Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

লাইলাতুল কদর ইতিকাফ ও সদকাতুল ফিতর

মুফতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল

মে ৬, ২০২১, ০৭:২৫ পিএম


লাইলাতুল কদর ইতিকাফ ও সদকাতুল ফিতর

রমযানের শেষ দশ দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাসূল (স.) এই দশ দিনে অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। বস্তুজগতের মায়া-মোহের বাঁধন ছিঁড়ে তাকওয়ামুখী হূদয় অর্জন ও আল্লাহর  সান্নিধ্য লাভের মুখ্য সময় হল মাহে রমযান। আর রমযানের শেষ দশ দিন হল তাকওয়া ও আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের শেষ সুযোগ। সে হিসেবে বর্ণনাতীত শ্রম দিতে হয় এই দিনগুলোতে। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রমযান মাসের শেষ দশকে রাসূল (স.) এত বেশি ইবাদত করেছেন যা অন্য সময় করেননি, (মুসলিম)। তিনি আরো বলেন, রাসূল (স.) রমযানের শেষ দশকে কুরআন তিলাওয়াত, সলাত, যিকির ও দোয়ার  মাধ্যমে রাত যাপন করতেন। তারপর সেহরী খেতেন। আয়েশা (রা) থেকে অন্য হাদীসে এসেছে, তিনি  বলেন,  রাসূল (স.) রমযানের শেষ দশক রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং পরিবারবর্গকেও জাগিয়ে দিতেন। খুব পরিশ্রম করতেন। এমনকি লুঙ্গি বেঁধে নিতেন, (বুখারী)। নিম্নে রমজানের শেষ দশকের আমলের একটি বিবরণ তুলে ধরা হলো- 

ইতিকাফ: একাগ্রচিত্তে আল্লাহ তায়ালার ইবাদতের উদ্দেশে সুনির্ধারিত  পন্থায়  মসজিদে অবস্থান  করাকে  ইতিকাফ বলে। ইতিকাফ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। রাসূল (স.)  ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত নিয়মিত ইতিকাফ করেছেন। পরবর্তীতে তাঁর সাহাবীগণ এ ধারা অব্যাহত রেখেছেন। সে হিসেবে রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা সুন্নাত। রমযানের শেষ দশকে রাসূল (স.)  ইতিকাফ করতেন এবং এ ইতিকাফের জন্য মসজিদের নির্জন স্থান বেছে নিয়ে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করতেন। শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও, অন্যসব কাজকর্ম পেছনে ফেলে একনিষ্ঠ হয়ে রমযানের শেষ দশ দিন মসজিদে কাটাতেন।

ইতিকাফের অনেক উপকারিতা রয়েছে-  ১. ইতিকাফের মাধ্যমে বান্দার সাথে আল্লাহর সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। ২.অহেতুক কথা, কাজ ও কুপ্রবৃত্তি  থেকে সংযত থাকার অভ্যাস গড়ে ওঠে। ৩.ইতিকাফ অবস্থায় লাইলাতুল ক্বদর তালাশ করা সহজ হয়। ৪.ইতিকাফের মাধ্যমে মসজিদের সাথে  সম্পর্ক তাজা হয় ও মসজিদে অবস্থানের অভ্যাস গড়ে ওঠে। ৫.ইতিকাফকারী দুনিয়াবী ব্যস্ততা থেকে দূরে অবস্থান করে ইবদাত বন্দেগীর মাধ্যমে  আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের বিশেষ পর্যায়ে পৌঁছতে সক্ষম হয়। ৬.বদ অভ্যাস ও কুপ্রবৃত্তি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়ে ইতিকাফের মাধ্যমে  চারিত্রিক বলিষ্ঠতা অর্জন করা সম্ভব হয়।

রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফকারীর জন্য বিশ তারিখের সূর্যাস্তের পূর্বেই ইতিকাফস্থলে প্রবেশ করা উত্তম। কেননা ইতিকাফের মূল লক্ষ্য লাইলাতুল ক্বদরের অনুসন্ধান, যা শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর একুশতম রাত এরই অন্তর্ভুক্ত। তবে ফজরের স্বলাতান্তেও ইতিকাফে প্রবেশ করা যেতে পারে। হযরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, ঈদের রাতে সূর্যাস্তের পর ইতিকাফ  থেকে বেরিয়ে পড়া বৈধ, (সহিহ বুখারি)। তবে কারও কারও মতে ঈদের রাত মসজিদে অবস্থান করে মসজিদ থেকেই ঈদের জামাতে অংশ গ্রহণ করা উত্তম।

