণ দুধ নষ্ট করে এক ফোঁটা চোনা’। তেমনি মামুনুলদের মতো ভণ্ডদের কারণে গোটা আলেম সমাজ মুখোমুখি হয় প্রশ্নের। সেই কবে আবুল মনসুর আহমদ তার গল্পে ভণ্ড পীরদের চরিত্র অঙ্কন করে গেছেন। সময় বদলালেও ভণ্ড হুজুর কেবলারা শেষ হয়ে যায়নি। ওরা একেক সময় একেক রূপ ধরে আসে। আসতেও থাকবে বোধ হয়।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

আমারসংবাদ/জেআই