Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪,

বিনামূল্যে সেবা পেলেন ৬ লাখ

এপ্রিল ২৭, ২০২১, ০৮:২০ পিএম


বিনামূল্যে সেবা পেলেন ৬ লাখ
  • কার্যকর ভূমিকা রাখছে  প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য
  • মামলার সংখ্যা কম, সঠিক সেবা পাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা
  • পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সুফলভোগী মানুষের সংখ্যা
  • ৪১ হাজার মামলা নিষ্পত্তি ও দেড় হাজার প্রত্যাহার
  • লিগ্যাল এইড সম্পর্কে প্রচারণা চালানোর তাগিদ বিশেষজ্ঞদের

আশরাফ আলী মিন্টু মোল্লা। বাড়ি যশোরের বেনাপোল পোর্ট থানার দিঘিরপাড় এলাকায়। পেশায় ভ্যানচালক। তবে কখনও কখনও দিনমজুরের কাজও করেন। ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে স্থানীয় চৌকিদার কালা কবিরকে নিয়ে তার বাড়িতে যান বেনাপোল পোর্ট থানার এসআই মাসুম। একবছরের সাজাপ্রাপ্ত দীঘিরপাড় এলাকার মৃত মোহর আলীর ছেলে আশরাফ আলী নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেয়া আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কপি দেখান তাকে। তখন পুলিশ তাকে আশরাফ আলী বলে আটক করেন। তিনি আশরাফ আলী নন, জানালেও পুলিশ তাকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। পরদিন সকালে পরিবারের লোকজন জন্মনিবন্ধন সনদের কপি নিয়ে থানায় গেলেও তাকে ছাড়া হয়নি। পরে পুলিশ তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়। কারাগারে দরবার ফাইলে তিনি অভিযোগ করেন আশরাফ আলীর পরিবর্তে তাকে জেল খাটতে বাধ্য করা হচ্ছে। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি।

এদিকে গত ৮ মার্চ যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শনে যান লিগ্যাল এইড কমিটির সচিব। এসময় মিন্টু তার কাছেও অভিযোগ করেন যে, তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত আশরাফ আলী নন। নামের ভুলে বিনাদোষে তাকে আটকে রাখা হয়েছে। অভিযোগটি আমলে নিয়ে জেলা লিগ্যাল এইডের আইনজীবীরা আদালতকে বিষয়টি অবহিত করেন। পরে লিগ্যাল এইডের সহযোগিতায় আদালত কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে নিশ্চিত হয় যে, বন্দি আশরাফ আলী প্রকৃত অপরাধী নন। লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে ১১ মার্চ যশোরের যুগ্ম দায়রা জজ ও স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-৬-এর বিচারক ভুক্তভোগী মিন্টুকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেন। শুধু মিন্টুই নয়, দেশের ৬৪ জেলার লিগ্যাল অফিস ১২ বছর ধরে দরিদ্র-অসচ্ছল মানুষকে বিনা খরচে আইনগত সহায়তা দিয়ে আসছে।