ইতিকাফকারীর মসজিদ থেকে  বের হওয়া না হওয়ার বিষয়ে কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে, যেমন- ১. বিনা ওযরে ইতিকাফকারী যদি মসজিদ থেকে বের হয়ে যায় তাহলে  সর্বসম্মতিক্রমে তার ইতিকাফ বাতিল বলে গণ্য হবে। আর যদি শরীরের অংশ বিশেষ বের করে দেয়, তাহলে কোনো অসুবিধা হবে না। নবী কারীম (স.) নিজেও ইতিকাফ অবস্থায় নিজ  মাথা বের করে দিতেন। মা আয়েশা (রা) নিজ কক্ষে বসেই  রাসুলের (স.) মাথা ধুয়ে সিঁথি করে দিতেন। ২. অতি প্রয়োজনীয় বিষয় যেমন- ওযু, গোসল, পানাহার, প্রস্রাব-পায়খানা ইত্যাদি কাজের জন্যে সর্বসম্মতিক্রমে বের হওয়া জায়েয। আর যদি উল্লিখিত বিষয়সমূহ  মসজিদের ভিতরে থেকেই  সম্পূর্ণ করা  সম্ভব হয় তাহলে মসজিদ থেকে বের হওয়া বৈধ হবে  না। ৩. ইতিকাফ যদি এমন মসজিদে হয়, যেখানে  জুমার স্বলাত হয় না, তাহলে জুমার নামাজের  জন্য জামে মসজিদে গমন করা ওয়াজিব। ৪.ওয়াজিব নয় এমন ইবাদত যেমন- জানাযায় অংশ গ্রহণ, অসুস্থকে দেখতে যাওয়া ইত্যাদির উদ্দেশ্যে বের হওয়া জায়েয নেই। ইতিকাফকারীর জন্য অন্য সব ধরনের ইবাদতই অনুমোদিত। যেমন- সলাত, কুরআন তিলাওয়াত, যিকর, দোয়া, ইস্তিগফার, সালামের উত্তর দেয়া, সৎকাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ, ফাতওয়া প্রদান, ইলম শিক্ষা ইত্যাদি। ইতিকাফকারীর জন্য পর্দা টাঙ্গিয়ে লোকজন থেকে নিজকে আড়াল করে নেয়া মুস্তাহাব। কেননা নবী কারীম(স.) ইতিকাফ করেছেন একটি তুর্কি তাঁবুতে যার প্রবেশ দ্বারে ছিল একটি পাটি,(সহীহ মুসলিম)। ইতিকাফকারী প্রয়োজনীয় বিছানা-পত্র, কাপড় ইত্যাদি সাথে নিয়ে নিবে, যাতে মসজিদ থেকে বেশি বের হতে না হয়। ইতিকাফকারীর জন্য মসজিদের ভেতরে পানাহার, ঘুমানো, গোসল, সাজগোজ, সুগন্ধী ব্যবহার, পরিবার-পরিজনের সাথে কথপোকথন ইত্যাদি সবই বৈধ। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন সীমাতিরিক্ত না হয়ে যায়। রাসূলের (স.) ইতিকাফস্থলে তাঁর পত্নীগণের সাক্ষাত ও কথপোকথন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

ইতিকাফকারীকে কিছু কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে- ১.অতিরিক্ত কথা ও ঘুম, অহেতুক কাজে সময় নষ্ট করা, মানুষের সাথে বেশি বেশি  মেলা-মেশা ইত্যাদি ইতিকাফের মূল  উদ্দেশ্যকে ব্যহত করে। তাই এ সব থেকে ইতিকাফকারী বিরত থাকবে। ২. ইতিকাফ অবস্থায় ক্রয়-বিক্রয় বৈধ নয়। কেননা নবী কারীম (স.)  মসজিদে ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন, (সহিহ মুসলিম)। ৩.কামভাবসহ স্বামী-স্ত্রীর আলিঙ্গন ইতিকাফে থাকাকালিন কোনো অবস্থাতেই  অনুমোদিত নয়, বরং সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। ৪.বায়ূ নি:সরণ মসজিদের আদবের পরিপন্থী। তাই পারতপক্ষে একাজ থেকে বিরত থাকা উচিত।

