Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

বিদেশ যাওয়া হচ্ছে না

নিজস্ব প্রতিবেদক

মে ৯, ২০২১, ০৮:৫০ পিএম


বিদেশ যাওয়া হচ্ছে না
  • ৪০১ ধারার সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে মতানৈক্য
  • সরকারের সিদ্ধান্তকে অমানবিক বলছে বিএনপি, অঘটন হলে দায় সরকারের
  • ‘আইনগত দিক বিবেচনা করে খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই’ -আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
  • ৪০১ ধারার কার্যক্রম শেষ হয়ে গেছে  আরেকবার ওপেন করার সুযোগ নেই -আনিসুল হক, আইনমন্ত্রী
  • সিদ্ধান্ত বেআইনি, এ আইন করাই হয়েছে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জন্য -খন্দকার মাহবুব হোসেন, খালেদা জিয়ার আইনজীবী
  • খালেদা জিয়াকে নিয়ে সরকারের এমন চালাচালি মোটেও উচিত হচ্ছে না -ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা

চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়া হচ্ছে না সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার। বিদেশে নেয়ার অনুমতি চেয়ে যে আবেদন তার পরিবার করেছিল, তা নাকচ করে দিয়েছে সরকার। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় খালেদা জিয়ার সাজা ও দণ্ডাদেশ স্থগিত করে যে শর্তে তাকে সাময়িক মুক্তি দেয়া হয়েছিল, তা শিথিল করে এখন তাকে বিদেশে যেতে দেয়ার ‘সুযোগ নেই’। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে অমানবিক বলছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। খালেদা জিয়ার অসুস্থ অবস্থায় কোনো অঘটন ঘটে গেলে দায় সরকারকেই নিতে হবে। এছাড়া অন্যান্য আইনজীবীরাও বলছেন, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে পাসপোর্ট দিতে কোনো বাধা নেই। একইভাবে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির (শর্ত শিথিল করলে) বিদেশে যেতেও কোনো আইনি বাধা নেই। কারণ ৪০১ (১) এবং ৪০১(৪ক) ধারায় স্পষ্ট রয়েছে, আদালত যদি বিদেশ যেতে নিষেধ করে কোনো আদেশও দেয় তাহলেও সরকার বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে। আইন সরকারকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে।

আইনমন্ত্রীর এ মতামত পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেয়ার অনুমতি চেয়ে তার ভাই শামীম এস্কান্দারের আবেদনটি গ্রহণ করতে পারলাম না।’ শামীম এস্কান্দার ওই আবেদন করার পর গত চারদিন ধরে পর্যালোচনা ও দাপ্তরিক বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে গতকাল রোববার বিকালে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের সিদ্ধান্ত জানানো হলো। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর এপ্রিলের ২৮ তারিখ থেকে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ইতোমধ্যে তিনি করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত হয়েছেন বলে তার দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তাকে বিদেশে নেয়ার জন্য পাসপোর্ট নবায়নসহ অন্যান্য প্রস্তুতিও এগিয়ে নিচ্ছিল তার পরিবার। দুই মন্ত্রী সরকারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়ার পর বিএনপি বা খালেদার পরিবারের তরফ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

খালেদা জিয়া কেন অনুমতি পাচ্ছেন না, সেই ব্যাখ্যা দিয়ে আইনমন্ত্রী দুপুরে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় ইতোমধ্যে (খালেদার সাময়িক মুক্তির) সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই শর্তগুলো শিথিল করে খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার আবেদনে অনুমতি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।’ ওই মতামতই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ নিয়ে জানাবেন। একবার যখন একটা সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, ৪০১ ধারার কার্যক্রম শেষ হয়ে গেছে, সেজন্য এটাকে আরেকবার ওপেন করার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে বিদেশে যাওয়ার আবেদনে অনুমতি দেয়ার সুযোগ নেই।’ আইনমন্ত্রী তার শেষ কথা জানিয়ে দেয়ার পরপরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের সামনে আসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি বলেন, ‘আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তার অভিমতসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠিয়েছেন। আইনগত দিক বিবেচনা করে খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই।’

