Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

ভুয়া কাজির ছড়াছড়ি

এপ্রিল ১৯, ২০২১, ০৮:৩৫ পিএম


ভুয়া কাজির ছড়াছড়ি
  • সঠিক পরিসংখ্যান নেই মন্ত্রণালয়ের হাতে, সেই সুযোগ নিচ্ছেন প্রতারকরা
  • ভুয়া বিয়ে ও তালাকে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেক নারী-পুরুষ
  • ঘটছে সম্পত্তি ও পিতৃত্বের অধিকার হারানোর ঘটনাও
  • বিয়েব্যবস্থা ডিজিটালাইজড করার দাবি বিশেষজ্ঞদের
  • ব্যবস্থা নেয়ার আগেই সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে রিট করেন ভুয়া কাজিরা -দাবি মন্ত্রণালয়ের

কাজি আছে, অফিসও আছে, নিয়মিত বিয়েও পড়াচ্ছেন। আছে বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রার- সরকার নির্ধারিত বালাম বইও। তবে সেটা ভুয়া। নেই আইনগত কোনো বৈধতাও। সেই সাথে কাজির নেই সরকারি নিবন্ধনও। তবুও কথিত কাজি পরিচয়েই বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রি করছেন বছরের পর বছর। নিবন্ধন ছাড়াই ভুয়া বিয়ে রেজিস্ট্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। এসব নামসর্বস্ব কাজির ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ।

সম্প্রতি সারা দেশে নিকাহ ও তালাক নিবন্ধনে এক প্রকার বিশৃঙ্খলা চলছে। বেড়েছে ভুয়া কাজির দৌরাত্ম্য। বিয়ে ও তালাক নিবন্ধনেও জালিয়াতি বেড়েছে। কথিত কাজির ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। ভুয়া বিয়ে ও তালাকে নিঃস্ব হচ্ছে নারী-পুরুষ উভয়েই। মাস কয়েক আগে এমনই এক ঘটনা ঘটেছে কিশোরগঞ্জে। অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই কিশোর-কিশোরী ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করে বিপাকে পড়েছেন। বিয়ের বছর খানেক পর বনিবনা না হওয়ায় স্বামীর নামে মামলা দিতে আদালতে গিয়ে বেরিয়ে আসে আসল ঘটনা।

আইনজীবী জানান, বিয়ের কাবিননামা ভুয়া। কাবিননামার বৈধতা না থাকায় নারী নির্যাতন ও যৌতুকের মামলার পরিবর্তে স্বামী শাকিলের নামে ঠুকে দেয়া হয় ধর্ষণের মামলা। ভুয়া কাজির ভুয়া কাবিননামা কাণ্ডে মিথ্যা মামলায় বৈধ স্ত্রী দাবি করা শাকিলের অবস্থা এখন শোচনীয়। জেল থেকে আর মুক্তি মিলছে না তার। শুধু শাকিলই নয়, আসল ভেবে ভুয়া কাবিননামা, তালাকনামা দাখিল করে সম্পত্তির অধিকার, পিতৃত্ব ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিতের ঘটনা ঘটছে অহরহ। তবুও ভুয়া কাজিদের নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। মাঝে মধ্যে ধরা পড়ে গণমাধ্যমে খবর আসার পরও নেয়া হয় না কোনো আইনি ব্যবস্থা। ফলে পাড়া-মহল্লাতেই ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে কাজি অফিস। বেপরোয়াভাবেই চালাচ্ছেন তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ড। জানা গেছে, নিকাহ-তালাক রেজিস্ট্রারদের কেন্দ্রীয় কোনো পরিসংখ্যানও মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই। কোন এলাকায় কাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তারও হিসাব নেই। তাই সারা দেশে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে রয়েছে বিভ্রান্তি। এক ধরনের নিয়ন্ত্রণহীনতাও সৃষ্টি হয়েছে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের কার্যক্রমে। এমন অবস্থায় তাদের নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ, স্থায়ীকরণ, জবাবদিহিতা ও শাস্তি  নিশ্চিতকরণের বিষয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।

