Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪,

দেশেও করোনা তাণ্ডবের উঁকি

আবদুর রহিম ও মাহমুদুল হাসান

এপ্রিল ২৭, ২০২১, ০৮:২০ পিএম


দেশেও করোনা তাণ্ডবের উঁকি
  • ভারতে প্রতিদিন ৭৫ হাজার আইসিইউ শয্যার প্রয়োজন, আক্রান্তের অনুপাত প্রতিদিন ১৫ লাখ!
  • এখনো ভারত থেকে ঢুকছে মানুষ, পাওয়া গেছে আক্রান্ত রোগী, পাঠানো হয়েছে রেড জোনে
  • ভারতফেরতদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ তাণ্ডবের ইঙ্গিত বিশেষজ্ঞদের

দিল্লি এখন ‘মৃত্যুর শহর’! রাস্তায় লাশের পাহাড়! কবর খোঁড়ার লোক নেই। চিতা জ্বালানোরও লোকের অভাব। দাহ করার মতো কাঠও আর পাওয়া যাচ্ছে না। পাল্কি চলছে না শহরে। চিতা শুধু জ্বলছেই। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে মৃতদেহের লাইন। লাশ নিয়ে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে অ্যাম্বুলেন্স। আক্রান্তরা অক্সিজেনের জন্য চিৎকার করছেন। হাসপাতালে সিট নেই। কিট নেই, ওষুধ নেই। ডাক্তার ও নার্সের ভয়াবহ সংকট। পুরো রাজ্য হাফিয়ে গেছে। সেখানে হু হু করে বাড়ছেই করোনা সংক্রমণ। সঙ্গে অব্যাহত মৃত্যুর মিছিলও। এ পরিস্থিতিতে সীমান্তে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ঢুকতে দেয়া হচ্ছে সে দেশের লোকজনকে। পাওয়া যাচ্ছে কোভিড আক্রান্ত রোগীও। গতকালও আক্রান্ত একজনকে রেডজোনে পাঠানো হয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশেও ঘরের দরজায় তাণ্ডবের উঁকি দিচ্ছে। আমরা এখনো মানবিকতায় সে দেশ থেকে আক্রান্ত রোগীকেও বাংলাদেশে প্রবেশে অনুমতি দিচ্ছি। এছাড়া এর আগে থেকেই ভারত থেকে আসা যাত্রীদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছি। বর্তমানে দেশে ভারতের ধরন দুটি না মিললেও শঙ্কার বড় কারণ আছে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, নতুন দুই ধরনের বিস্তার অনেক বেশি।

ভারতে বিগত ২৪ ঘণ্টায় সে দেশে নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তিন লাখ ২৩ হাজার ১৪৪ জন, মৃত্যু হয়েছে দুই হাজার ৭৭১ জনের। করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ২৮ লাখ ৮২ হাজার ২০৪ জন। এখনো পর্যন্ত করোনা প্রাণ কেড়েছে এক লাখ ৯৭ হাজার ৮৯৪ জনের। করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে দেশে। আমেরিকাতেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা এতদূর পৌঁছতে পারেনি। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, মে মাসেই আমেরিকাকে টপকে শীর্ষ স্থানে চলে আসবে ভারত। আক্রান্তের অনুপাতে ভারতে প্রতিদিন ১৫ লাখ লোক আক্রান্ত হচ্ছেন। সেখানে প্রতিদিন ৭৫ হাজার আইসিইউ শয্যার প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেছে মোদি সরকার।

এমন পরিস্থিতিতে ভারতে গত দুই বছরে অবসর নেয়া সশস্ত্রবাহিনীর চিকিৎসকদেরও কাজে ফেরানো হচ্ছে। তাদের বাড়ির কাছে থাকা করোনা সেন্টারে কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর অবসর নেয়া নার্সিং স্টাফদেরও করোনাযুদ্ধে মাঠে নামতে বলা হয়েছে। গতকাল এমনটাই জানালেন চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াত। এ প্রসঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান বলেছেন, ‘সেনাবাহিনীকে এগিয়ে আসার সময় এসে গেছে। করোনা মোকাবিলায় স্থানীয় প্রশাসনকে সাহায্য করবে বাহিনী।’

নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও মৃত্যুর শহর থেকে দেশে ঢুকছে মানুষ : নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ভারতে আটকেপড়া বাংলাদেশি যাত্রীরা দেশে ঢুকছেন।