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘মানবিক দিক’ বিবেচনা করে তাদের নেত্রীকে অনুমতি দেয়ার আহ্বান রেখেছিলেন সরকারের কাছে। সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এমন প্রশ্ন আসে কেন? মানবিক দিক বিবেচনায় ছিলো বলেই তো আবেদনটি গ্রহণ করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। আইন মন্ত্রণালয় থেকে মতামত দিয়েছে, আইনের কারণে...।’ আইন মন্ত্রণালয় অনুমতির বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সার সংক্ষেপ পাঠানো হতো প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয় ‘না’ বলে দেয়ায় এখন আর সেই প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হবে না বলে এক প্রশ্নের উত্তরে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

এ নিয়ে বিএনপিপন্থি আইনজীবী ও রাজনৈতিক কর্মী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হওয়ায় বিদেশে চিকিৎসার জন্য অনুমতি দেয়ার এখতিয়ার  সরকারের নেই বলে যে আইনি ব্যাখ্যা বা মতামত সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে তার সাথে আমি একমত নই। উক্ত মতামত ঢ়বৎ রহপঁৎরধস বা ভ্রান্ত। কারণ, ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ৪০১ ধারায় সরকারকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সাজাপ্রাপ্ত আসামির বিষয়ে শর্তহীন কিংবা শর্তযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার। ৪০১ (১) এবং ৪০১(৪ক) ধারা ভালো করে পড়লে দেখবেন, আদালত যদি বিদেশ যেতে নিষেধ করে কোনো আদেশও দেয় তাহলেও সরকার বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে। ৪০১(৪ক) ধারা পড়লে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, কোনো আইনে যদি কোনো আদালত কোনো ব্যক্তির (সাজাপ্রাপ্ত কিংবা সাজাপ্রাপ্ত নয়) চলাফেরার স্বাধীনতা খর্ব করে কোনো আদেশ দেন সেক্ষেত্রেও সরকার তা স্থগিত করে তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারে। এই ক্ষমতা সরকারের সহজাত কিংবা রহযবৎবহঃ ঢ়ড়বিৎ। দুদক আইন, ২০০৪ এ সরকারের এই ব্যাপক সহজাত ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়নি। ফলে, দুদকেরও এখানে বলার কিছু নাই।’

ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে পাসপোর্ট দিতে কোনো বাধা নেই। একইভাবে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির (শর্ত শিথিল করলে) বিদেশে যেতেও কোনো আইনি বাধা নেই।

খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও দলের যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চাইলে শর্ত কমিয়ে বা বাড়িয়ে তাকে বিদেশে চিকিৎসা করার সুযোগ দিতে পারতো। এখন তারা যে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে তা অমানবিক।

গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, ‘মানবতার কারণে হলেও খালেদা জিয়াকে চিকিৎসা করাতে বিদেশে যেতে দেয়া উচিত।’ তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে নিয়ে সরকারের এমন চালাচালি করা মোটেও উচিত হচ্ছে না। উনার যে অবস্থা এদেশে উনার চিকিৎসা হচ্ছে না। লাঞ্চে পানি আসাটা খুবই খারাপ লক্ষ্মণ। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হতে পারে। এটা দেশের জন্য, জাতির জন্য একটা বিপজ্জনক সমস্যার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যখন আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে তখনইতো করে দিতে পারতো সরকার। এটাতো আধা ঘণ্টার কাজ।’

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, ‘খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের এ মতামত বেআইনি। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে কোনো অঘটন ঘটে গেলে তার দায় সরকারের।’ উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ বেআইনি। এ আইনে এমন কোনো বিধান নেই যে কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বিদেশে যেতে পারবে না। এ আইন করাই হয়েছে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জন্য।’

খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘চিকিৎসা শেষে ফিরে আসতে হবে— সরকার এই শর্ত দিতে পারতো। খালেদা জিয়া তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। তার অবস্থা অত্যন্ত জটিল। সরকার মানবিকভাবে দেখতে পারতো।’ এই আইনজীবী বলেন, ‘তার (খালেদা জিয়া) চিকিৎসার ব্যাপারে সরকারের নিজেরই উদ্যোগ নেয়া উচিত। অনুমতি না দিয়ে সরকারের এত বড় দায়ভার নেয়া উচিত হয়নি। যদি কোনো অঘটন ঘটে যায় তখন সম্পূর্ণ দায়ভার সরকারের ঘাড়ে পড়বে। আইনকে তো মানবিকভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে।’

আমারসংবাদ/জেআই