Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের অবসান কোন পথে

মাছুম বিল্লাহ

মে ১৭, ২০২১, ০৯:০০ পিএম


ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের অবসান কোন পথে
  • বাংলাদেশ সরকার বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নের ধার ধারেনি, নিজেদের সম্পদ দিয়ে তৈরি করছে পদ্মা সেতু। স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল যে পরাশক্তি তাকেও পাত্তা দেয়নি বাংলাদেশ। এখন তারাই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করছে। সুতরাং আরব বিশ্বকে নতুন করে ভাবতে হবে। ওআইসিকে আরো বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে হবে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট মোকাবিলায়। শুধু সংহতি প্রকাশে কাজ হবে না। বিশ্ব রাজনীতি ভুলে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে ইসরায়েলকে। না হলে এই সংঘাত শেষ হবে না

পবিত্র আল-অকসা মসজিদে প্রার্থনারত নিরীহ জনতার ওপর ১০ মে ইসরায়েলের বর্বর আক্রমণ এবং বহু মানুষ হতাহতের মধ্য দিয়ে পুরনো ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট আবারো সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। ২০১৪ সালের পর এটিই সবচেয়ে বড় সহিংসতা বলে মনে করা হচ্ছে। ইসরায়েলের অস্ত্রের শক্তি আছে, পাশে আছে বিশ্ব পরাশক্তি কয়েকটি দেশ। তার জোরেই তারা দখল করে নিয়েছে পশ্চিম তীর ও গাজা; ১৯৬৭ সালে। সেই থেকে চলছে এই সহিংসতা। মূলত ১৯৪৮ সালে আরব ভূমিতে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এই সহিংসতার বীজ বপন করেছিল। বলাবাহুল্য, এর মদদ জুগিয়েছে পশ্চিমা শক্তি। যুগের পর যুগ, দিনের পর দিন ফিলিস্তিন নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি দখল করে, তাদের ওপর নির্মম অত্যাচার করছে ইসরায়েল। অন্যদিকে  তথাকথিত সভ্য বিশ্ব এই সহিংসতায় নিহত-আহত ফিলিস্তিনিদের আহাজারি আর ক্রন্দন উপভোগ করেছে। যেনো তাদের কিছুই করার নেই! উল্টো ইসরায়েল যখন বিভিন্ন উসিলায় ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর চড়াও হয়েছে তখন জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে ফিলিস্তিনিরা যখন প্রতিরোধ গড়ে পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছে তখন তাদের বলা হয়েছে ‘সন্ত্রাসী’। ‘জঙ্গি গোষ্ঠী’ তকমাও তাদের শরীরে লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো যদি সত্য প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করতো, তাহলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষ অনেক আগেই বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি।

হামাস এবং হামাস নেতাকে ধ্বংস করার জন্য ইসরায়েল অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আসছে সেই প্রথম থেকেই। সর্বাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে তারা। মুহূর্তে বিলীন করে দিচ্ছে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বৃদ্ধ, শিশুরাও তাদের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। তারা বিশ্ববাসীকে বলে, হামাসকে ধ্বংস করার জন্য এই নারকীয় খেলা! কিন্তু হামাসকে কি ধ্বংস করা যাবে? এটি তো প্রায় একতরফা যুদ্ধ। এই সংকটকালে হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে বলা হলো— ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন গাজা থেকে হামাস ও অন্যান্য সন্ত্রাসীদের রকেট হামলা ঠেকাতে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। আর এই অধিকারের প্রতি তার একনিষ্ঠ সমর্থন অব্যাহত থাকবে।’ এতে বিশ্ববাসী প্রায় চমকে উঠেছে। যদিও বিশ্ব রাজনীতিতে যারা বিজ্ঞ, তারা জানেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি তেমন পরিবর্তন হয় না। ক্ষমতায় যেই থাকুক। তাদের অবৈধ সমর্থনের কারণেই নারকীয় খেলায় মেতে আছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে বাইডেন বলেছেন, ইসরায়েল লক্ষ্য করে গাজা থেকে হামাস যেনো রকেট হামলা বন্ধ করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আব্বাসের সঙ্গে এই প্রথম কথা হলো বাইডেনের। অথচ বাইডেন প্রশাসনের অজানা নয়, গাজা উপত্যকায় আব্বাসের নিয়ন্ত্রণ খুবই কম। আব্বাস ও তার দল ফাতাহর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে পশ্চিম তীর। আর গাজার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হামাস সরকার। হামাসকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল দেখে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে। অথচ তারা লড়াই করছে স্বাধীনতা ফিরে পেতে। ইসরায়েলের হাত থেকে তাদের ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে। এটি জেনেও আমেরিকার মতো পরাশক্তি সত্যকে পুরোপুরি অগ্রহ্য করে চলেছে বলেই নিভছে না মধ্যপ্রাচ্যের এই আগুন।