অসহায়, গরিব, অসচ্ছল মানুষ যথাযথ আইনি সহায়তা পান না এমন অভিযোগ ছিলো বেশ পুরনো। টাকা যার আইন তার— এমন কথাও শোনা যেতো। তবে লিগ্যাল এইডে সেবা পাচ্ছেন অসচ্ছলরাও। মূলত মামলায় জড়ালে আইন-আদালতে টাকাও খরচ করতে পারেন না অসচ্ছলরা। ফলে আক্রান্ত হয়েও থানা ফাঁড়িতে যেতে চান না ভুক্তভোগীরা। আদালত ও বিচার তো দূরের কথা। তাই অসহায় মানুষকে বিনামূল্যে আইনিসেবা দিতে সরকার দেশের প্রায় সব জেলায় চালু করে লিগ্যাল এইড সেবা সেন্টার। স্বাভাবিক সময়ের মতো করোনা ভাইরাসের সময়ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গরিব ও অসহায়দের জন্য কাজ করছেন সরকারি জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার কর্মীরা। দিনরাত একাধারে ২৪ ঘণ্টা আইনি সহায়তা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দিয়ে শহর থেকে গ্রামের তৃণমূল অসহায় ও গরিব মানুষের দুঃখ-দুর্দশা মুছে দেয়ার সেবায় নিয়োজিত লিগ্যাল এইড কর্মীরা। জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে বিনামূল্যে অসহায় মানুষদের আইনিসেবা দেয়া শুরু করে লিগ্যাল এইড। শুরু থেকে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সরকারি আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (লিগ্যাল এইড)। রাজধানীর বেইলি রোডে অবস্থিত জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদানকারী সংস্থার অফিসসহ ৬৪টি জেলা কার্যালয় রয়েছে। দিনদিনই বাড়ছে এর কর্মসূচির সফলতা ও সুফলভোগী মানুষের সংখ্যা। ফলে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা নিতে প্রতিদিন জাতীয় হেল্পলাইন কলসেন্টারের ‘১৬৪৩০’ নম্বরে বা সরাসরি যোগাযোগ করছেন বিচারপ্রার্থীরা। গ্রামের অসহায় দরিদ্র নারী-পুরুষ আইনি সহায়তা পেয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছেন। অসহায় নারীরা পুনর্বাসিত হয়ে ফিরে পাচ্ছেন তাদের সুখের দাম্পত্য জীবন ও সংসার।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বরাবরই লিগ্যাল এইড অনেক দক্ষতার সাথে কাজ করছে। করোনা ভাইরাসের সময় চার মাসে ১৫ হাজার বিচারপ্রার্থীকে আইনি সহায়তা দেয়া হয়েছে। এ সময় প্রায় তিন কোটি টাকা অসচ্ছল দরিদ্র মানুষকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেয়া হয়। নিষ্পত্তি করা হয়েছে চার হাজার মামলা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রান্তিক অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জন্য লিগ্যাল এইডসেবা খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখছে। তবে কিছু জেলায় এখনো লিগ্যাল এইডের কার্যক্রম আশানুরূপ নয়। এক্ষেত্রে তাদের কাজের পরিধি আরও বাড়াতে হবে। আর বিনামূল্যে যে আইনি সহায়তা পাওয়া যায় গ্রামাঞ্চলের অনেকেই সেটা জানে না।

তাই জেলা-উপজেলায় লিগ্যাল এইড সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে। তাছাড়া লিগ্যাল এইড আইনজীবীরা যেকোনো মামলা বেশ সফলতার সাথে শেষ করেন। এখানে মামলা হারের সংখ্যা কম, তাই সঠিক সেবাই পাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।

আজ ২৮ এপ্রিল। জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে— বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে নিশ্চিত করেছে শেখ হাসিনার সরকার। সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস, চৌকি আদালত বিশেষ কমিটি, শ্রম আদালত বিশেষ কমিটি, উপজেলা ও ইউনিয়ন লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন ও সক্রিয়করণের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসগুলোতে একজন করে সিনিয়র সহকারী জজ/সহকারী জজ পদমর্যাদার বিচারককে লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। মামলাজট কমানোর লক্ষ্যে লিগ্যাল এইড অফিসগুলোকে ‘এডিআর কর্নার’ বা ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কেন্দ্রস্থল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। লিগ্যাল এইড কার্যালায়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ মার্চ পর্যন্ত বিনামূল্যে সরকারের আইনি সেবা পেয়েছেন ৬ লাখ ৭ হাজার ৮৮০ জন। এরমধ্যে ৬৪টি জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির মাধ্যমে ২ লাখ ৮৯ হাজার ৯৬৮ জনকে সরকারি খরচে মামলা দায়ের ও আইনজীবী নিয়োগসহ সকল ব্যয় নির্বাহ করা হয়েছে। সহায়তাপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণের মধ্যে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪১১ জন নারী ও ১ লাখ ৪২ হাজার ৪১৫ জন পুরুষ এবং ১১৪২ জন শিশু।

বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কার্যক্রম : লিগ্যাল এইড জুলাই ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত সর্বমোট প্রাপ্ত ৪৭ হাজার ১২৮টি বিরোধ ও মামলার মধ্যে ৪১ হাজার ২টি বিরোধ/ মামলা বিকল্প পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করেছে এবং উপকারভোগীদের ৫৭ কোটি ৯ লাখ ১৫ হাজার ২৬৮ টাকা টাকা আদায় করে দিতে সক্ষম হয়েছে। ১ হাজার ৩৩৪ টি মোকদ্দমা বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির ফলে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

