এপ্রিল ২০, ২০২১, ০৮:১৫ পিএম
মার্কেটে তালা ঝুলছে! বাইরে দুই-তিনজন লোকসহ সামনে দাঁড়িয়ে আছেন গাউছিয়া মার্কেটের ব্যবসায়ী তানভীর হোসেন। চোখেমুখে হতাশা আর অন্ধকারের ছাপ। সামনে থাকা ওদের বলছেন, ‘ঢাকায় আর খরচ বহন করতে পারছি না। তাই দুদিন আগে স্ত্রী-সন্তানদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার ফ্ল্যাটে টু-লেট লাগিয়ে দিয়েছি। এ ঈদেও যদি দোকান খুলতে না পারি তাহলে হয়তো আর ঢাকা শহরে ফেরা হবে না। দোকান বিক্রি করে দিতে হবে। ভাড়া দিতে পারিনি বহুদিন। পাঁচ-ছয়জন কর্মচারী, তাদেরও বেতন দিতে পারছি না। কয়েক লাখ টাকার কাপড় কেনা; বিক্রি হলে টাকা দেয়ার কথা, তাও দিতে পারছি না। লোনের কিস্তি বাকি পড়ছে। ব্যবসা সংক্রান্ত আরো অনেক খরচ কিছুই মেটাতে পারছি না, আমরা কী করে বাঁচবো।’ কেউ তা চিন্তাও করছে না শুধু তিনি নন, নিউ মার্কেটের চিশতিয়া, চাঁদনীচক, নূর ম্যানসনসহ রাজধানীতে অবস্থিত সব মার্কেট ও দোকানগুলোতে ঝুলছে তালা। কাপড়ের বোঝা বহন করা ভ্যানগুলো মার্কেটের সামনে পড়ে আছে। দিনমজুরদের অনেকে মানুষের কাছে হাত পাতছেন। বিভিন্ন মার্কেটের ব্যবসায়ীদের দোকান ও কারখানায় কাজ করেন কয়েক হাজার কর্মচারী। তারা জানান, প্রতি বছর ব্যবসায়ীরা ঈদের আগে তাদের বেতন-বোনাস মিটিয়ে দেন। গত বছর করোনার জন্য টাকা দেয়নি। খেয়ে না খেয়ে কোনোভাবে পরিবার নিয়ে বেঁচে আছেন। এবারো লকডাউনের কারণ দেখিয়ে মালিকপক্ষ হয়তো তাদের পাওনা টাকা দেবেন না। তাহলে পরিবার নিয়ে কিভাবে বাঁচবেন। তারা বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা না গেলেও এবার হয়তো খেতে না পেরেই মারা যাবেন ।’
নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন বলেন, ‘গতবারও মার্কেট বন্ধ থাকায় মার্কেটের শতশত ব্যবসায়ী কর্মচারী নিঃস্ব হয়ে গেছেন। এবারো যদি বন্ধ থাকে আর বাঁচার পথ থাকবে না। তবে আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের দোকান খোলার সুযোগ দেয়া হোক।’
ইস্টার্ন মল্লিকা দোকান মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সরওয়ার উদ্দিন খান বলেন, ‘গত বছর ঈদের জন্য যে টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম, করোনার কারণে মার্কেট বন্ধ থাকায় সেই মালামাল গুদামে থেকে নষ্ট হয়েছে। সেই লোকসানই সামলাতে পারিনি। ঈদ প্রায় নিকটে। সাতটি রোজা পার হয়ে গেছে। যদি শেষ সময়েও মার্কেট না খুলতে পারি, ব্যবসা করতে না পারি, তাহলে আমাদের রাস্তায় নামতে হবে। রানা আহমেদ নামের এক গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘লাখো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও মধ্যবিত্তের নীরবে আত্মহত্যার কারণ হবে চলমান লকডাউনের সিদ্ধান্ত।’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি কামরুল হাসান বলেন, ‘আমরা পাইকারি ব্যবসায়ীরা ঋণ করে ঈদের জন্য কোটি টাকার জামা-কাপড় বানিয়ে রেখেছি। লকডাউনের কারণে সারা দেশের খুচরা ব্যবসায়ীরা সেসব না নিতে পারলে এই কাপড় দিয়ে আমরা কী করবো? গত বছরও মার্কেট বন্ধ থাকার কারণে দোকানের কর্মচারীদের বেতন-বোনাস দিতে পারিনি। এবারো সেই শঙ্কার মধ্যে রয়েছি। এবার যদি দোকান খুলতে না পারি আমরা কিভাবে বাঁচবো শ্রমিকদের কিভাবে বাঁচাবো। আমরা সরকারের কাছে স্বাভাবিক জীবন যাপনের সুযোগ চাই। অন্তত শেষ সময় হলেও শারীরিক দূরত্ব মেনে ব্যবসা করার সুযোগ দেয়া হোক।’
