Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

বই থেকে দূরে শিক্ষার্থীরা

বেলাল হোসেন ও আবদুর রহিম

এপ্রিল ৩০, ২০২১, ০৮:৫০ পিএম


বই থেকে দূরে শিক্ষার্থীরা
  • শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ছে আড্ডায়, পাড়ায় পাড়ায় কিশোর গ্যাং
  • এলোমেলো চিন্তা, অনলাইনে আসক্তি, অস্বাভাবিক আচরণ
  • সোয়া তিন কোটি শিক্ষার্থীর জীবন ও ভবিষ্যৎ অন্ধকারে
  • প্রযুক্তির অভাবে অনলাইন ক্লাসও আলোর মুখ দেখেনি 
  • জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তায় কয়েক লাখ চাকরিপ্রত্যাশী

বই থেকে দূরে সরে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা! ক্লাস-পাঠ্যবইয়ের অধ্যয়ন ভুলতে বসেছে কয়েক কোটি শিক্ষার্থী। সৃষ্টি হয়েছে হতাশা। সন্তানদের জীবন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত অভিভাবকরা। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আড্ডায় জড়িয়ে পড়ছে অনেকে। পাড়ায় পাড়ায় তৈরি হচ্ছে কিশোর গ্যাং। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চোখ রাখা শিক্ষাবিদরা বলছেন, সারা দেশে লাখ লাখ শিক্ষার্থী অপ্রয়োজনীয় কাজে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে এলোমেলো চিন্তা ভর করছে তাদের মনে। সময় পার করতে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে এবং অনলাইনে গেমসে আটকে যাচ্ছে। একটুতেই মতের অমিল হলে তারা অস্বাভাবিক আচরণ করে বসছে।

কারণ দীর্ঘ ১৩ মাস শিক্ষার্থীরা বইয়ের ঘ্রাণ থেকে দূরে রয়েছে। ক্লাস নেই। ছোঁয়া পায়নি শিক্ষকের। সাময়িক কিংবা বার্ষিক পরীক্ষাও নেই। এ বছর হয়নি প্রাথমিক-ইবতেদায়ি সমাপনী, জেএসসি-জেডিসি, এইচএসসি-আলিম পরীক্ষাও। উচ্চ মাধ্যমিকসহ সবকটি শ্রেণিতে অটোপাস দিয়ে যুগের প্রতিযোগিতায় আছে সরকার। শুধু স্কুল-কলেজ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও একই দৃশ্যপট। সবকিছুকে ছাপিয়ে অন্ধকারের পর অন্ধকারে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। বড় আকারে লেগেছে সেশনজট। জীবন অনিশ্চয়তায় কয়েক লাখ চাকরিপ্রত্যাশী। কারো ঝুলে আছে অনার্স কারো বা মাস্টার্স।

এছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষ বিশেষ ব্যবস্থায় শেষ করলেও এখনো প্রতিষ্ঠানেও অনেকের পা রাখার সৌভাগ্য হয়নি। শ্রেণিকক্ষে না এসেই নয়ছয় করে অনলাইনে ইয়ার পার করে ফেলছে। করোনার কঠিন সময়ে অনলাইন কার্যক্রমে সরকার বেকআপ দেয়ার চেষ্টা করেও প্রযুক্তির অভাবে তা আর আলোর মুখ দেখা হয়নি। শহরের কিছু শিক্ষার্থী সূচনালগ্নে আগ্রহ দেখালেও কিছু সময়ের পর তাও ফিকে হয়ে যায়। গ্রামের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে প্রযুক্তির অভাবেই সম্পৃক্তই হতে পারেনি।