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার লড়াই নিয়ে বৈঠকে বসতে যাচ্ছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। আমরা জানি, বিশ্ব পরাশক্তিগুলোর চাপ ও প্রভাবের কারণে জাতিসংঘ ইচ্ছা করলেও অনেক কিছু করতে পারে না। যদিও ইতোমধ্যে তেলআবিব পৌঁছেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল সম্পর্ক-বিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি হাদি আমর। তার সফর সম্পর্কে ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস বলছে, দীর্ঘমেয়াদে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করবেন তিনি। কিন্তু কীভাবে?  হাদি সেখানে ইসরায়েল, ফিলিস্তিন ও জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলবেন। হাদি কি ইসরায়েলের কাছে জানতে চাইতে পারবেন ইসরায়েলি বিমান ও গোলা হামলায় যে ৪১ জন শিশু মারা গেলো তাদের অপরাধ কী? যাদের কারণে এগুলো হচ্ছে যুগের পর যুগ তাদের কি তিনি জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারবেন? পারবেন না। ফলে কোনো সমঝোতাও হবে না। হলেও সেটা হবে একতরফা। পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলি সংঘাতে প্রকাশ্যে বা গোপনে যারা ইসরায়েলি রক্তপাত ও বর্বরতা সমর্থন দিচ্ছেন তাদের সতর্ক করে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান। চলমান এই ইস্যুতে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। ওআইসি এ ব্যাপারে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বিশ্ববাসী দেখেনি। এ প্রসঙ্গে তাদের কর্মকাণ্ড ইতোমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ। যদিও তুরস্কের মতো বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনিদের সমর্থন জানিয়েছে। মানবতার সম্মান রক্ষার জন্য জেরুজালেমের পাশে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের বিবেকবান মানুষ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ইসরায়েলি সহিংসতার নিন্দা ও ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিনিধি পরিষদে ম্যাসাচুসেটসে অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত ডেমোক্র্যাট সদস্য আয়ান্না প্রেসলি সংসদ অধিবেশনে দেয়া ভাষণে ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকার ৩৮০ কোটি ডলারের সামরিক সাহায্যের ঘোর বিরোধিতা করেছেন।

ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে সৌদি আরবসহ কয়েকটি আরব দেশ। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে— আরব দেশগুলোর ভূমিকা কি এতটুকুই? তাদের প্রচুর সম্পদ আছে, প্রাচুর্য আছে। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য তাদের কোনো প্রচেষ্টা নেই। বিশ্বের বহু দেশ চরম দারিদ্র্যে নিমজ্জিত, বিশ্বের বহু শিশু এখনো না খেয়ে, বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। আর আরবরা মরুভূমির ভেতর শুধু বিনোদনের জন্য তৈরি করে চলেছে প্রাসাদ; সমুদ্রের ভেতর বড় বড় হোটেল। তাহলে তাদের জাকাত কোথায় যায়? ইসলামের সম-বণ্টনের নীতি তারা কীভাবে মূল্যায়ন করে? তাদের ভূখণ্ডেরই একটি অংশে চরম নির্যাতিত ফিলিস্তিনবাসী। তারা এ বিষয়ে এতটা নিশ্চুপ থাকে কী করে? তাদের কেন পরাশক্তিকে তোয়াজ করে চলতে হবে? বাংলাদেশ থেকে তারা শিক্ষা নিতে পারে। বাংলাদেশ সরকার বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নের ধার ধারেনি, নিজেদের সম্পদ দিয়ে তৈরি করছে পদ্মা সেতু। স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল যে পরাশক্তি তাকেও পাত্তা দেয়নি বাংলাদেশ। এখন তারাই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করছে। সুতরাং আরব বিশ্বকে নতুন করে ভাবতে হবে। ওআইসিকে আরো বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে হবে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট মোকাবিলায়। শুধু সংহতি প্রকাশে কাজ হবে না। বিশ্ব রাজনীতি ভুলে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে ইসরায়েলকে। না হলে এই সংঘাত শেষ হবে না।

লেখক : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক

আমারসংবাদ/জেআই