Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

অন্তহীন ভোগান্তিতে জমি মালিকরা

মে ৪, ২০২১, ০৭:৩০ পিএম


অন্তহীন ভোগান্তিতে জমি মালিকরা
  • ৪৩ ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা প্রায় সাড়ে ৩ লাখ
  • রায় বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসন মোটেও আন্তরিক নয় —দাবি আইনজীবীদের
  • সরকারি কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা ও আদালতে দীর্ঘসূত্রতায় জট বাড়ছে
  • আপিলের সুযোগ না থাকা চরম হয়রানিমূলক —বলছেন বিশেষজ্ঞরা

জমিজমাসক্রান্ত বিরোধের শেষ নেই। শেষ নেই মামলা মোকদ্দমারও। দেশের ৭০ শতাংশ ফৌজদারি অপরাধ সংগঠিত হয় ভূমিকেন্দ্রিক বিরোধের জেরে। জমি মালিকানা শনাক্তে সিএস, আরএস, এসএ এবং বিএস খতিয়ান রয়েছে। এসব খতিয়ানের মধ্যে সর্বশেষ করা বিএস ভুলেভরা। একজনের জমি রেকর্ড হয়েছে আরেকজনের নামে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মালিকের নাম ও জমির পরিমাণ ভুল উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও কোথাও আবার জমির দাগ নাম্বারও ভুলভাবে রেকর্ড করা হয়েছে। ফলে খতিয়ানে ভুল থাকায় জমি কেনা-বেচায় নানারকম জটিলতা দেখা দিচ্ছে। অন্তহীন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে জমি মালিকদের।

কিন্তু এসব জটিলতা নিরসনে সরকার ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও পদে পদে রয়েছে নানা রকম বিড়ম্বনা। নানা প্রকার হয়রানিতে দিশাহারা ভূমি মালিকরা। ভুল ঠিক করতে লাখ লাখ রেকর্ড সংশোধনের মামলাও চলমান। তবে এসব মোকদ্দমা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ঝুলে আছে যুগের পর যুগ ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে। মূলত সরকারি কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা, আদালতে দীর্ঘসূত্রতা সেই সাথে প্রয়োজনীয় বিচারকের অভাবে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির যেন শেষ নেই। ২০১২ সালে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল হলেও ১০ বছরেও গঠন হয়নি আপিল ট্রাইব্যুনাল। এতে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে প্রতিকার চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ বিচারপ্রার্থীরা।

এমনই একজন রাজধানীর কুড়িল এলাকার বাসিন্দা রুহুল আমিন ২০০৯ সালে ঢাকার ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। ১০ বছর ধরে চলছে মামলা। এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। রুহুল আমিন বলেন, তার পৈতৃক জমি অন্যের নামে রেকর্ড হয়ে গেছে। মামলা এখন সাক্ষী পর্যায়ে। ১০ বছর ধরে দৌড়াদৌড়ি করছি, ভোগান্তির শেষ নেই। মামলা থাকায় জমি নিয়ে কিছু করাও যাচ্ছে না।’

এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু জরিপ ট্রাইব্যুনালই নয়, সেইসাথে আপিল ট্রাইব্যুনাল থাকাও বাধ্যতামূলক। কিন্তু আপিলের সুযোগ না থাকা চরম হয়রানিমূলক বিষয়। দ্রুত আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত। এছাড়া বিদ্যামান আইনে ট্রাইব্যুনালের রায়ে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে আপিল করার জন্য হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে ভূমি জরিপ আপিল ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করার কথা বলা হয়। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ নানা কারণে ভূমি জরিপ আপিল ট্রাইব্যুনাল আর স্থাপন করা হয়নি। ফলে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের রায়, ডিক্রি এবং আদেশে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে তার প্রতিকার পেতে বিচারপ্রার্থীদের হাইকোর্টে রিট করতে হয়। এছাড়া এক-একটি মামলা শুনানির তারিখ ধার্য করতে হচ্ছে ছয় মাস থেকে এক বছর পরপর। এতে মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হচ্ছে। বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগও বাড়ছে। এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে এই প্রতিবেদন দেয়া হলেও কোনো কাজ হয়নি।

আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ট্রাইব্যুনালের রায় বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসন মোটেও আন্তরিক নয়। তাদের অসহযোগিতার কারণে রায়-ডিক্রি বাস্তবায়ন থমকে আছে। এতে নিজেদের পক্ষে রায় পেলেও বাস্তবায়ন দেখতে পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। নিয়মানুযায়ী ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার পর ৩০ দিনের মধ্যে তা বাস্তবায়নের কথা। কিন্তু রায় কার্যকর করতেও গড়িমসি। জেলা প্রশাসনের গাফিলতিই এ জন্য দায়ী।

সুপ্রিমকোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত সারা দেশের ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালগুলোয় বিচারাধীন মামলা ৩ লাখ ১৪ হাজার ৪০৯টি। এর মধ্যে পাঁচ বছরের ওপরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৫ হাজার ৮০৭টি। উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে ১৯৩টি মামলার বিচার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল আইন হওয়ার দীর্ঘ ১৬ বছর পর আপিল ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারকদের এ আপিল ট্রাইব্যুনালের বিচারিক এখতিয়ার দিতে আইন সংশোধনের কাজও শেষপর্যায়ে রয়েছে। এদিকে ২০০৪ সালের আইন অনুযায়ী দেশে ৪৩টি ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এসব ট্রাইব্যুনালে গড়ে ৭ হাজারের ওপর মামলা ঝুলছে। বর্তমানে সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের মোট ৩৮ লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন। কিন্তু এর মধ্যে ভূমি জরিপসংক্রান্ত মামলার অবস্থা সবচেয়ে করুণ। কারণ অন্য মামলাগুলোর ক্ষেত্রে বেশিরভাগই একটি বা দুটি স্তরের আপিল অতিক্রম করেছে। কিছু মামলার নিষ্পত্তি ঘটেছে। কিন্তু ভূমি জরিপ মামলাগুলো প্রায় প্রাথমিক ধাপেই পড়ে আছে। অধিকাংশ মামলার শুনানিই শুরু হয়নি।

জপির ট্রাইব্যুনাল নিয়ে হাইকোর্টের রায়

২০১৫ সালে এক রিটের শুনানিকালে হাইকোর্ট দেশে কোনো ভূমি জরিপ আপিল ট্রাইব্যুনাল না থাকার বিষয়টি লক্ষ্য করেন। পরে ওই বছরের ৩ মার্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন। এরপর চূড়ান্ত শুনানি করে হাইকোর্ট গত বছর রায় দেন। গত ১২ অক্টোবর ওই রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে তিন মাসের মধ্যে ভূমি জরিপ আপিল ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়। হাইকোর্টে দেয়া ওই রায়ের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ২০০৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৫ বছরে ভূমি মন্ত্রণালয় আপিল ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করতে না পারায় লাখ লাখ মানুষ ‘চরম ও সীমাহীন দুর্ভোগে’ নিমজ্জিত হয়েছেন। সরকার নিজের আইন নিজে যথাযথ এবং দ্রুত সময়ে বাস্তবায়ন করবে, এটাই সকলের কাম্য। রায়ে আরও বলা হয়, ‘গত ১৫ বছর ভূমি মন্ত্রণালয় এদেশের মালিক জনগণকে তার আইনসম্মত প্রাপ্য (তথা আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল মামলা দায়েরের) অধিকার থেকে বঞ্চিত করে চলেছে। ফলে জনগণের মৌলিক অধিকার যেমন লঙ্ঘিত হচ্ছে, তেমনি জনগণ সুবিচার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবরা আপিল ট্রাইব্যুনালের বিচারক নিয়োগ না করে জনগণের সাথে অমানবিক, নিষ্ঠুর এবং ক্ষমার অযোগ্য আচরণ করেছেন। ১৫ বছর ধরে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করা মন্ত্রী-সচিবদের কৈফিয়ত চাওয়ার কথা বলা হয়েছে রায়ে।

আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এখন একজন যুগ্ম জেলা জজ ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ পরিচালনা করেন। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল হওয়ায় নির্দিষ্ট বিচারক ছাড়া অন্য কেউ মামলা পরিচালনা করতে পারেন না। এতে মামলাজট ও দুর্ভোগ বাড়ছে। ভূমি জরিপ রেকর্ডে ভুলত্রুটি হলে জমির মালিক প্রতিকার পেতে এই ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে পারেন। ভূমি জরিপের গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর এক বছর পর্যন্ত সময়ে এই মামলা করা যায়। উপযুক্ত কারণ দর্শানো সাপেক্ষে অতিরিক্ত আরও এক বছর সময় নিতে পারেন জমির মালিকরা।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল আমার সংবাদকে বলেন, ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে মামলাজট দীর্ঘদিনের সমস্যা। আসলে সংক্ষুব্ধদের আপিল করার সুযোগ না থাকায় জট দিনদিন বাড়ছে। মামলাজট নিসনে পদক্ষেপ নেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। ট্রাইব্যুনালে মামলা হারলেই উচ্চ আদালতে আসতে হয়। এতে উচ্চ আদালতেও বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয় সেইসাথে বিচারপ্রার্থীদের চরম হয়রানির শিকার হতে হয়। তাই দ্রুততার সাথে প্রতি জেলায় আপিল ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা সময়ের দাবি। আর অনেক সময় শোনা যায় ট্রাইব্যুলালে ডিক্রি পাওয়ার পরও সেটার বাস্তবায়ন হতে মাসের পর মাস সময় লেগে যায়। এটা খবই দুঃখজনক। কারণ আইনেই আছে রায় হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্টদের সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে রাজস্ব কর্মকর্তা বা এসিল্যান্ডদের গড়িমসিতে বিপাকে পড়ে আবারো ট্রাইব্যুনালে যেতে হয়। মূলত জেলা প্রশাসনের গাফিলতিই এ জন্য দায়ী। তাই মন্ত্রণালয়ের এ বিষয়ে তদারকি ও মনিটরিং করা উচিত এতে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমবে।

ফরিদপুর জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোসাদ্দেক আহম্মেদ বশির আমার সংবাদকে বলেন, ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে এটা সমাধান সহজ নয়। সংশ্লিষ্টারাও এদিকে খুব বেশি নজর দেন না যার জন্য ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের। আসলে একটা জেলা আদালতে যতগুলো সিভিল মামলা আছে তার চেয়ে তিনগুণ বেশি মামলা আছে ওই জেলার ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে। এটা খুবই ভয়াবহ বিষয়। এই মামলাগুলো হওয়ার প্রধান কারণ হলো ভূমি জরিপে গাফলতি ও ভুল থাকায়। সর্বশেষ বিএস জরিপ ভুলে ভরা যেটা সবচেয়ে বেশি মামলার জন্ম দিয়েছে। আর মামলাজটের প্রধান কারণ হলো এসব মামলার শুনানির তারিখ পড়ে ৪-৫ মাস পর পর যার জন্য মামলা বাড়তে থাকে কিন্তু নিষ্পত্তির সংখ্যা বাড়ে না। আবার সংক্ষুব্ধ হলে আপিল করার সুযোগ না থাকাও আরেকটি কারণ। তাই দ্রুত আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা সেইসাথে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা অতি জরুরি। না হলে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ বাড়তেই থাকবে।

এ বিষয়ে রাজবাড়ী জেলা জজ আদালতে আইনজীবী নারায়ণ চন্দ্র বলেন, ‘আমি ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ২৫-৩০টি মামলায় ডিক্রি পেয়েছি। নিয়মানুযায়ী, ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার পর ৩০ দিনের মধ্যে তা বাস্তবায়নের কথা। কিন্তু একটির রায়ও কার্যকর হয়নি। জেলা প্রশাসনের গাফিলতিই এ জন্য দায়ী।’

আমারসংবাদ/জেআই