এদিকে পুরোনো ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে বিয়ে এবং বিচ্ছেদ নিবন্ধিত হওয়ার জন্যই নানা জটিলতার উদ্ভব হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ভুয়া বিয়ের দৌরাত্ম্য কমাতে নিকাহ-তালাক নিবন্ধনে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার জরুরি। এদিকে সম্প্রতি এ নিয়ে উচ্চ আদালতে রিটও হয়েছে। রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট বিয়ে ও ডিভোর্সের ক্ষেত্রে পারিবারিক জীবনের বৃহত্তর সুরক্ষায় ডিজিটালাইজড রেজিস্ট্রেশনের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না— তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রারদের ডিজিটালাইজেশনের আগে প্রশিক্ষণ এবং লজিস্টিক সাপোর্টের প্রশ্ন রয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ে বহু প্রকল্প রয়েছে। আমাদের দাবি, কোনো একটি প্রকল্পের আওতায় আগে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। লজিস্টিক সাপোর্ট নিশ্চিত করতে হবে। তারপরই ডিজিটাল ব্যবস্থা কার্যকর ফল দেবে। অন্যথায় ডিজিটাল ব্যবস্থার নামে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের কেবল হয়রানিই বাড়বে। এদিকে নিকাহ-তালাক রেজিস্ট্রিতে শৃঙ্খলা আনয়নে কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার তৈরিসহ ডিজিটালাইজড করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে আইন ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রণালয়। আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অবৈধ ও ভুয়া কাজিরা খুবই শক্তিশালী। তাদের আইনের আওতায় আনা অসম্ভব। কারণ তারা একটি সিন্ডিকেট হিসেবে কাজ করে। এতে সারা দেশের ভুয়া কাজিরা জড়িত আছে এবং সব একত্রিত হয়ে অর্থ ঢেলে মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করে। তাদের বিরুদ্ধে বাল্যবিয়ে, ভুয়া বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রিসহ বেআইনিভাবে বিয়ে পড়ানোর অভিযোগ পাওয়া গেলেও ব্যবস্থা নেয়া যায় না। এর আগেই আদালতে গিয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে রিট মামলা করেন। এভাবেই চলতে থাকে বছরের পর বছর। কর্মকর্তারা জানান, ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকার অনেক কাজির বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেক ভাসমান কাজি। যাদের আইনগত বিয়ে পড়ানোর কোনো এখতিয়ার নেই। কাজি হিসেবে নিয়োগ পেতে যেসব যোগ্যতা বা আইনের বিধিবিধান রয়েছে তার কোনোটাই তাদের নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা জজকোর্ট এলাকায় ভুয়া কাজির সংখ্যা বেশি। কিছু অসাধু আইনজীবী ভুয়া কাজির মাধ্যমে বিয়ে রেজিস্ট্রি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অথচ ওই ভুয়া কাজিদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে সাত হাজার ৯০০ জন কাজি রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা জেলায় রয়েছেন ২৩১ জন। শুধু ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে এলাকায় রয়েছেন ১২৯ জন। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই তালিকার বাইরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে সব কাজি রয়েছেন তারা অবৈধ। এ সংখ্যা প্রায় চারশ। তাদের কোনো নিবন্ধনপত্র নেই। রাজধানীতে কয়েকটি এলাকা বড় হওয়ায় সেখানে একের অধিক কাজি রয়েছেন। ঢাকা জজকোর্ট, রামপুরা, বসুন্ধরা, মগবাজার, মালিবাগ, মহাখালী, উত্তরা, ফার্মগেট, সায়েদাবাদসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছেন অগণিত ভাসমান কাজি। তাদের কোনো বৈধ সনদ বা ঠিকানা নেই।

