Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

হাইকোর্টে আগাম জামিন বন্ধ

এপ্রিল ২৯, ২০২১, ০৮:১৫ পিএম


হাইকোর্টে আগাম জামিন বন্ধ
  • জামিন ঠেকাতে মধ্যরাতে ৫০ আইনজীবীর সমন্বিত প্যানেল গঠন
  • ওই আগাম জামিনটা কার্যতালিকায় ভুল করে এসেছে : হাইকোর্ট
  • অনির্দিষ্টকালের জন্য আগাম জামিন বন্ধের নোটিস জারি
  • বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ ছাড়া আপাতত উপায় নেই -বলছেন আইনজীবীরা

গুলশানে ভাড়া বাসায় তরুণীর মৃতদেহ উদ্ধার। পরে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে গুলশান থানায় মামলা দায়ের। আসামি করা হয় বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরকে। জামিন পেতে গত ২৮ এপ্রিল হাইকোর্টে আগাম জামিন আবেদন। এমনকি আবেদনটি গতকাল শুনানির জন্য বিচারপতি মামনুন রহমানের বেঞ্চের কার্যতালিকায় ১৪ নাম্বারে রাখাও হয়। তবে আলোচিত এই ব্যবসায়ীর উচ্চ আদালতে জামিন চেয়ে আবেদনের পরই সমালোচনার ঝড় বইতে থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সমালোচনায় সরব হন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরাও। জামিন ঠেকাতে গতকাল মধ্যরাতেই সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্নার নেতৃত্বে অন্তত ৫০ জন আইনজীবীর সমন্বিত প্যানেল গঠন করা হয়। শুনানিতে ভার্চুয়ালি যুক্ত থাকতে নেয়া হয় প্রস্তুতি। যুক্ত থাকার কথা বিজ্ঞ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, ব্যারিস্টার অনিক আর হক ও অ্যাডভোকেট জেসমিনের। তবে নানা সমালোচনা ও আইনজীবীদের জামিনের বিপক্ষে সোচ্চার ভূমিকায় অজ্ঞাত কারণে আবেদনের ওপর শুনানি করেননি হাইকোর্ট— এমনটিই মনে করছেন আইনজীবীরা।

এদিন সকালেই আদালতের দরজার সামনে স্বাক্ষর ও তারিখবিহীন একটি নোটিস টানানো হয়। সেখানে জানানো হয়, করোনা নিয়ন্ত্রণে চলা লকডাউনে আগাম জামিনের আবেদন পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত শুনানি করবে না আদালত। এদিকে নিয়মিত মামলার শুনানিতে সিনিয়র অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন আদালতের কার্যক্রমের শুরুতে আগাম জামিনের বিষয়টি উল্লেখ করলে ওই আগাম জামিন শুনানিটা কার্যতালিকায় ভুল করে এসেছে বলে জানান হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে এখতিয়ার না থাকা সত্ত্বেও কার্যতালিকায় থাকা এ আগাম জামিন আবেদনের মামলা ডিলেট করে দেয়া হবে বলে মন্তব্য করেন আদালত। গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। ফলে আদালতকে এখতিয়ার না দেয়া পর্যন্ত হাইকোর্টে কোনো আগাম জামিন আবেদনের শুনানি করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

আদালত আরও বলেন, করোনা পরিস্থিতি ও লকডাউন চলা অবস্থায় আগাম জামিনের আবেদন আর শুনবো না। যেগুলো কজলিস্টে আগাম জামিনের শুনানির জন্য রাখা হয়েছিল সেটা অনভিপ্রেত। সেগুলো ডিলিট করে দেয়া হবে। শুধু ৪৯৮ ধারার (ফৌজদারি কার্যবিধির) আবেদন শুনবো। পেন্ডিং আপিলের জামিন আবেদন শুনবো না। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা জানান, আগাম জামিন আবেদন শুনানি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের নোটিস দিয়েছেন হাইকোর্ট। কার্যতালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে বসুন্ধরার এমডির আবেদন। যে আদালতে আগাম জামিন আবেদন করা হয়েছিল সকালে সেই ১৯ নাম্বার কোর্টে ভার্চুয়ালি অর্থাৎ জুমে অন্তত পাঁচ শতাধিক আইনজীবী যুক্ত হয়েছিলেন। জামিনের পক্ষে-বিপক্ষের। হাইকোর্টের একটি মাত্র বেঞ্চেই আগাম জামিন আবেদন করা যেতো গতকাল বিচারপতিদের সম্মতিক্রমে সেটাও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হলো। তাই সায়েম সোবহানের জন্য আর মাত্র একটি দরজা খোলা রইলো। সেটা হলো বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করা। এছাড়া আপাতত আর কোনো উপায় নেই। বিচারিক আদালত ঘুরেই তাকে প্রক্রিয়া অনুযায়ী উচ্চ আদালতে আসতে হবে।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জামিউল হক ফয়সাল বলেন, উচ্চ আদালতে আগাম জামিনের সুযোগ ছিলো। তবে যে কারণেই হোক আজকে যেহেতু আগাম জামিনের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেলো তাই এখন অভিযুক্তের নিম্ন আদালতে আত্মসর্পণ করে জামিন চাইতে হবে। তখন জামিন মঞ্জুর হলে ভালো কথা তবে যদি নামঞ্জুর হয় তখন সে আবার উচ্চ আদালতে আসতে পারবেন।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, হাইকোর্টে যে কেউ আগাম জামিন চাইতে পারে তার মানে সে অপরাধ করে ফেলেছে এমন নয়। আগে পুলিশ প্রতিবেদন আসতে হবে এবং সেখানে সে যদি অপরাধী হয় তখন তার নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হবে। তারপরে জামিন চাইতে হলে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে জামিন চাইতে হবে।