ভারতের করোনার নতুন ধরন রোধে বাংলাদেশ সরকার দুই দেশের মধ্যে স্থলপথে পাসপোর্টধারী যাত্রী যাতায়াত ১৪ দিন বন্ধ ঘোষণা করলেও আটকেপড়া যাত্রীরা বিশেষ অনুমতিতে ফিরছেন। গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে মঙ্গলবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভারতে আটকেপড়া ৪৪ জন বাংলাদেশি বেনাপোল স্থলপথে দেশে ফিরেছেন। বাংলাদেশ থেকে ভারতে গেছেন ১৪ জন ভারতীয় যাত্রী। ভারত-বাংলাদেশ ল্যান্ডপোর্ট ইমপোর্ট এক্সপোর্ট কমিটির চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান জানান, ভারতের ভ্যারিয়েন্ট ভয়ানক। এমনিতেই ভারত থেকে অতি জরুরি অক্সিজেন আমদানি বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে কোনোভাবে একবার এ ভাইরাস দেশে ছড়িয়ে পড়লে মহামারি ধারণ করবে। রক্ষা পেতে সরকারি নির্দেশনা সবার মানা দরকার। বেনাপোল ইমিগ্রেশন স্বাস্থ্য বিভাগের মেডিকেল অফিসার আশরাফুজ্জামান বলেন, সরকার ইমিগ্রেশন কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণার পর ভারতে আটকেপড়া বাংলাদেশিদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৩৭৯ জন পাসপোর্টধারী যাত্রী দেশে ফিরতে কলকাতায় বাংলাদেশ দূতাবাসে আবেদন করেছেন। গত দুদিনে ফিরেছেন ৪৪ জন। বাংলাদেশে আটকেপড়া ভারতীয় নাগরিকরা ভারতীয় হাইকমিশনার বরাবর আবেদন করে দেশে ফেরার অনুমতি পেয়েছেন ৫৮ জন। সকাল থেকে ভারতে ফিরেছেন ১৪ জন। ভারত থেকে ফেরত আসা বাংলাদেশিদের ব্যক্তিগত খরচে ১৪ দিন বেনাপোলের বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। একজন ভারতফেরত করোনা আক্রান্ত বাংলাদেশিকে যশোর সদর হাসপাতালে রেডজোনে নেয়া হয়েছে। বেনাপোল ইমিগ্রেশন ওসি আহসান হাবিব বলেন, বাংলাদেশি উপ-হাইকমিশনারের ছাড়পত্র থাকায় আটকেপড়া যাত্রীরা দেশে ফেরার সুযোগ পেয়েছে।

সমপ্রতি ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর)-এর গবেষণায় আরও ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে এলো। দেখা গেছে, সঠিকভাবে সামাজিক দূরত্ব বিধি না মেনে চললে, একজন করোনা রোগী থেকে ৪০৬ জন সংক্রমিত হতে পারেন। তাই করোনাকে ঠেকানোর জন্য সামাজিক দূরত্ব বিধি বজায় রাখা এবং লকডাউনের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠক করে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রীর যুগ্ম সচিব লব অগরওয়াল আইএমআরের গবেষণার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘ছয় ফুট দূরত্ব থেকেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে। বাড়িতে নিভৃতবাসে থাকাকালীনও এমনটা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর মাস্ক না পরলে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা ৯০ শতাংশ। একজন সুস্থ মানুষ যদি মাস্ক পরেন, আর সংক্রমিত ব্যক্তি যদি মাস্ক না পরেন, সে ক্ষেত্রে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা ৩০ শতাংশ। দুজনেই মাস্ক পরলে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা মাত্র ১.৫ শতাংশ।’

ভারতের বিশিষ্ট কার্ডিয়াক সার্জন দেবী শেঠি বলেছেন, আইসিইউ শয্যা, নার্স ও চিকিৎসকের অভাবে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা সামনের তিন-চার মাসে লাগামের বাইরে চলে যাবে। ভয়ঙ্কর গতিতে বাড়বে সংক্রমণের হারও। তিনি বলেছেন, দেশে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে আগামী তিন থেকে চার মাস সংক্রমণের হার থাকবে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে। এখন দিনে তিন লাখ মানুষ পরীক্ষায় কোভিড পজিটিভ হচ্ছেন। তাত্ত্বিক দিক থেকে এটা বলা যায় প্রতি একজন কোভিড পজেটিভের থেকে অন্তত পাঁচজন সংক্রমিত হবেন, পরীক্ষা না করা হলেও। এর মানে, দিনে ১৫ লাখ মানুষ এখন সংক্রমিত হচ্ছেন। যদি ধরে নেয়া যায় এদের ৫ শতাংশকে আইসিইউতে রাখার প্রয়োজন হবে, তা হলেও প্রতিদিন আরও ৭৫ হাজার আইসিইউ শয্যার ব্যবস্থা করতে হবে দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে।

শুধু ভারত নয়, আমাদের দেশেও এখন সেই ঝুঁকি উঁকি দিচ্ছে। এ নিয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মো. মুশতাক হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ভারতের ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে আসতেই পারে। কারণ অনবরত মানুষ প্রবেশ করেছে। অনেকে সীমান্তে শনাক্ত হয়েছে। তবে ভাইরাস এক জায়গা থেকে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়লে বিবর্তন হয়। কখনো সংক্রমণ বেড়ে যায়। আবার কখনো সংক্রমণ দুর্বল হয়ে যায়। ভারতীয় সংক্রমণ নিয়ে হতাশ না হয়ে সচেতন হতে হবে। শনাক্ত রোগীদের সবাইকে চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। দেশে ভাইরাসের সর্বশেষ গতিবিধি জানতে বেশি বেশি জিনোম সিকোয়েসিং করতে হবে। সবসময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সবাইকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

কোভিড-১৯ জাতীয় কারিগর পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য ও বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারত। যাদের সঙ্গে আমাদের সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ। এই অবস্থায় ভারতের সংক্রমণ ঠেকানো খুব কঠিন। সুস্থ থাকতে হলে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধিতেই জোর দিতে হবে। প্রয়োজনে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে ভ্যাকসিন থেকেও বেশি কার্যকর হবে। যদিও ভারত থেকে আসা যাত্রীদের আলাদা করে রাখা উচিত ছিলো, কিন্তু আমরা তা করতে ব্যর্থ হয়েছি।

আমারসংবাদ/জেআই