ক্ষুদ্র, পাইকারি খুচরা মার্কেটের ব্যবসায়ীরা পুঁজি হারিয়ে সর্বস্বান্তের পথে : বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘গত বছর লকডাউনে ছয় থেকে সাত হাজার কোটি টাকার পুঁজি বিনষ্ট হয়েছে। সেই সঙ্গে পবিত্র রমজান ও ঈদ উপলক্ষে ২০ থেকে ২২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে করা হয়, তা-ও বিনষ্ট হয়েছে। তা সত্ত্বেও বর্তমান করোনা মহামারির কারণে ক্ষুদ্র, পাইকারি খুচরা মার্কেট ও দোকানগুলো দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং জীবন রক্ষার্থে বন্ধ রাখার মানসিক প্রস্তুতি আমাদের ছিলো। কিন্তু এ বছরও ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা পবিত্র রমজান ও ঈদ উপলক্ষে কিছুটা ব্যবসার আশায় প্রায় গত বছরের মতোই বিনিয়োগ করেন। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের ব্যাপার যে, এবারো আকস্মিকভাবে লকডাউন ঘোষণা করায় ক্ষুদ্র পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী গত বছরের মতো পুঁজি হারানোর ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এমন অবস্থায় এ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে সীমিত পরিসরে ব্যবসা করার সুযোগ না দিলে তারা পুঁজি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যাবেন।’
উৎপাদন হলেও বিক্রি হচ্ছে না পণ্য, কারখানা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা : লকডাউনে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় বাজারের পণ্য উৎপাদকরা। দোকানপাট সব বন্ধ করে দেয়ায় রড, সিমেন্ট, বস্ত্র, আসবাবপত্র, পাদুকাসহ নানা ধরনের পণ্যের বাজার অনেকটা স্থবির হয়ে গেছে। বর্তমানে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে সরকার কারখানা চালু রাখার সুযোগ দিলেও তা কাজে আসবে কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে ব্যবসায়ীদের। তারা জানান, যারা পণ্য বিক্রি করবেন তাদের দোকানপাট বন্ধ। তাই কারখানায় উৎপাদন করলেও তা বাজারে পৌঁছানো যাবে না, বিক্রিও হবে না। জানা গেছে, স্থানীয় বাজারে প্রায় শতভাগ কাপড়ের চাহিদা মেটায় দেশের বস্ত্রকলগুলো। সারা দেশে এখন ছোট-বড় তিন হাজার বস্ত্রকল আছে। এই খাতে কাজ করেন কয়েক লাখ শ্রমিক। সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধে দেশি বস্ত্রকলগুলো ভোগান্তিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঈদের আগে এই সময়েই কাপড়ের সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে। শুধু নরসিংদীসহ সারা দেশের বস্ত্রকলগুলো থেকে কাপড় প্রথমে নরসিংদীর বাবুরহাট, নারায়ণগঞ্জের গাউসিয়া, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন পাইকারি বাজারে যায়। সেখান থেকে সারা দেশে খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের হাতে পৌঁছায়। দেশে মাথাপিছু কাপড়ের চাহিদা ২৫ মিটার। এর প্রায় পুরোটাই সরবরাহ করে এসব কারখানা। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘ঈদের আগের এই সময়ে পাইকারি বাজারগুলো জমজমাট থাকে। কারখানাগুলো দিনরাত চলে। কিন্তু করোনার কারণে সবকিছু বন্ধ করে দেয়ায় হয়তো আগামী দুই-তিন দিন কারখানা চালানো যাবে। এরপরে বিক্রি করবো কোথায়? তখন বাধ্য হয়েই কারখানা বন্ধ করতে হবে।’