শিক্ষা নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে দূরশিক্ষণে (সংসদ টিভি, অনলাইন, রেডিও ও মোবাইল ফোন) ৩১.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। অর্থাৎ ৬৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো ধরনের অনলাইন শিক্ষার আওতায় আসেনি। যেসব শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণ প্রক্রিয়ার বাইরে রয়েছে তাদের মধ্যে ৫৭.৯ শতাংশ ডিভাইসের অভাবে অংশ নিতে পারছে না। আর গ্রামীণ এলাকায় এই হার ৬৮.৯ শতাংশ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনায় শিক্ষার ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি এবং সুদূরপ্রসারি। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকরাও নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন। তাই সার্বিক শিক্ষা পুনরুদ্ধারে সুচিন্তিত পরিকল্পনা নেয়া দরকার বলে মনে করেন তারা। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, শিক্ষা পুনরুদ্ধারের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু যেটা চলে গেছে সেটা উদ্ধার সম্ভব নয়। বরং এখন এই ধকল কাটিয়ে উঠতে অন্য দেশের অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে নিজস্ব প্রয়োজন ও বাস্তবতার নিরিখে উপযুক্ত পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। যদি একসঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা না যায়, তাহলে যেখানে যখন পরিস্থিতি উন্নতি হবে, সেখানে আগে খুলে দেয়া যেতে পারে। এটাই বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হতে পারে। গত বছর ৮ মার্চ দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ওই বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। দফায় দফায় তা বড়িয়ে আগামী ২২ মে পর্যন্ত প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করা হয়।  তবে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা সিদ্ধান্ত রয়েছে আগামী ২৪ মে। আর হলগুলো খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে ১৭ মে। তবে এ তারিখগুলোও ফের বর্ধিত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জানা যায়, দেশে প্রাথমিকে শিক্ষার্থী রয়েছে এক কোটি ৭৩ লাখ ৩৮ হাজার ১০০ জন। আর মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী রয়েছে এক কোটি তিন লাখ ৪৯ হাজার ৩২৩ জন। এ ছাড়া প্রাক-প্রাথমিক ও ইবতেদায়িতে আরো প্রায় ৪৫ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিন কোটির ওপরে। অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আছে আট লাখের মতো শিক্ষার্থী। প্রায় ১৩ মাস ধরেই এসব শিক্ষার্থী আছেন পড়াশোনার বাইরে। গণসাক্ষরতা অভিযানের (ক্যাম্পে) গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত সমীক্ষা বলছে, প্রায় ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণে অংশ নিয়েছে। ব্র্যাকের সমীক্ষা মতে, টেলিভিশন পাঠদানে ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। অর্থাৎ অন্তত অর্ধেক শিক্ষার্থীই দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের বাইরে। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণের অধীনে এসেছে। আর স্কুলশিক্ষকদের মাধ্যমে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে ৮৫ শতাংশকে লেখাপড়ার মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে।

করোনায় পেছালো ঢাবির ভর্তি পরীক্ষা : দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পেছানো হয়েছে। আগামী ২১ মে থেকে ৫ জুন পর্যন্ত পাঁচটি ইউনিটের অধীনে ভর্তি পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও পরিবর্তিত তারিখ অনুযায়ী পরীক্ষাগুলো হবে ৩১ জুলাই থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ভর্তি কমিটির এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধের কারণে শিক্ষাবিমুখ হয়ে আছে শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘদিন অনলাইনে ক্লাস হলেও হয়নি পরীক্ষা। যে কারণে সেশনজটের ভয়সহ নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরা যাতে হতাশ হয়ে না পড়ে সে জন্য শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে কাজ করতে হবে।’

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক তাহমিনা ইসলাম  বলেন, ‘করোনার কারণে আমাদের বসে থাকলে চলবে না। জীবন চলতে সবসময়ই কিছু না কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় আমাদের। করোনা ঠিক এতটুকুই বাধা আমাদের জন্য। এই সময়ে হাত-পা গুটিয়ে না থেকে নিজেদের উন্নতির সাধনে কাজ করতে হবে যাতে যেকোনো পরিস্থিতিতে অন্যদের থেকে আমরা এগিয়ে থাকতে পারি। যা আগামী সময়ে আমাদের ক্যারিয়ার গড়তে সহায়ক হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কল্যাণ ও পরামর্শ দান কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক ও মনোবিজ্ঞানী ইফরাত জামান বলেন, ‘মহামারি করোনা ভাইরাসের এই কঠিন সময়ে আবদ্ধ অবস্থায় দিন পার করছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। ফলে নানা রকম অপ্রয়োজনীয় কাজে জড়িয়ে পড়ছে। এলোমেলো চিন্তা ভর করছে তাদের মাথায়। সময় পার করতে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে আসক্তি হয়ে যাচ্ছে এবং অনলাইনে গেমসে আটকে যাচ্ছে। একটুতে একটু হলেই তারা অস্বাভাবিক আচারণ করে বসছে। যেটা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কারণেই ঘটছে। এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের সকলেই অধিক সচেতন হতে হবে।’ 

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন,  ‘চলমান সমস্যা বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের। প্রত্যেক জাতিই নিজস্ব সুবিধা ও পদ্ধতি অনুযায়ী উত্তরণের কার্যক্রম চালাচ্ছে। আমরাও করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকেই সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। দূরশিক্ষণ ও অনলাইন পদ্ধতিতে পাঠদান চলছে।’

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘করোনায় শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও সমাজের ওপর নানা দিক থেকে প্রভাব পড়ছে। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া, শিশুশ্রম, বাল্যবিয়ে এবং শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার এই পাঁচটির প্রত্যেকটি বেড়ে যাচ্ছে। করোনার ফলে শিক্ষার্থীরা দুই কারণে আর স্কুলে নাও ফিরতে পারে। প্রথমটি হচ্ছে— দীর্ঘ শিখন বিরতির কারণে একটি অংশ পাঠ না পারা ও বোঝার পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সম্ভাব্য দারিদ্র্যের কশাঘাতে নিপতিত হয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে অনেকেই কাজে জড়িয়ে পড়ছে। আমরা সরকারকে শঙ্কাগুলো জানিয়েছি। দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে আহ্বান জানাচ্ছি।’

আমারসংবাদ/জেআই