Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ

মো. আকতারুল ইসলাম

এপ্রিল ২৭, ২০২১, ০৮:৫০ পিএম


শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ
  • নরাপদ কর্মপরিবেশ শ্রমিকের অধিকার। চলমান বৈশ্বিক মহামারির এসময়ে বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। করোনা মোকাবিলায় গত বছর করোনা মহামারির শুরুতেই শ্রম মন্ত্রণালয় সারা দেশে মাঠপর্যায়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, মালিক এবং শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ২৩টি বিশেষ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটি গঠন করে। এ বছর করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার লক্ষ্যে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চত করে উৎপাদন সচল রাখতে কমিটিগুলো বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কমিটির সদস্যগণ আইএলও এর সহযোগিতায় তৈরি করা পেশাগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা নির্দেশিকা এবং সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক পোস্টার কারখানা পর্যায়ে বিলি করছে। এর সাথে শ্রমিকদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে  স্থানীয় প্রশাসনের সাথে আলোচনা করে শ্রমঘন এলাকায় মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন

‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, নিরাপদ কর্মপরিবেশ হোক সবার’— এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ২৮ এপ্রিল পালিত হচ্ছে জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি দিবস। কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পেশাগত স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্বাস্থ্য ও সেইফটি নীতিমালা-২০১৩ এর নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১৬ সাল থেকে জাতীয়ভাবে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর এবং জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষে’ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ ঘোষণার মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ একটি প্রত্যয়ী ও মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। এদিকে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট-৮ অনুযায়ী সকলের জন্য পূর্ণাঙ্গ ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান ও শোভন কর্মপরিবেশ সৃষ্টি এবং স্থিতিশীল অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন আমাদের লক্ষ্য। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে বিষয়গুলো আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। টেকসই উন্নয়নের জন্য টেকসই, শোভন এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টি তথা নিরাপদ শিল্পায়নের কোনো বিকল্প নেই। টেকসই উন্নয়নের অগ্রযাত্রার লক্ষ্যে জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি দিবসে এটিই এবারের প্রতিপাদ্য।

২০১৩ সালের রানা প্লাজা দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সরকার ২০১৩ সালে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ২০০৬ সালের বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধন করে কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটিসংশ্লিষ্ট ধারাগুলো যুগোপযোগী করে। সরকার ঐ বছরই কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটির গুরুত্ব, স্টেকহোল্ডারদের ভূমিকা ও দায়িত্ব স্পষ্ট করে জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে কারখানা পরিদর্শন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সময়ের চাহিদায় মাত্র নয় মাসের মধ্যে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন পরিদপ্তরকে অধিদপ্তর করা হয়। বিগত ৮ বছরে এ অধিদপ্তরে হাজারের বেশি জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তার বিষয়ে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। কারখানার কর্মপরিবেশ, শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক স্থাপন, শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শ্রমিকের অধিকার আদায়ে সর্বোপরি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে উৎপাদন বৃদ্ধিতে কলকারখানা অধিদপ্তর অপরিহার্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কলকারখানা পরিদর্শন কার্যক্রমে গতিশীলতা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা আনয়নের জন্য লেবার ইন্সপেকশন ম্যানেজমেন্ট এপ্লিকেশন- লিমা অ্যাপস চালু করা হয়েছে। টোলফ্রি হেল্পলাইন চালু করা হয়েছে। প্রতিটি কারখানায় সেইফটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। শ্রম পরিদর্শকরা মালিক-শ্রমিকের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে। সম্প্রতি ট্যানারি, গ্লাস, সিরামিক, জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানিমুখী চামড়াজাতশিল্প ও পাদুকা এবং রেশম— এ ৬টি সেক্টরকে শিশুশ্রমমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের আশা করছে মন্ত্রণালয়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি এবং নারী শ্রমিকদের সামাজিক মূল্যায়ন ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অতি জরুরি। অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫ হাজার ৫৫৭টি কলকারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে।

শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি নিশ্চিতের জন্য রাজশাহীতে মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব ১৯ বিঘা জমির ওপর ১৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা এবং প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের নির্মাণ কাজ শেষপর্যায়ে। এ ইনস্টিটিউটের কাজকে সহজ করতে মন্ত্রণালয় ২০২০ সালে দেশে প্রথমবারের মতো পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি- ওএসএইচ প্রোফাইল তৈরি করছে এই প্রোফাইল দেশের শিল্প-কারখানার প্রকৃত অবস্থা জানার প্রামাণ্য দলিল। এর মাধ্যমে শিল্প সেক্টরের অগ্রগতির একটি ধাপ এগিয়ে গেলো। এ প্রোফাইল দেখেই কারখানার কর্মপরিবেশ স্বাস্থ্য, নিরাপত্তার উন্নতি, অগ্রগতির চিত্র পাওয়া যাবে এবং এর প্রেক্ষিতে পদক্ষেপ গ্রহণ সহজ হবে।

নিরাপদ কর্মপরিবেশ শ্রমিকের অধিকার। চলমান বৈশ্বিক মহামারির এসময়ে বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। করোনা মোকাবিলায় গত বছর করোনা মহামারির শুরুতেই শ্রম মন্ত্রণালয় সারা দেশে মাঠপর্যায়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, মালিক এবং শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ২৩টি বিশেষ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটি গঠন করে। এ বছর করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার লক্ষ্যে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চত করে উৎপাদন সচল রাখতে কমিটিগুলো বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কমিটির সদস্যগণ আইএলও এর সহযোগিতায় তৈরি করা পেশাগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা নির্দেশিকা এবং সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক পোস্টার কারখানা পর্যায়ে বিলি করছে। এর সাথে শ্রমিকদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে আলোচনা করে শ্রমঘন এলাকায় মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন।

করোনাকালীন শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে উৎপাদন ব্যবস্থা সচল রাখতে সরকারের পদক্ষেপ বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় আমরা সকলে মিলে করোনা মহামারি সক্ষমতার সঙ্গে মোকাবিলা করছি। আমার মন্ত্রণালয়ের অধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর থেকে প্রণীত কর্মক্ষেত্রে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে পেশাগত সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক নির্দেশিকা কারখানাপর্যায়ে বিতরণ করা হয়েছে। এ নির্দেশিকা অনুযায়ী অধিদপ্তরের পরিদর্শকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনাকালীন বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এ অধিদপ্তরের চিকিৎসকগণের মাধ্যমে টেলিমেডিসিনসেবা প্রদান কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এম আব্দুস সালাম বলেন, গত ১৮ তারিখে নিজে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শককে সাথে করে ঢাকা এবং গাজীপুর অঞ্চলের কয়েকটি গার্মেন্ট পরিদর্শন করেছি। করোনার অতি সংক্রমণের এসময় আমাদের সহকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে নিরলস কাজ করছেন। তারাও ফ্রনটলাইনার। তাদের সেফটিও দেখা দরকার।

মূলত বৈশ্বিক মহামারির এসময় মালিক এবং শ্রমিকদের পারস্পরিক সহযোগিতায় কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সেইফটির বিষয়ে সচেতনতা আরও বৃদ্ধি পেলে শ্রমিকদের নিরাপদ রেখে কারখানার উৎপাদন অব্যাহত রাখা এবং দেশের অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল করা সম্ভব হবে। মুজিববর্ষে করোনাকালীন ‘জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি দিবসে’ এইটুকু প্রত্যাশা।

লেখক : তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা

আমারসংবাদ/জেআই