গতকাল সায়েম সোবহান আনভীরের পক্ষে আদালতে শুনানি করার কথা ছিলো ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ বিচারপতি (অব.) মনসুরুল হক চৌধুরী, সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও সিনিয়র আইনজীবী এ এফ এম মেজবাহ উদ্দিনের। এ বিষয়ে জানার জন্য ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ বিচারপতি (অব.) মনসুরুল হক চৌধুরীর মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

এদিকে মুনিয়ার আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলায় মৃতের পরিবারকে বিনা খরচে আইন সহায়তা করার ঘোষণা দিয়েছেন ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। ব্যারিস্টার সুমন বলেন, ‘তার বাবা-মা কেউ পৃথিবীতে নেই। এই এতিম মেয়ের জন্য আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যদি এর চেয়ে ভালো আইনজীবী না পান তাহলে আমি তার পক্ষে দাঁড়াতে চাই। তার পরিবারকে আমি আইনি সহায়তা দিতে চাই।’ এই ঘটনায় আসামির বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এই নেতা।

প্রসঙ্গত, শিল্পপতি এবং বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীর এখন আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলার পলাতক আসামি। তার দেশত্যাগেও আদালত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ২৬ এপ্রিল (সোমবার) রাতে গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে ওই তরুণীর মরদেহ উদ্ধারের পর দায়ের হওয়া মামলায় আসামি করা হয় বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরকে। মামলায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ আনা হয়। ঘটনার দিন রাতেই মুনিয়ার বোন নুসরাত বাদি হয়ে গুলশান থানায় মামলাটি করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয়ের পর ২০১৯ সালে আনভীর মুনিয়াকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে বনানীতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আনভীরের পরিবার মুনিয়ার সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্কের কথা জানতে পারে। তখন আমার বোনকে (মুনিয়াকে) আনভীরের জীবন থেকে সরে যাওয়ার জন্য হুমকি দেন তার মা। এ ঘটনার পর আনভীর মুনিয়াকে কৌশলে কুমিল্লায় পাঠিয়ে দেন এবং পরে বিয়ে করবেন বলে আশ্বাস দেন। গত মাসের (মার্চ) ১ তারিখে গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর বাসার বি/৩ ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেন আনভীর। ১ মার্চ থেকে মুনিয়া সেই ফ্ল্যাটেই ছিলেন এবং আনভীর মাঝে মাঝে ওই ফ্ল্যাটে আসা-যাওয়া করতেন। গত শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) ফ্ল্যাট মালিকের বাসায় ইফতার পার্টিতে গিয়ে মুনিয়া ছবি তোলেন। ফ্ল্যাট মালিকের স্ত্রী ফেসবুকে সেই ছবি পোস্ট করলে সেটি আনভীরের পরিবারের একজন দেখে ফেলেন এবং আনভীরকে জানান। বিষয়টি নিয়ে আনভীর মুনিয়াকে বকাঝকা করেন এবং হুমকি দেন। ২৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে মুনিয়া তার মোবাইল নম্বর থেকে নুসরাতকে ফোন করে কান্নাকাটি শুরু করেন। তিনি বলেন, আনভীর আমাকে বিয়ে করবে না, সে শুধু আমাকে ভোগ করেছে। এছাড়া আমাকে সে ‘মনে রাখিস তোকে আমি ছাড়ব না’ বলে হুমকি দিয়েছে। এজাহারে বলা হয়েছে, মুনিয়া নুসরাতের কাছে চিৎকার করে বলেন, ‘যেকোনো সময় আমার বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তোমরা তাড়াতাড়ি ঢাকায় আসো।’ মোসারাত জাহান মুনিয়া মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। সোমবার রাতে গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে তার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। গুলশান থানা সূত্রে জানা যায়, মুনিয়া নিহত হওয়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। বাড়ির মালিক, মালিকের মেয়ের জামাইসহ বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মামলা সংক্রান্ত বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন তারা। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করছে পুলিশ। সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেলেই অভিযুক্ত আনভীরকে গ্রেপ্তারের সিদ্ধান্ত নেবে পুলিশ।

মুনিয়া যে ফ্ল্যাটটিতে থাকতেন সেই ভবনের বেশকিছু সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজও ইতোমধ্যে সংগ্রহ করেছে পুলিশ। সেসব সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ওই ফ্ল্যাটে সায়েম সোবহান আনভীরের যাতায়াতের প্রমাণ পেয়েছে তারা। তবে ঘটনার দিন বা এর আগের দিন মুনিয়ার ফ্ল্যাটে আনভীরের যাতায়াতের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এছাড়া সিসিটিভি ফুটেজে এই দুই দিন সন্দেহজনক কারো যাতায়াত ওই বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাটে আশপাশে পাওয়া যায়নি।

আমারসংবাদ/জেআই