লাইলাতুল ক্বদর: সম্মানিত রজনী লায়লাতুল ক্বদর। পবিত্র কুরআনে লাইলাতুল ক্বদরকে বরকতময় রজনী বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে।  লাওহে মাহফুয থেকে প্রথম আকাশের বায়তুল মামুরে সম্পূর্ণ কুরআন  নাযিল হয় এ সম্মানিত রাতে। এ রাত হাজার মাস থেকেও উত্তম। এ রাতে ফেরেশতা এবং জিব্রাঈল আমীন অবতীর্ণ হন। শান্তির আবহ ঘিরে রাখে প্রতিটি বিষয়কে  লায়লাতুল ক্বদরে। এই রজনীতে স্থিরকৃত হয় প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়। মাগফিরাতের রজনী লায়লাতুল ক্বদর। হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সোয়াবের আশায় লায়লাতুল ক্বদর ইবাদতের মাধ্যমে যাপন করে তার অতীতের সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়। লায়লাতুল ক্বদরে শয়তান বের হয় না। রাসূল (স.) বলেন, এ রজনীতে শয়তানের বের হওয়ার অনুমতি নেই। রমযানের শেষ দশ দিনে  ‘লাইলাতুল ক্বদর’ তালাশ করা মুস্তাহাব তবে তা বেজোড় রজনীতে হওয়া প্রায় নিশ্চিত। রাসূল (স.) বলেন, ‘তোমরা ‘লাইলাতুল ক্বদর’ তালাশ করো রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রজনীগুলোতে।’ তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা রমযানের শেষ দশকে ‘লাইলাতুল ক্বদর’ তালাশ করো’ (বুখারী, ১৮৭৮)। সে হিসেবে রমযানের ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখে  ‘লাইলাতুল ক্বদর’ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। লাইলাতুল ক্বদর পাওয়ার উত্তম পদ্ধতি হল রমযানের শেষ দশ দিনি ইতিকাফে কাটানো এবং শেষ দশকের  প্রতিটি রাত ইবাদতের মাধ্যমে যাপন করা। আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, লাইলাতুল ক্বদরে  দুআ- (আল্লাহুম্মা ইন্নাকা ‘আফুউন কারীমুন তুহিববুল ‘আফওয়া ফা‘ফু ‘আন্নী) হে আল্লাহ তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করাকে তুমি পছন্দ কর, সুতরাং তুমি আমাকে ক্ষমা করো, (তিরমিযি, ৩৪৩৫) ।

সাদাকাতুল ফিতরা : আব্বাস (রা) বলেন, ‘রাসূল (স.) সায়িমকে অহেতুক-অশালিন কথা ও কাজ থেকে পবিত্র করা এবং অসহায় মানুষের আহার যোগান দেয়ার উদ্দেশে যাকাতুল ফিতরের বিধান প্রবর্তন করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি ফিতরা ঈদের সলাতের পূর্বে আদায় করবে তা ফিতরা হিসেবে  গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি  ঈদের সলাতের পর আদায় করবে  তা হবে সাধারণ সদকা’ (আবূ দাঊদ)। ঈদের দিন ও রাতে খরচের অতিরিক্ত ফিতরা দেয়ার মত সম্পদ যার  থাকবে তার ওপর ফেতরা ওয়াজিব হবে। নিজের ও যাদের খোরপোশের দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত, সবার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করতে হবে।  আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) বলেন,  ‘রাসূল (স.)  এক ‘সা (দুই কেজি চল্লিশ গ্রাম) খেজুর বা এক সা যব  যাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন।  মুসলিম গোলাম-আযাদ, নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, সবার উপর ফরয করেছেন এবং ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে এটা আদায় করার আদেশ প্রদান করেছেন, (মুসলিম , ১৬৪৬)। অন্য হাদীসে এসছে, হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, আমরা আমাদের খাবার দ্বারা ফিতরা আদায় করতাম। তখনকার সময়ে আমাদের খাবার ছিল যব, কিশমিশ, পনির ও খেজুর, (বুখারী, ১৪০৮)। বাংলাদেশের প্রচলিত খাবার চাল। সে হিসেবে দুই কেজি চল্লিশ গ্রাম চাল দিয়ে ফেতরা আদায় করা যেতে পারে। যব, কিশমিশ, পনির, খেজুরও একেবারে অব্যবহূত নয়। সে হিসেবে ধনী লোকদের উচিত এগুলোর মাধ্যমেও ফেতরা আদায়ের চেষ্টা করা।

ফিতরা আদায় করার উত্তম সময়  ঈদের দিন সকালে ঈদের সলাতের পূর্বে। ইবনে ওমর (রা) বর্ণনা করেন, ‘রাসূল (স.)  ঈদের সলাতে বের হবার পুর্বেই ফিতরা আদায় করার আদেশ প্রদান করেছেন।’ এ কারণেই ঈদুল ফিতরের সলাত একটু বিলম্ব করে পড়া মুস্তাহাব। ঈদের এক বা দু’দিন পূর্বে আদায় করা জায়েয। যেমনটি করেছেন হযরত ইবনু ওমর (রা)। ফিতরা নিজ এলাকার অসহায় লোকদের মাঝে বণ্টন করতে হবে। নিজ এলাকায় দরিদ্র লোক না থাকলে অন্য এলাকায় আদায় করা যেতে পারে।  ঋণ পরিশোধে অক্ষম ব্যক্তিও প্রয়োজন অনুসারে ফিতরা গ্রহণ করতে পারবে। একজন দরিদ্রকে একাধিক লোকের ফিতরা দেয়া যেতে পারে। আবার একাধিক দরিদ্র লোকের মাঝেও একভাগ ফিতরা বণ্টন করা যায়। দরিদ্র ব্যক্তি অন্য লোকের কাছ থেকে ফিতরা গ্রহণ করে প্রয়োজনের অতিরিক্ত হলে তা দিয়ে নিজের ফিতরা আদায় করতে পারবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে কবুল করুন, আমীন। 

লেখক : প্রভাষক (আরবি), চাটখিল কামিল মাদরাসা, নোয়াখালী,

ibrahim010187@gmail.com

আমারসংবাদ/জেআই