Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

ঘুরে দাঁড়াতে নেয়া হচ্ছে পরিকল্পনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

মে ৩, ২০২১, ০৮:১৫ পিএম


ঘুরে দাঁড়াতে নেয়া হচ্ছে পরিকল্পনা
  • করোনায় বিপর্যস্ত এভিয়েশন খাত
  • ঝুঁকিপূর্ণ হলেও বিমানবন্দরে মানা হচ্ছে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি

বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এভিয়েশন খাত। ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইএটিএ) দেয়া তথ্যে, বিমান খাতে করোনাজনিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৫ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ২০২০ সালে ১১ হাজার ৮৫০ কোটি ডলার ও ২০২১ সালে তিন হাজার ৮৭০ কোটি ডলার ক্ষতি প্রাক্কলন করা হয়েছে। আইএটিএর পূর্বাভাসে বলা হয়, ২০২০ সালে বিশ্বে মোট বিমানযাত্রীর সংখ্যা কমে ১৮০ কোটিতে নেমে আসে। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৪৫০ কোটি।

বিশ্বব্যাপী এভিয়েশন খাতের ক্ষতির বড় ধাক্কা বাংলাদেশেও লেগেছে। মহামারি শেষ হওয়ার পরও এভিয়েশন খাত স্বাভাবিক হতে এক থেকে দেড় বছর সময় লেগে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ইতোমধ্যে করোনা পরবর্তীতে খাতটিকে ঘুরে দাঁড় করাতে পরিকল্পনা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে অনুযায়ী বিমান মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) কাজ করছে বলে জানা গেছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনার চলমান দ্বিতীয় ধাপেও বিশ্বব্যাপী বড় ধরনের লোকসানে পড়তে যাচ্ছে খাতটি। গত মার্চ মাস থেকে এ পর্যন্ত সিভিল এভিয়েশনের রাজস্ব কমেছে কমপক্ষে ৪৫০ কোটি টাকা। এ লোকসানে বিমান কোম্পানিগুলোও পড়বে। চরম এ পরিস্থিতি খাতটি ধরে রাখতে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বেবিচক। বিমান পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ধরনের চার্জ মওকুফ করার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। আটকেপড়া প্রবাসীদের কর্মস্থলে ফিরে যেতে বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরীণ প্রতিটি বিমানবন্দরে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে। বাংলাদেশে আসা যাত্রীদের নন কোভিড সার্টিফিকেট যাচাই এবং কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা হচ্ছে।

বেবিচক সূত্র বলছে, ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এয়ারলাইন্সগুলোর কিছু অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ মওকুফের সিদ্ধান্ত প্রাথমিকভাবে নেয়া হয়েছে। এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে সরকার তাদের প্রণোদনা দেবে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও দ্রুত সময়ে পুরোদমে ফ্লাইট চলাচল চালু করা হবে।

বিশেষ ফ্লাইট এবং পুরোদমে চালু হলেও সবক্ষেত্রে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে। এজন্য ইতোমধ্যে একটি সার্কুলার জারি হয়েছে। চেক-ইন, ইনফ্লাইট সার্ভিস, ক্রুদের মুভমেন্টসহ নানা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। চেক-ইনের সময় কাউন্টার ও আশপাশের সহযোগীদের সার্বক্ষণিক মাস্ক, হ্যান্ড গ্লোভস, ডিস্পোজেবল ক্যাপ পরতে হবে। এছাড়া কাউন্টারের পাশে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখতে হবে। চেক-ইনের আগে যাত্রীর শরীরের তামপাত্রা মাপা হবে। তাপমাত্রা ৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট হলে তাকে বোর্ডিং পাস বা বিমানে ওঠার অনুমতি দেয়া হবে না। এছাড়া যাত্রীদের উড়োজাহাজে ওঠার আগে প্যাসেঞ্জার হেলথ কার্ড দেয়া হবে। কার্ডে তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। উত্তর সন্তোষজনক হলেই কেবল তারা ফ্লাই করতে পারবেন। প্রতিটি বিমানবন্দরে জীবাণুনাশক ছিটিয়ে জীবাণুমুক্ত করা হয়। ফ্লাইট ছাড়ার আগে উড়োজাহাজকেও জীবাণুমুক্ত করতে হবে। সবাইকে ফ্লাইট ছাড়ার আগে ‘সার্টিফিকেট অব ডিসইনফেকশন’ নিতে হচ্ছে। প্রতিবার জীবাণুমুক্তের পর বেবিচকের প্রতিনিধিরা প্রক্রিয়াটি দেখে সার্টিফাইড করেন, এরপরই ফ্লাইট আকাশে উড়ে।

বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান যোগদান করার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির কাজে নতুন গতি আসে। দক্ষতা কাজে লাগিয়ে বেবিচকের প্রতিটি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেছেন তিনি। চেয়্যারম্যানের নানা উদ্যোগ এবং কঠোর নির্দেশনায় করোনার প্রথম সংকটকালীন সময়ে এবং চলমান সংকটেও ঝুঁকি নিয়েই মাঠে কাজ করছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে পণ্য পরিবহনসহ নানা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন তিনি। সময়ে সময়ে নেয়া পদক্ষেপের কারণে করোনা সংক্রমণ রোধেও তার ভূমিকা প্রশংসা পেয়েছে। করোনা সংকট উপেক্ষা করে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে নেয়া হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ দৃশ্যমান হচ্ছে। দীর্ঘদিনের কাঙ্ক্ষিত আধুনিক টার্মিনাল নির্মাণের মধ্য দিয়ে পুরো খাত ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করছেন এভিয়েশন খাত সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সূত্র মতে,  করোনা দুর্যোগ উপক্ষো করেই পরিকল্পনা মোতাবেক এগিয়ে চলছে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ। কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী মার্চে প্রকল্পের ১১ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার কথা। মার্চ পর্যন্ত ১৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। যার কারণে যথাসময়ে নির্মাণ সম্পন্ন এবং ব্যবহারের উন্মুক্ত করার ব্যাপারে আশাবাদী প্রতিষ্ঠানটি।

শুধু তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প নয়, পুরো এভিয়েশন খাতে মানা হচ্ছে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি। বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ সেক্টর হলো বিমানবন্দরগুলো। চরম ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো থেকে ভাইরাসটি যেনো দেশে আসতে না পারে সেজন্য প্রতিটি বিমানবন্দরে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি এবং সতর্কতা মানা হচ্ছে।  বেবিচক সূত্র জানায়, তৃতীয় টার্মিনাল হবে স্বয়ংক্রিয়। পাঁচ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটারের এ টার্মিনালে একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ রাখার অ্যাপ্রোন (প্লেন পার্ক করার জায়গা) থাকছে। টার্মিনালের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন দিকটি হচ্ছে এর অত্যাধুনিক ভবন। দুই লাখ ৩০ হাজার স্কয়ার মিটারের এ ভবনের ভেতরে থাকছে অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তির ব্যবহার। টার্মিনাল ভবনের ভেতরে মেট্রোরেল সংযোগ, সেলফ চেক-ইন, ই-গেট, স্ট্রেইট এসকেলেটর (সমতল লিফট), তিন ধরনের অত্যাধুনিক ব্যাগেজ বেল্ট, বেবি কেয়ার, চিলড্রেন প্লে এরিয়া, ফার্স্ট এইড, মুভি লাউঞ্জ, ফুড কোর্ট, ওয়াইফাই সুবিধা থাকছে। এছাড়া থাকছে ২৭টি ব্যাগেজ স্ক্যানিং মেশিন ও ১১টি বডি স্ক্যানার। টার্মিনাল ভবনের ভেতরে মেট্রোরেল সংযোগ, সেলফ চেক-ইন, ই-গেট, স্ট্রেইট এসকেলেটর (সমতল লিফট), তিন ধরনের অত্যাধুনিক ব্যাগেজ বেল্ট, বেবি কেয়ার, চিলড্রেন প্লে এরিয়া, ফার্স্ট এইড, মুভি লাউঞ্জ, ফুড কোর্ট, ওয়াইফাই সুবিধা থাকছে। এছাড়া থাকছে ২৭টি ব্যাগেজ স্ক্যানিং মেশিন ও ১১টি বডি স্ক্যানার। তৃতীয় টার্মিনালের উত্তর পাশে আলাদা আমদানি-রপ্তানি কার্গো ভিলেজ ভবন নির্মাণ হবে। এছাড়া থার্ড টার্মিনালে দুই লাখ ২৬ হাজার বর্গমিটারের তিন ফ্লোরবিশিষ্ট একটি মডার্ন প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ভবন থাকবে। বর্তমানে বছরে ৬৫ লাখ যাত্রী বিমানবন্দরের ১ ও ২ নম্বর টার্মিনাল ব্যবহার করেন। তৃতীয় টার্মিনাল হলে এ সংখ্যা বেড়ে এক কোটি ২০ লাখে দাঁড়াবে।

বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ প্রধানমন্ত্রীর প্রাধিকার প্রকল্প। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আমি নিজেই তত্ত্বাবধান করছি। প্রতি সপ্তাহেই নির্মাণকাজে নিয়োজিত প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে যোগাযোগ করছি। বিভিন্ন বিষয়ে তাদের ব্রিফ করছি। প্রকল্পটি সঠিক সময়ে শেষ করতে নিয়মিত সকল নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছি। সার্বিক বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সাহায্য নিশ্চিত করেছি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, সচিবসহ সবার কাছ থেকেই আশানুরূপ সহযোগিতাও পাচ্ছি।

তিনি বলেন,  এ প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ অন্যান্য দপ্তর সিভিল এভিয়েশনকে যথাযথ সাহায্য করছে। যে কারণে প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট। প্রকল্পটির সুষ্ঠুভাবে নির্দিষ্ট মেয়াদে শেষ করার বিষয়ে আমি আত্মবিশ্বাসী। এ প্রকল্পটির কাজ সঠিকভাবে শেষ করতে পারলেই একটি আধুনিক দৃষ্টিনন্দন বিমানবন্দরে রূপান্তর হবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমাবন্দর। যা দেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রাকে বেগবান করতে সমর্থ হবে।

সূত্র মতে, ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেক। ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কাজের উদ্বোধন করেন। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালের জুনে অত্যাধুনিক এ টার্মিনাল ব্যবহার করতে পারবেন বাংলাদেশে আসা সব বিমানযাত্রী। অত্যাধুনিক এ টার্মিনাল নির্মাণে কাজ করছে স্যামসাং গ্রুপের কনস্ট্রাকশন ইউনিট স্যামসাং কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ট্রেডিং (সিঅ্যান্ডটি) কর্পোরেশন। এর আগে প্রতিষ্ঠানটি দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা, কুয়ালালামপুরের পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, তাইপে ১০১, সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরের চার নম্বর টার্মিনাল নির্মাণ করেছে। এর ব্যয় প্রথমে ধরা হয়েছিল ১৩ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। পরে প্রকল্পের ব্যয় সাত হাজার ৭৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বাড়ানো হয়। নির্মাণকাজে পাঁচ হাজার কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার এবং বাকি টাকা অর্থায়ন করছে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেন, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে বিশ্বজুড়েই বিমান ও পর্যটন খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।  এই ক্ষতির প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। তবে আমাদের চেষ্টার ত্রুটি নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী বিমান ও পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে আমাদের কাজ চলমান রয়েছে।

তিনি বলেন, করোনার কারণে বিশ্বজুড়ে লকডাউনের কারণে যখন সবকিছু থমকে গিয়েছিল, তখনো আমাদের এয়ারলাইন্স ও বিমানবন্দরে কর্মরতরা নিরলস কাজ করেছেন। দেশ ও জনগণের স্বার্থে জীবনকে তুচ্ছ করে দায়িত্ব পালন করতে তারা দ্বিধাবোধ করেননি।

আমারসংবাদ/জেআই