লাখ লাখ ফ্যাশন শিল্পের কারিগর ও ব্যবসায়ীরা অনিশ্চয়তায় : পরপর দুই বছর মহামারির ধাক্কা সামলাতে গিয়ে অনেকটা ছোট হয়ে এসেছে দেশীয় ফ্যাশন শিল্পের পরিসর। লাখ লাখ ফ্যাশন শিল্পের কারিগর ও ব্যবসায়ীরা অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। গত এক বছরে ফ্যাশন হাউজের অনেক ছোট আউটলেট বন্ধ হয়েছে, অনেক উদ্যোক্তা পেশা পরিবর্তন করেছেন, কারিগর, কর্মচারীদেরকেও ছাড়তে হয়েছে চাকরি। গত বছরও পহেলা বৈশাখের বাজার যখন নতুন নতুন ডিজাইনের শাড়ি, পাঞ্জাবি, থ্রি-পিস ও কুর্তা দিয়ে সাজানো হয়েছিল তখনই আসে ‘লকডাউন’। সে সময় লোকসান ও ঋণের বোঝা হালকা করতে ফ্যাশন হাউজগুলোতে চলে কর্মী ছাঁটাই। এ বছর রোজার ঈদ সামনে রেখে হাউজগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিলেও মহামারির আঘাত এসেছে আরও বেশি তীব্রতায়। ধানমন্ডিত ফ্যাশন হাউজ ‘ইজির’ ব্যবস্থাপক আব্দুস সবুর বলেন, ‘এবার ঈদ কিংবা বৈশাখে বেচাকেনা বলতে কিছু নেই। মানুষের বাইরে বের হওয়ার সুযোগ না থাকলে পোশাক কিনে কী করবে।’ পাশের ‘গ্রামীণ সম্ভার’ নামের আরেকটি শোরুমে কথা হয় ব্যবস্থাপক হূদয় শিকদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এবার পহেলা বৈশাখের দু’দিন আগে ‘১৬ হাজার টাকার বিক্রি হয়েছে তাদের। অথচ বৈশাখের দুদিন আগে এক লাখ টাকার বেশি পণ্য বিক্রি হয়। দোকানে ১০ জনের মতো বিক্রয়কর্মী। এই বিক্রিতে লাভ তো দূরের কথা ক্ষতিও পোষানো যাবে না। মানুষ ফ্যাশনপণ্য কেনাকাটা করছে না। চাল-ডাল, মাছ-মাংসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে বেশি নজর দিচ্ছে।’
অর্থনীতিবিদ নেয়ামত আলী সরকার বলেন, ‘লকডাউনে সাধারণ মানুষ, ছোট ব্যবসায়ীরা তাদের উপার্জন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছেন। এসব পেশার মানুষেরা খুব মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এসব মানুষদের পাশে সরকারকে দাঁড়াতে হবে। সত্যিকার অভাবী এবং অসহায় মানুষেরা যাতে প্রণোদনা সঠিকভাবে পায় তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এসব মানুষের কাছে এখন মূল বিষয় হচ্ছে বেঁচে থাকা। তাই এরা সবাই বাঁচার জন্য দৌড়াচ্ছে।’ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহিত কামাল জানান, ‘লকডাউনের ফলে সাধারণ মানুষ একপ্রকার ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে। খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ এখন প্রায় কর্মহীন। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার ও স্বল্পপুঁজির ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন। করোনা সংক্রমণের ভিত্তি এবং লকডাউনের ফলে সার্বিকভাবে মানুষের আর্থিক ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’
আমারসংবাদ/জেআই