জানা গেছে, বিয়ে ও তালাক নিবন্ধন অনলাইনের আওতায় এনে একটি জাতীয় তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য আইন ও বিচার বিভাগ ‘অনলাইনে বিয়ে ও তালাক’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পে প্রাথমিকভাবে ২০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। আগামী জুলাই থেকে পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হবে বলে আশা করছে আইন ও বিচার বিভাগ। সফটওয়্যার ব্যবহারের জন্য সারা দেশের নিকাহ রেজিস্ট্রারদের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল সরবরাহ করা হবে। দেয়া হবে প্রশিক্ষণ। নির্দিষ্ট কিছু তথ্য দিয়ে বিয়ে বা তালাক নিবন্ধন করতে হবে। এ জন্য সফটওয়্যারটি এমনভাবে সাজানো হবে, যেখানে বয়স লুকানোর সুযোগ থাকবে না। পাশাপাশি কারো আগে বিয়ে থাকলে তার তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিকাহ রেজিস্ট্রারের কাছে চলে আসবে। তথ্য ভাণ্ডারের মূল সার্ভার স্থাপন করা হবে আইন ও বিচার বিভাগে। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে ব্যাকআপ সার্ভার স্থাপন করা হবে। আবার যাতে নাগরিকরা চাইলে বিয়ে নিবন্ধন সনদ অনলাইন থেকে নিতে পারেন সে ব্যবস্থাও থাকবে।

ভুয়া কাজিদের বিরুদ্ধে কী ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল বলেন, ‘অবৈধ ও ভুয়া বিয়ে এবং তালাক নিবন্ধনের দায়ে ওই কাজির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ দণ্ডবিধিতে আছে। দণ্ডবিধির ৪১৭ ধারা অনুযায়ী কাজির এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হতে পারে। নিবন্ধিত না হয়েও বৈধ কাজির রূপ ধারণ করে কাজ করা প্রতারণার সামিল। অপরদিকে মুসলিম বিয়ে ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন-১৯৭৪ অনুযায়ী অনুর্ধ দুই বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে। তবে বিভিন্ন সময়ে ভুয়া কাজি ধরা পড়ার খবর গণমাধ্যমে আসে, কিন্তু তাদের শাস্তি হয়েছে এমন নজির নেই। ভুয়া কাজিদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে এমন অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে। বিদ্যামান নিকাহ ও তালাক ব্যবস্থা ডিজিটালাইজড করা উচিত কি-না? এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু ধীরে ধীরে সব কিছু ডিজিটালাইজড করা হচ্ছে, তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিকাহ সিস্টেমটাকে আধুনিক করা এখন সময়ের দাবি। মহামান্য হাইকোর্ট এই বিষয়ে রুল দিয়েছে। আশা করি সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখবে।’ কাজির তালিকা ও ভুয়া কাজির শাস্তি না হওয়ার বিষয় উল্লেখ করে এ আইনজীবী বলেন, এটা মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতা ও ব্যর্থতা। অবিলম্বে মন্ত্রণালয়কে বিয়ে নিবন্ধক (কাজিদের) তালিকা, এরিয়ার তালিকা তৈরি করে অনলাইনে দিয়ে দেয়া দরকার। সদিচ্ছা থাকলে এই কাজটি এক মাসেই সম্ভব এবং তালিকার কপি, উপজেলা প্রশাসন, ইউপি চেয়ারম্যান এবং থানায়ও দিয়ে দেয়া যায়। খুব সাধারণ কাজ। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতায় এমন জনগুরুত্বপূর্ণ কাজ উপেক্ষিত হয়ে আছে, এটা দুঃখজনক।’ বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার সমিতির মহাসচিব কাজী ইকবাল হোসেনের বলেন, ‘বিদ্যমান ব্যবস্থায় বর-কনের অনেক তথ্যই নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। বৈবাহিক তথ্যের ডাটাবেজ থাকলে এসব তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যেতো। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রান্তিক জনপদের অধিক্ষেত্রগুলোতে রয়েছেন অনেক বয়ষ্ক নিকাহ রেজিস্ট্রার। তাদের অনেকেরই তথ্য-প্রযুক্তি জ্ঞান নেই। ল্যাপটপ তো দূরে থাক, টাচ মোবাইলই ব্যবহার করতে পারেন না তারা। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারোয়ার বলেন, নিকাহ-তালাক রেজিস্ট্রিকে ডিজিটালাইজড করা এখন সময়ের দাবি। এটি বাস্তবায়ন সম্ভব হলে নিকাহ রেজিস্ট্রার এবং রেজিস্ট্রেশনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষের হয়রানিও লাঘব হবে।’

আমারসংবাদ/জেআই