কারাবন্দিদের আইনগত সহায়তা : জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা ২০১২ সাল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত কারাগারে আটকে থাকা ৮৫ হাজার ৭৫১ জন অসহায় কারাবন্দিকে সরকারি আইনগত সহায়তা প্রদান করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। এ বিষয়ে জাতীয় আইনগত প্রদান সংস্থার পরিচালক (জেলা জজ) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মহামারি করোনার সময় আমরা বসে নেই। এই দুঃসময়ে অসহায় মানুষকে আইনি সেবা দিতে ২৪ ঘণ্টা হেল্পলাইন কলসেন্টার খোলা রাখা হয়েছে। তিন শিফটে আমাদের কর্মীরা সারাক্ষণ কাজ করছেন।’ তিনি বলেন, ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে আইনি সেবা/পরামর্শ ও তথ্য সেবা দেয়া হচ্ছে। প্রান্তিক অঞ্চলে লিগ্যাল এইড কার্যক্রম কীভাবে চলছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা, সাতক্ষীরা জেলা কমিটির চেয়ারম্যান এবং সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ শেখ মফিজুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, আমাদের জেলায় লিগ্যাল এইড কার্যক্রম অত্যন্ত সফলতার সাথে চলছে। করোনার সময়ও আমরা বিচারপ্রার্থীদের সেবা দিচ্ছি এবং সেবা কার্যক্রম কীভাবে চালু রাখা যায় সে বিষয়ে প্যানেল আইনজীবীদের নিয়ে আমরা একাধিকবার সেমিনারও করেছি। একটি বিষয় আপনি জেনে থাকবেন, আমরা সাতক্ষীরা লিগ্যাল এইড অফিস থেকে সেবা নিতে আসা অসহায়-অসচ্ছল বিচারপ্রার্থীদের বিনামূল্যে আইনি সহায়তার পাশাপাশি দুপুরে খাওয়া ও যাতায়াত খরচও দিচ্ছি যেটা দেশে আমরাই প্রথম নিজস্ব ফান্ড গঠন করে সেখান থেকে খরচ করছি। জেলাপর্যায়ে সবাই সঠিক সেবা পাচ্ছে কেউ কোনোভাবে সেবা বঞ্চিত হচ্ছে না। সেবা দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। অনেক বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিও আমরা করে দিচ্ছি। আর আমাদের বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ফলে মামলাজটও অনেকটা কমছে। আমরা জেলা-উপজেলা ও গ্রামপর্যায়ে বিনামূল্যে আইনি সেবা পাওয়া যায় সে বিষয়টি সাধারণ মানুষকে জানাচ্ছি। গুরুত্বসহকারে এক্ষেত্রে প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। আর এখানে সবচেয়ে বেশি পারিবারিক কলহ, নারী নির্যাতন ও জমিজমা-সংক্রান্ত সমস্যা নিয়েই মানুষ আসে, আমরাও তাদের পরামর্শ দেই নিজেরা বিবাদ মিটিয়ে ফেলার জন্য আর এতে কাজও হচ্ছে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, অনেক আগে গ্রামাঞ্চলে লোকজন যথাযথ আইনি সেবা থেকে বঞ্চিত থাকতো কিন্তু লিগ্যাল এইড বিনামূল্যে আইনি সেবা নিয়ে সেসব মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে এটা একটি ভালো দৃষ্টান্ত। প্রতিদিনই জেলা লিগ্যাল এইডের মধ্যে কেউ সংসার, ঘরবাড়ি, নগদ অর্থসহায়তা বা অধিকার ফিরে পাচ্ছে। তবে এখনো বিনামূল্যে যে সরকারি আইনি সেবা পাওয়া যায় সেটা অনেকে জানে না। তাই লিগ্যাল এইড সম্পর্কে অধিক প্রচারণা চালাতে হবে। তাহলে সেবাগ্রহীতার সংখ্যা আরও বাড়বে।

অনলাইনেও সরব লিগ্যাল এইড : এছাড়া ‘ডিজিটাল লিগ্যাল এইড’ সেবা প্রদানের জন্য ২০১৮ সালের অক্টোবরে ‘বিডি লিগ্যাল এইড’ নামে একটি অ্যাপ চালু করা হয়। এতে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে অ্যাপটির সাহায্যে ঘরে বসেই বিনা খরচে আইনি সহায়তা পাচ্ছেন অসহায় ও অসচ্ছল বিচারপ্রার্থীরা। গুগল প্লে-স্টোর থেকে ‘ইফ ষরমধষ অরফ’ নামের অ্যাপ্লিকেশনটি স্মার্টফোনে ইনস্টলের পর সহজেই বাংলা বা ইংরেজি ভাষায় এটি ব্যবহার করা যায়। অ্যাপটি খোলার সাথে সাথেই বিনামূল্যে আইনি সহায়তা পাওয়ার হেল্পলাইন নম্বর ‘১৬৪৩০’ দেখা যায়। নম্বর মনে রাখার ঝামেলা এড়াতে এখান থেকে লিগ্যাল এইড অফিসে ফোন বা মেসেজ পাঠিয়ে আইনি সহায়তা চাওয়া ও পাওয়া যায়।

আমারসংবাদ/জেআই