Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

বিপজ্জনক সময়ে খালেদা!

মে ৪, ২০২১, ০৭:৩০ পিএম


বিপজ্জনক সময়ে খালেদা!
  • ভালো খবর নেই চিকিৎসকদের কাছে, অবনতির বার্তাই বেশি
  • অক্সিজেনের প্রয়োজন হওয়ায় ভাবনায় চিকিৎসকরা
  • সরকারের ইঙ্গিতে দেশের বাইরে নেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে দলে বহু কথা 
  • সরকারের ইচ্ছায় মুক্তি, এখন বিপজ্জনক সময়ও পুরনোরূপে
  • খালেদা জিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে মহাভাবনায় বিএনপি চলছে প্রার্থনা

বিপজ্জনক সময়ে সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। দীর্ঘ সময় বন্দি থাকায় কমে গেছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। দেশের বাইরে যেতে না পারায় হয়নি জটিল রোগের চিকিৎসাগুলোও। এ পরিস্থিতিতে আক্রান্ত করোনায় বেড়ে গেছে শ্বাসকষ্ট। নেয়া হয়েছে সিসিউতে। নিচ্ছেন কৃত্রিম অক্সিজেন। চিন্তিত খালেদা জিয়ার চিকিৎসকরা। নেই কোনো উন্নতি। দিনদিন অবনতির খবরই পাশে পাচ্ছেন তারা। খালেদা জিয়া করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর যখন স্বাভাবিক ছিলেন তখনো তার ফুসফুসে ৭ শতাংশ সংক্রমণ ছিলো। কিন্তু অবনতির পর শ্বাসকষ্ট বাড়লে সিসিইউতে স্থানান্তরের পর তার চিকিৎসকরা এ নিয়ে আর কেউ কথা বলছেন না। সবাই অবনতির ইঙ্গিত দিয়ে অস্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে এডিয়ে যাচ্ছেন। ভালো খবর দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

এ পরিস্থিতে আলোচনা উঠেছে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া। বিএনপি মহাসচিব ও খালেদা জিয়ার ছোট ভাই দেখা করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে। এ নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠেছে পরিবার ও দলের একটি অংশ ঝুঁকি মুহূর্তে হলেও খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে নিয়ে যেতে চান। অন্যদিকে আরেক অংশ বলছেন বিএনপি নয় বরং সরকারই এখন দল ও পরিবারকে ডাকছেন। খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে নিয়ে যেতে। কারণ খালেদা জিয়ার অঘটন সরকারের দায়ের মধ্যে হোক এটি সরকার চাচ্ছেন না। এর আগে ঝুঁকি সময়ে সরকারের ইচ্ছেতেই খালেদা জিয়া মুক্তি পান এখন ফের বিপজ্জনক সময়েও যদি মুক্তি পায় তাও হবে সরকারের ইচ্ছায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছেন, প্রায় আড়াই বছর আইনি লড়াইয়ে কিংবা রাজপথে ভূমিকা পালন করে সরকারকে চাপ প্রয়োগে খালেদা জিয়ার মুক্তি নিশ্চিত করতে পারেনি বিএনপি। দেশে করোনা বেড়ে গেলে গত বছর ২৪ মার্চ হঠাৎ সংবাদ সম্মেলন ডেকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান- খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে ৬ মাসের জন্য সাময়িক মুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পূর্ব বার্তা ছাড়াই হঠাৎ সরকারের এমন ঘোষণার পর সেই সময়ে তাৎক্ষণিক বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, এখন পর্যন্ত বিষয়টি সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না। উনাকে কোন প্রক্রিয়ায় কীভাবে মুক্তি দেয়া হচ্ছে। আমরা বিষয়টি জানার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার ১৭তম দিনে সরকারের নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার ‘সাময়িক’ মুক্তির পেছনে সব চেয়ে বড় কারণটি ছিলো তাকে ঝুঁকিমুক্ত রাখা। এ বিষয়টি বিএনপির শীর্ষ নেতারাও তখন অনেকে বলেছেন। কারণ সরকার কোনোভাবেই চায়নি বন্দি অবস্থায় হাসপাতালে তার দুর্ঘটনা ঘটুক। কারণ খালেদা জিয়ার আটক ও সাজার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা রাজনৈতিক কারণেই দেখেছেন। বন্দি অবস্থায় খালেদা জিয়ার দুর্ঘটনা ঘটে গেলে এটির দায় ও চাপ সরকারকেই বহন করতে হবে। সেই লক্ষ্যে সরকার খালেদা জিয়াকে পছন্দের যায়গায় স্থানান্তর করেন। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। মুক্তির ১ বছর ১৫ দিনের মাথায় গত ১০ এপ্রিল বেগম খালেদা জিয়ার শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। তার বাসার অন্যরাও কোভিড-১৯ পজেটিভ। এরপর তার চিকিৎসকের নির্দেশনায় তাকে রাখা হয় ?রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে। সেখানে দ্বিতীয় টেস্টেও আসে তার পজেটিভ। চিন্তা বাড়ে সবার। সেখানে গত সোমবার বিকালে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে নেয়া হয় সিসিইউতে। তার চিকিৎসকরা জানিয়েছেন আপাতত তিনি ভালো আছেন।

