Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট মোকাবিলায় আমাদের করণীয়

মো. আশরাফুল ইসলাম

মে ২২, ২০২১, ০৭:৫৫ পিএম


ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট মোকাবিলায় আমাদের করণীয়

পুরো বিশ্ব এখন করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্ত। প্রতিনিয়ত করোনার নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের আঘাত সংক্রমণকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। নতুন ভ্যারিয়েন্টের আঘাতে ভারতে করোনা পরিস্থিতি বর্তমানে নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে। প্রতিদিনই আক্রান্তের হার ও মৃত্যু সংখ্যা বাড়ছে। দেশটিতে বর্তমানে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় চার হাজার ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিনই প্রায় চার লাখেরও বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। হাসপাতালগুলো এখন আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের তীব্র সংকট দেখা দেয়ায় অনেকে মারা যাচ্ছে। মৃত্যুর সংখ্যা এত বেশি যে, চিতায় দাহ করার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। করোনার ভয়াল ছোবলে পুরো ভারত যেন এখন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। মরদেহের ঠাঁই হচ্ছে না মর্গেও।

ভারতে ডাবল মিউট্যান্ট আতঙ্ক না কাটতেই সম্প্রতি ট্রিপল মিউট্যান্ট আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। ভাইরাস যত ছড়ায়, তার মিউটেশনের হারও তত বৃদ্ধি পায়। যেকোনো ভাইরাস ক্রমাগত নিজের ভেতর নিজেই মিউটেশন ঘটাতে থাকে বা নিজেকে বদলাতে থাকে। ফলে ভাইরাসের নানা ধরন তৈরি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পরিবর্তন প্রক্রিয়া নিয়ে তেমন মাথাব্যথার প্রয়োজন হয় না। কারণ নতুন সৃষ্ট অনেক ভ্যারিয়েন্ট মূল ভাইরাসের চেয়ে কম দুর্বল ও ক্ষতিকর হয়ে থাকে। আবার কিছু ভ্যারিয়েন্ট অনেক ছোঁয়াচে হয়ে থাকে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট মূলত এগুলোর একটি। ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়— এ চারটি রাজ্যে নতুন এ ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ইতোমধ্যে নেপালেও হানা দিয়েছে।

ভারতে যে দুটি ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে তা সারা বিশ্বে বিরল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড-১৯ ভাইরাসের তিনটি আলাদা স্ট্রেইন মিলে তৈরি হয় নতুন এ ভ্যারিয়েন্ট। এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের ক্ষমতাও তিনগুণের বেশি। তাছাড়া, নতুন এই স্ট্রেইনে আক্রান্তদের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। নতুন এ ভ্যারিয়েন্টের চারদিকে সংক্রমণ করার ৩০০ গুণ ক্ষমতা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

ভারতের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আইসিএমআরের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, নতুন এ ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত একজন রোগী ৪০৬ জনের শরীরে করোনা ছড়াতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে বিশেষ কোনো তথ্য নেই বিজ্ঞানীদের কাছে। যে কারণে আপাতত ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্নের বদলে ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্টের তালিকাতেই রাখা হয়েছে এটিকে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের ধরন শনাক্ত হওয়ার তথ্য দিয়েছে আইইডিসিআর। গত কদিনে ভারতফেরত বেশ কয়েকজনের দেহে ভারতীয় ধরন শনাক্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে সীমান্তের ২৯ জেলায় করোনার ভারতীয় ধরনের সংক্রমণ বেড়েছে। এই জেলাগুলোর সীমান্ত দিয়ে প্রতিনিয়ত মানুষ অবৈধভাবে যাতায়াত করছে। সম্প্রতি সাতক্ষীরায় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকা ১৩৯ জন ভারতফেরত যাত্রীর মধ্যে ১১ জনের শরীরে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। ভারত থেকে বাংলাদেশে অবৈধ উপায়ে লোকজনের প্রবেশকে এ সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য দায়ী করা হচ্ছে। এতে যেকোনো সময় করোনার ভারতীয় ধরনটি মহামারিরূপে সারা দেশে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। করোনার নতুন ধরনটি বি.১.১৬৭ নামে পরিচিত যা অতি সংক্রামক বলে বিভিন্ন গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। ভারতে করোনার সংক্রমণ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে এ ধরন ভূমিকা রাখছে বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশ যেখানে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে যেখানে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে করোনার লাগাম টেনে ধরার জন্য লকডাউন চলছে। লকডাউনে আন্তঃজেলা গণপরিবহন বন্ধ থাকার কথা বলা হলেও তা মানা হচ্ছে না। লকডাউনে বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করেই ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফিরছেন হাজারো মানুষ। রাস্তাঘাট, শপিংমল ও ফেরিঘাটে দেখা যাচ্ছে মানুষের অস্বাভাবিক ভিড়। কোথাও মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। এতে করোনা ছড়ানোর ঝুঁকি আরও বেড়ে যাচ্ছে।

দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণরোধে গত ২৬ এপ্রিল থেকে ১৪ দিনের জন্য সীমান্ত বন্ধ করে রাখার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। সীমান্ত বন্ধের এ ঘোষণা এখনো বহাল আছে। তবে সরকারের এ ঘোষণা পর্যাপ্ত নয়। কারণ এ নির্দেশনা কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করা না গেলে তাতে কোনো সুফল আসবে না। অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। বর্তমানে স্থলবন্দরগুলো দিয়ে চলছে পণ্য পরিবহন। পরিবহনসংশ্লিষ্ট লোকজন ও সাধারণ যাত্রীদের নিত্য আসা-যাওয়ার খবর মিলছে। সেখানে মানুষজন স্বাস্থ্যবিধি না মেনে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফলে ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। ভারত থেকে আসা যাত্রীদের সর্বোচ্চ কোয়োরেন্টাইন নিশ্চিত করা জরুরি। তা না হলে এটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সহযোগিতা প্রয়োজন। সম্প্রতি সীমান্তবর্তী এলাকায় কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকের পালিয়ে যাওয়ার খবর শোনা যাচ্ছে। অবৈধ পথে আসা ও যাতায়াত করা লোকজন দেশের অভ্যন্তরে অবাধে ঘোরাফেরা করায় সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের পালোনোর প্রক্রিয়া দ্রুত বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি একটি নির্ধারিত সময় পর্যন্ত কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। ভারতীয় ধরনের বিস্তার রোধে অভ্যন্তরীণ চলাচলের পাশাপাশি বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। এটার সঠিক মনিটরিং করা প্রয়োজন। কঠোরভাবে চলাচল নিয়ন্ত্রণ বিশ্বব্যাপী কোভিডের বিস্তার রোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। চীন, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বিশ্বের বেশকিছু দেশ এ পদ্ধতি অনুসরণে সাফল্য পেয়েছে। তাছাড়া, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ব্যাপকভিত্তিক সিকোয়েন্সের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এতে ভাইরাসটির গতি প্রকৃতি জানার পাশাপাশি ভারতীয় নতুন ধরনটি কতটুকু ছড়িয়েছে সে সম্পর্কে একটা সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে। তাছাড়া, ভারতের এই ভ্যারিয়েন্টটি বাংলাদেশের জন্য কতটুকু বিপদজনক তাও খতিয়ে দেখা দরকার। অন্যদিকে আমাদের ডাটাবেজও ডেভেলপ করা দরকার। যদি দেশের অধিকাংশ মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা যেতো তাহলে ঝুঁকি অনেকটাই কমে যেতো। তাছাড়া, বিদেশ থেকে আসা নাগরিকদের নমুনা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। অবৈধ পন্থায় যারা দেশে এসেছেন, তাদের অবশ্যই খোঁজ-খবর নিতে হবে। তারা যাদের সংস্পর্শে এসেছেন তাদেরও কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংয়ে রাখার ওপর অধিক জোর দিতে হবে। সীমান্ত এলাকায় রেড অ্যালার্ট জারি করা হলে অবৈধ পন্থায় কেউ দেশে আসতে পারবে না। যতদিন না ভারতে মৃত্যু ও সংক্রমণ কমছে ততদিন এই রেড অ্যালার্ট বহাল রাখা যেতে পারে।

অন্যদিকে বাংলাদেশে আসা ভারতীয় ট্রাক ড্রাইভার ও শ্রমিকরা যখন পণ্য আনলোড করার জন্য বন্দর এলাকায় প্রবেশ করে তখন তারা স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করেই বন্দরে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে অবাধে মেশে। ফলে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়ানোর উচ্চ সম্ভাবনা থাকছে। এক্ষেত্রে তাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি যদি নিশ্চিত করা না যায় প্রয়োজনে আমদানি বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ সবার আগে মানুষের জীবন, তারপর অন্যকিছু। আমাদের দেশে করোনা চিকিৎসায় আইসিইউ ও অক্সিজেনের তীব্র সংকট রয়েছে। এগুলোর পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিত করাটা অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। সর্বোপরি, করোনার ভারতীয় ধরন মোকাবিলায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শগুলোকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পাশাপাশি নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস। করোনা মহামারির মধ্যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস জনমনে আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ভারতের ২৯টি রাজ্যের সরকার ইতোমধ্যে এ সংক্রমণকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করেছে। ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়ে ভারতে ইতোমধ্যে ১০০-র বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এ ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বাংলাদেশের জন্যও গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেশে বর্তমানে অনেকের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে চরম অবহেলা দেখা যাচ্ছে। দোকানপাট, হোটেল, রেস্তোরাঁগুলোতে মানুষের প্রচণ্ড ভিড় দেখা যাচ্ছে। শপিংমলগুলোতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে কেনাকাটার দৃশ্য এখন রীতিমতো স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। যে যেভাবে পারে চলাচল করছে। কোথাও কোনো প্রকার মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। ফলে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়ানোর ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।

ভারতের তুলনায় আমাদের দেশে হাসপাতাল, চিকিৎসা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা খুবই কম। এমতাবস্থায়, যদি ভারতীয় ধরন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে বহু মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। এ কারণে সব ধরনের সতর্কতার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। শুধু সরকারি পর্যায়ে প্রস্তুতি থাকলে হবে না। আমাদেরও সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। করোনা মোকাবিলায় সরকারের নির্দেশনাসমূহ সঠিকভাবে মেনে চলতে হবে। তাছাড়া, করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করা দরকার। মানুষকে তথ্য জানাতে হবে, তথ্য জানালে মানুষ সতর্ক হবে। আমাদের সকলকেই স্বাস্থ্যববিধি মেনে চলতে হবে। মুখে সার্বক্ষণিক মাস্ক পরিধান, সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া এবং একে অন্যের থেকে নির্দিষ্ট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। হাত না ধুয়ে নাক, মুখ ও চোখ স্পর্শ করা যাবে না। রুমাল বা টিস্যু না থাকলে কনুই দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে হাঁচি-কাশি দিতে হবে। ব্যবহূত রুমাল, টিস্যু ও মাস্ক যেখানে সেখানে ফেলা যাবে না। প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে বের না হওয়াই ভালো। মাঠ পর্যায়ে যারা স্বাস্থ্যবিধি মানানোর দায়িত্বে রয়েছেন তাদের আরও কঠোর হতে হবে। সময় থাকতে করোনার ভারতীয় ধরনটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত। তা না হলে ভারতের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়বে বাংলাদেশ।

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আমারসংবাদ/জেআই