জানা যায়, বর্তমানে শুধু তার করোনা সমস্যাই নয়। গত সাড়ে ৩ বছরের বেশি সময় ধরে কারো সাহায্য ছাড়াই হাঁটতে পারেন না বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দলটির নেতারা বলছেন, দুর্নীতির মামলায় সাজা হলে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পায়ে হেঁটে পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কারাগারে যান খালেদা জিয়া। এরপর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি পেলে তাকে হুইল চেয়ারে করে হাসপাতাল থেকে নিচে নামিয়ে গাড়িতে তোলা হয়। তখন তার এক হাত হলুদ কাপড়ে ঢাকা ছিলো। কার্যত চিকিৎসার অভাবে তার এক হাতের কিছু অংশ বেঁকে যায় বলে চিকিৎসক সূত্র জানান। এখনও তার একই অবস্থা। হুইল চেয়ারে করে কারো সাহায্য নিয়ে তাকে চলাফেরা করতে হয়। সম্প্রতি বাসা থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেয়ার সময়ও একই দৃশ্য দেখা যায়। চলাফেরার জন্য অন্যর সাহায্যের প্রয়োজন হচ্ছে। বিএনপি নেতারা ও খালেদা জিয়ার চিকিৎসকরা বলেছেন, কারাবন্দি থাকা অবস্থায় ২০১৮ সালের ১৭ জুন গুরুতর অসুস্থ খালেদা জিয়াকে বিশেষায়িত হাসপাতাল ইউনাইটেডে চিকিৎসা দেয়ার দাবি জানায় বিএনপি। কিন্তু সরকার ২০১৮ সালের ৬ অক্টোবর হুইল চেয়ারে করে কারাগার থেকে খালেদা জিয়াকে নিয়ে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে দীর্ঘসময় তাকে চিকিৎসা দেয়া হলেও স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি হয়নি।

২০১৮ সালের ১৭ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম দাবি করেন, পরিত্যক্ত, জরাজীর্ণ শত বছরের পুরনো কারাগারে চিকিৎসা না পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন খালেদা জিয়া। তিনি সাহায্য ছাড়া হেঁটে আসতে পারছেন না। তাকে সাহায্য নিতে হচ্ছে, ধরতে হচ্ছে। খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. জাহিদ হোসেন বলেন, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আলিয়া মাদরাসার অস্থায়ী আদালত থেকে পা হেঁটে কারাগারে যান খালেদা জিয়া। কিন্তু কারাগারে তার সঠিক চিকিৎসা না হওয়ার পরে ওই বছরের জুন মাস থেকে তিনি হাঁটতে পারেন না। তখন আমরা বারবার সরকারের কাছে আবেদন করেছি তাকে বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা করার সুযোগ দেয়ার জন্য। কিন্তু সরকার দেয়নি। তিনি আরও বলেন, সরকার বিএসএমএমইউ হাসপাতালে তাকে দেড় বছর চিকিৎসা দিলেও তার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। বরং আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। আজকে খালেদা জিয়ার যে পরিস্থিতি এর জন্য এই ক্ষমতাসীন সরকারই অনেকটা দায়ী।

বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে, খালেদা জিয়ার করোনা শনাক্ত ও শ্বাসক্ষষ্ট বেড়ে যাওয়ার পর থেকে মহাভাবনায় পড়েছে বিএনপি। রাজনৈতিক হিসাব নিকাশের সঙ্গে দলের অভ্যন্তরীণ অনেকগুলো বিষয় নিয়েও চিন্তা রয়েছে। বর্তমানে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। দলের হাইকমান্ডের নেতারা বলছেন, দীর্ঘদিন বন্দি থাকায় তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে। শরীরের জটিলতাগুলো মারাত্মভাবে বেড়ে গেছে। নিয়মিত দেশের বাইরে যে চিকিৎসাগুলো হতো তা হয়নি। বহু সমস্যার মধ্যে আক্রান্ত ও অক্সিজেনের প্রয়োজন হওয়ায় দুর্ঘটনার আতঙ্কে এখন দলটির নেতারা সময় গুনছেন। শীর্ষ নেত্রীর সুস্থতা কামনা করছেন। এ পরিস্থিতি খালেদা জিয়ার কিছু হয়ে গেলে বিএনপিতে বড় আকারে সুনামি বয়ে যেতে পারে। চিকিৎসকরা ভালো খবর দিতে পারছেন না। এ পরিস্থিতিতে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা ছাড়াও হাতে গোনা দুয়েকজন ব্যাতিত শীর্ষ নেতার মধ্যে প্রায় সবাই করোনা আক্রান্ত। প্রতিদিনের যে মৃত্যুর মিছিল, সেখানে কখন কার নামযুক্ত হয়, তা নিয়ে শঙ্কিত দলের হাইকমান্ড।

এদিকে গতকাল খালেদা জিয়াকে সিসিইউতে নেয়ার পর সন্ধ্যায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে কথা বলেছেন। খালেদা জিয়ার চিকিৎসকের তথ্য সরকারকে তখন জানানো হয়। সেখানে খালেদা জিয়াকে দ্রুত দেশের বাইরে নিতেও কথা হয়েছে বলে বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতা দাবি করেন। তবে এমন আলোচনা হয়েছে বলে বিএনপি মহাসচিব বা সরকার কেউ স্বীকার করেনি। দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, বিদেশে পাঠাতে সোমবার রাতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করা হয়েছে। দেশের একটি খ্যাতনামা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় এ প্রক্রিয়াটি বেশ এগিয়ে রয়েছে। এছাড়া পারিবারিকভাবে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কারা যাবেন, এ বিষয়টিও ঠিক করা হয়েছে। এখন সরকারের সবুজ সংকেত পেলে দ্রুত বিষয়টি সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ নিয়েও দলের ভেতরেও গুঞ্জন রয়েছে। বিএনপি কী নিজ থেকেই সরকারের কাছে গিয়েছে নাকি সরকারই বিএনপিকে ডেকেছে— এ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। দলের হাইপ্রফাইলের এক নীতিনির্ধারক বলেন, আপনারা সবই জানেন এর আগে আইনীবীর চেষ্টা ও ব্যর্থ হোন। সরকারের ইচ্ছাতেই খালেদা জিয়া শর্তে জামিন পান। কারণ সরকার খালেদা জিয়াকে নিয়ে ঝুঁকিতে পড়তে চায়নি। এখনো হয়তো ঝুঁকিতে পড়তে চায় না। তাই সরকার দায় এড়াতে বিএনপিকে ডাকতেও পারে দেশের বাইরে পরিবার কিংবা দলের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিতে।

খালেদা জিয়ার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ম্যাডামের অবস্থা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দিয়েছি। সেগুলোর প্রতিবেদন আসার পর জানাতে পারবো। এর আগে বলার কিছু নেই।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়ার অসুস্থতার খবরে আমরা সবাই নিশ্চয়ই উদ্বিগ্ন। নেতাকর্মীরা উদ্বেগের মধ্যে আছেন দেশনেত্রীর শারীরিক অবস্থা কেমন তা নিয়ে। আপনারা সবাই শুনেছেন যে, গতকাল তার একটু শ্বাসকষ্ট হওয়ায় সিসিইউতে নেয়া হয়েছে। এখনো তিনি সিসিইউতে আছেন। অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। এখন তিনি স্থিতিশীল আছেন। তিনি বলেন, আমরা আল্লাহর কাছে তার জন্য দোয়া চাইছি, সমস্ত দল নয়, সমগ্র জাতি আজকে প্রার্থনা করছেন। দোয়া করছেন, এই দেশের স্বাধীনতার সার্বভৌমত্বের শেষ আশ্রয়স্থল, যাকে গণতন্ত্রের একমাত্র প্রহরী বলা যায়, তিনি (খালেদা জিয়া) যেন অতি দ্রুত সুস্থতা লাভ করেন। তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপির নেতাকর্মী, সমর্থক তো বটেই এ দেশের সাধারণ মানুষ, দলমতনির্বিশেষে সবাই বিএনপির চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ভালোবাসেন, পছন্দ করেন। এ দেশে অসংখ্য মানুষ আছেন, মা-বোনেরা আছেন, যারা খালেদা জিয়ার জন্য নফল রোজা রাখছেন, দোয়া করছেন’

আমারসংবাদ/জেআই